রকমারি ডট কম নিয়ে এখন ব্লগোস্ফেয়ারে বেশ তোলপাড় চলছে। হুমকি এবং পাল্টা হুমকি। ব্যাপারটা অবশ্য আর সেখানে থেমে নেই। আরও এগিয়েছে। অতি আঁতেলদের বচসাতে যেমনটা হয়, চুলের চামড়া ছিলতে বসে গেছেন সবাই।
কে কত বেশী মুক্তমনা, কে কত বেশী নিরপেক্ষ এবং অবশেষে কার ভাণ্ডারে কত বেশী গালি গালাজ আছে—তাঁর উদ্দাম নৃত্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বরাবরের মতই এবারও যে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না, তা হচ্ছে—ফলাফল। এই কাদা ছোঁড়াছুড়িতে কার লাভ হচ্ছে? কে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে? আর সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা মনে জাগছে—অবশেষে কি হবে।
ঘটনার শুরু একটি হুমকি থেকে। এই হুমকি পেয়ে রকমারির মালিক তাঁর ওয়েবসাইট থেকে একটি বই সরিয়ে ফেলেন।
লেখক প্রতিবাদ করেন। তাঁর আরও বেশ কিছু সহ লেখক ও প্রতিবাদ করেন। তাঁর উত্তরে মালিকের বক্তব্যের স্পষ্টতা না থাকায় বেশ কিছু লেখক এবং অনলাইন আক্টিভিস্ট রকমারি ডট কম বর্জনের ডাক দেন। একজন আর এক ধাপ এগিয়ে যান। পরিচিত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে দিয়ে তাঁকে ইন্টারোগেশান করানোর হুমকি (?) বা সম্ভাবনার কথা বলেন।
ঠিক একই সময় তাঁরা আবিস্কার করেন সেখানে মউদুদীর বই ও বিক্রি হচ্ছে। এই ঘটনা অনেক আগে থেকে ঘটলেও সেটা তাঁরা দেখতে পান নি কিংবা প্রয়োজন মনে করেন নি। এখন সে কারণে তাঁরা আইনি ব্যবস্থা নিতেও আগ্রহী।
আলোচনার কিংবা বিতর্কের মূল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে—হুমকি। একজন পাগলাটে মানুষের হুমকির উত্তরে মুক্তমনাদের হুমকি দেয়া সাজে কি না? কিংবা একজন জঙ্গী ধাঁচের মানুষ, যে পূর্বে তাঁর সফল একটি কর্মকাণ্ডের উদাহরণ টেনে একজন ব্যবসায়ীকে ধমক দিচ্ছেন, তাঁকে দোষী সাব্যস্ত না করে তাঁর ধমকে যিনি ভীত হয়েছেন তাঁকে শাস্তি দিতে উদ্যত হওয়া।
‘তোমার মরণ দুই দিকেই, কার হতে মরবা, সেটা ঠিক কর। ‘ অনেকটা ইরাকি জনগণের মত অবস্থা—একদিকে সাদ্দামের হাতে অন্যদিকে মার্কিন সৈন্যের হাতে।
অনলাইনে যারা ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা এমন ঝগড়া আগেও দেখেছেন। খুব সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে এমন ঝগড়া হয়েছে। এখনও হচ্ছে।
বাম আর আওয়ামীরা আলাদা হয়েছে। গণজাগরণের মৃত্যু ঘণ্টা বেজেছে। তাঁরা এখন ‘পণ্য বর্জনের’ ডাক দিয়ে বাণিজ্য মেলা আর বসুন্ধরা সিটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বতঃস্ফূর্ত এক গণ আন্দোলনকে গোলা টিপে মারবার পরেও কারো বোধোদয় হয় নি, একতা ব্যাপারটা কত জরুরী। যে আগুন একটি আন্দোলন তৈরি করতে পারে, সেই আগুন সেটাকে পোড়াতেও পারে।
ধৈর্য দিয়ে বুদ্ধিমত্তা-- আন্দোলন পরিচালনার জন্য কতটা জরুরী, সে শিক্ষা মনে হয় না এখনও তাঁরা পেয়েছে।
রকমারি ডট কমের ক্ষেত্রে সমস্যাটা কার? জঙ্গিদের? নাকি মুক্তমনা দের? যদি মুক্তমনাদের হয় তবে করণীয় কি? রকমারির মালিক ব্যবসা করতে এসেছেন। তিনি তো আর বিপ্লব করতে আসেন নি। ‘যে যাই হুমকি দিক, নীতির প্রশ্নে আমি অবিচল থাকবো’ তাঁর কি এই নীতিতে চলার কথা? নাস্তিক বাদী বই কি সব প্রকাশক প্রকাশ করে? এধরনের বই প্রকাশ এবং বিপণন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষই করে। এবং বলাই বাহুল্য এই নির্দিষ্ট শ্রেণী সংখ্যায় অপ্রতুল।
এবং এদের পাঠকও সংখ্যায় কম। আবার এটাও ঠিক, এই অল্পদের ভেতরেই ছিলেন সক্রেটিস আর গ্যালিলিও। এদের ওপরে চিরকাল হামলা হয়েছে এবং হবে। যারা তাঁদের পথে, তাঁদের সঙ্গে চলতে চাইবে, চলবে। আর যে ভীতু মানুষরা চলতে চাইবে না, এই মুহূর্তে তাঁদের সঙ্গ প্রত্যাশা অনুচিত? আর তাঁদের ‘ইন্টারগেশানের’ হুমকি দেয়াটা? একাজ করে কি তাঁরা নিজেদেরকে জঙ্গীর কাতারে নামিয়ে দিচ্ছেন না?
