"আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি" খলিফা হারুন-অর-রশীদ আজ খোশবাগে (প্রমোদকানন) যাচ্ছেন। সঙ্গে বেগম জোবায়দা খাতুন। উভয় পার্শ্বে খোলা তলোয়ার হস্তে খোজাগণ। রাজপথের দু'ধারে রাজপ্রাসাদ থেকে উপবন পর্যন্ত বসরার গোলাপতরু সারি সারি সজ্জিত। গোলাপবর্ণ মখমলে (চিকন বস্রবিশেষ) সমস্ত পথ মণ্ডিত।
দক্ষিণে বামে গৃহপ্রাচীরসমূহ গোলাপী রঙে রঞ্জিত।
অগ্রে আরব ঘোটকপৃষ্ঠে খলিফা, পশ্চাতে মহিষী (বেগম)। রাজাজ্ঞায় পথ জনপ্রাণীশূন্য।
কোথা থেকে পাগল বহ্লুল এল। বহ্লুল ধীরে ধীরে খলিফার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।
কেউ বলে বহ্লুল পাগল। কেউ বলে কামেল ফকির। বিশেষত রাজ অন্তঃপুরে তার অব্যাহত গতি। কেউ বাধা দিলো না। প্রধান দেহরক্ষী একবার খলিফার মুখের দিকে তাকালো।
খলিফা বললেন, "আসতে দাও। "
বহ্লুল অগ্রসর হয়ে বলল, "ওগো বেহেশত কিনবে?"
-কত দাম?
-লাখ টাকা।
-কই তোমার বেহেশত?
বহ্লুল ভিতর থেকে হিজিবিজি আঁকা একখানা মলিন কাগজ বের করলো।
খলিফা অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন, "যাও পাগল। এ তোমার পাগলামি করবার সময় নয়।
"
বহ্লুল সরে গেলো। কাগজখানা নিয়ে বেগমের কাছে ধরলো। বেগম দ্বিরুক্তি না করে গলা থেকে হীরের হার খুলে বহ্লুলের হাতে দিলেন। বহ্লুল চলে গেলো।
* * *
বাগদাদের আদালতে আর কখনো বুঝি এতো লোক জমেনি।
সকলেই প্রায় কাঙ্গাল গরীব। তারা এখানে কেন? এতক্ষণ ভিক্ষা করলে তাদের দু'পয়সা রোজগার হতো। কি জন্য সকলে সজলনেত্রে বসে আছে?
আজ আলী হুসাইন সওদাগরের বিচারের রায় দেয়া হবে। এমন দিন ছিল যখন প্রত্যেক বেলায় আলী হুসাইনের দস্তরখানে হাজার লোক বসত। দানের জন্য আলী হুসাইন আজ ঋণী।
দেনাও কম নয়, লাখ টাকা। শহরে এমন আমীর-ওমরাহ্ গরীব-দুঃখী ছিল না, যে একবার আলী হুসাইনের পোলাও-কোর্মার আস্বাদ গ্রহণ করেনি। আলী হুসাইনের ধনী বন্ধুরা আজ কোথায়? এমন একটা অপব্যয়ী দেনাদার দেউলিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখাটা লজ্জার কথা। তাই তারা কেউ আসেনি। এসেছে কেবল কতকগুলো লোক, হৃদয় ব্যতীত যাদের আর কোনো ধন নেই।
তারা কি দেবে? দু'ফোঁটা চোখের পানি বৈত কিছু নয়। দুনিয়ায় তার মূল্য কি?
কাজি-উল-কুজ্জাত (প্রধান বিচারক) রায় দিলেন, "দেনার দায়ে আলী হুসাইনের কারাদণ্ড। "
গরীব-দুঃখী হাহাকার করে উঠলো।
জনতার মধ্য থেকে কে চিৎকার করে বলল, "দোহাই আল্লাহ্র। মাফ চাই।
আমি টাকা দেবো। "
সকলের নজর সেদিকে গেলো। এ যে বহ্লুল পাগল !
আলী হুসাইন খালাস।
* * *
রাজপুরী কোলাহলশূন্য। শয়ন-প্রকোষ্ঠে খলিফা ও বেগম।
অন্য কেউ নেই। স্বর্ণনির্মিত শামাদানে একটি কর্পূরের বাতি স্থির আলো দিচ্ছে। একপাশে একটি আগরবাতি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।
খলিফা - "বেগম, তোমার মতো নির্বোধ তো দেখিনি। কি বলে তুমি লাখ টাকার হীরের হার দিয়ে একটা পচা কাগজ কিনলে?"
বেগম - "জাঁহাপনা, আমি কাগজ কিনি নি, বেহেশত কিনেছি।
"
খলিফা - "বহ্লুল একটা পাগল, আর তুমি তারও বাড়া। "
বেগম - "হতে পারে। আমি কিন্তু বহ্লুলকে সত্যবাদী বলে জানি। "
খলিফা - "সে একটা মস্ত বড় জোচ্চর (প্রতারক)। "
বেগম - "সে যা হোক, আমি কিন্তু সরল বিশ্বাসে তাকে হার দিয়েছি।
আল্লাহ আমার দিল দেখবেন। "
খলিফা - "তোমাদের মেয়েলোকের বুদ্ধিই এই প্রকার। আমি আর তোমার সাথে বৃথা বাক্য ব্যয় করতে চাই না। "
* * *
রাজপুরীতে হাহাকার পড়ে গেলো। বেগম জোবায়দা খাতুন আর নেই।
খলিফাও কাঁদছেন। তাকে সান্ত্বনা দেয় কে? মৃতদেহ সমাহিত করা হল।
খলিফা বললেন, "কবর খোঁড়। আমি একবার বেগমের মুখখানি দেখে নিই।
খালিফার আদেশ।
কবর খোঁড়া হল।
খলিফা কবরে নামলেন। কিন্তু লাশ নেই। কবরে এক বড় সুড়ঙ্গ। তিনি সুড়ঙ্গ পথে চলতে লাগলেন।
কোথায় সুড়ঙ্গ? এ যে প্রশস্থ মাঠ। সেখানে অসংখ্য ফুলের গাছ। পাখির মধুর কাকলীতে ঘাসগুলো পর্যন্ত যেন আনন্দ-হিল্লোলে নাচছে। তার ওপর আবার মৃদু মধুর সমীরণ (হালকা হাওয়া)। এমন ফুল গাছ, এমন বাতাস তিনি তো কখনো দেখেন নি, শোনেন নি, অনুভব করেননি।
কিন্তু তার চিত্তে আনন্দ কোথায়? জোবায়দা যে নেই।
সামনে একটি বালাখানা। পৃথিবীর রাজা তিনি, তবুও সে বালাখানার শোভা দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন।
ঐ যে জোবায়দা ! ঐ যে