এখন মূল যে প্রশ্ন উঠছে কোন দোকানি যদি তাঁর দোকানে কোন বই রাখতে না চান, ভয়ে হোক আর ব্যবসায়িক কারণেই হোক, তাঁর উত্তরে মুক্তমনাদের করণীয় কি? তারচেয়েও বড় কথা, অনলাইন বই বিপননের ভবিষ্যৎ কি হতে যাচ্ছে।
রকমারি ডট কম যে সাফল্য এনে দিয়েছে অনলাইন পুস্তক বিপননে, সে পথে অচিরেই আরও অনেকে আসবে। প্রতিটি প্রকাশনীর নিজস্ব অনলাইন ‘দোকান’ হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং সেখানে খুবই দ্রুতগতিতে মুক্তমনাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাঁদের নিজেদের ওয়েবসাইট, নিজেদের বই বিপণন, এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করার সময় এসে গেছে। তবে সেব্যাপারে কাউকেই খুব চিন্তাশীল মনে হচ্ছে না।
তাঁদের আপাততঃ কাজ—ঢিসুম ঢিসুম।
কিছুদিন আগে আমরা ইউটিউব বন্ধ করেছিলাম। লাভ কার হয়েছে? এদেশের বিশাল এক কর্মী যারা অনলাইনে বিভিন্ন কাজে ইউটিউবের সাহায্য নেন, তাঁদের দুঃসহ কষ্ট হয়েছে। ইউটিউবের কিছু হয় নি। আমরা যতদিনে বুঝতে পারলাম, ইউটিউব বর্জন করে আমরা ইউটিউবের কিছুই করতে পারবো না তখন আবার খুলে দিলাম।
যদি ইউটিউবকে সত্যিই বর্জন করতে হয় তবে আমাদের নিজেদের একটা ইউটিউব বানাতে হবে। প্রয়োজনীয় সব ভিডিও দিয়ে তা সমৃদ্ধ করতে হবে। রকমারিকে নিয়েও এখন সেই অবস্থা হতে যাচ্ছে। আপনি রকমারিতে বই রাখবেন না ভালো কথা, রেখেন না। সেখান থেকে কিনবেন না, কিনেন না।
একটা দুইটা না রাখলে উনাদের কিছুই হবে না। ক্ষতি আপনারই হবে। বরং এই সুযোগে নিজেদের একটি ওয়েব পোর্টাল খুলুন। রাখুন সেখানে নিজেদের বই। কে মানা করেছে।
আর রকমারির পেছনেই বা লাগছেন কেন? দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দোষ দিচ্ছেন না কেন?
একজন ব্যবসায়ী নিজের ইচ্ছেমত বই তাঁর দোকানে রাখতে পারছেন না শুধু এদেশের পুলিশ প্রশাসনের ওপর তাঁর আস্থা নেই দেখে। যে পুলিশ থাবা বাবার মৃত্যু আটকাতে পারে নি, সে এমন আরেকটা ঘটনা আটকাতে পারবে তাঁর নিশ্চয়তা কি? যেখানে মূল আলোচনার বিষয় হওয়া উচিৎ এমন সব হুমকি কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, কিভাবে প্রশাসনকে বাধ্য করা যায়, যেন এমন হুমকি না আসে। যেন সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকার কিংবা প্রশাসনকে সক্রিয় হতে বাধ্য করা যায়। তা না করে এখন মুক্তমনারা মেতেছে, কাদা ছোঁড়াছুড়িতে নিজেদের পারদর্শিতা প্রমাণে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘আমরা কত সুক্ষ ভাবে চিন্তা করতে জানি’ তাঁর প্রমাণ দাখিলের।
চুলচেরা বিশ্লেষণে চুলকে ছিলে আলাদা করার ক্ষমতা যে তাদের এখনও বহাল আছে, ত্যানা প্যাঁচানোতে তারা যে সবাই ওস্তাদ, যেভাবে তাঁরা ‘গণজাগরণের’ বারোটা বাজিয়েছিলে সি ক্ষমতা যে তাঁদের এখনও আছে-- একথা প্রমাণে এখন তাঁরা সবাই ব্যস্ত। এই ফাঁকে, জয় হচ্ছে সেই হুমকি দাতার। এখন সে মহাসমারোহে ‘ডিক্টেট’ করবে—রকমারিতে কোন বই রাখা যাবে আর কোন বই রাখা যাবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।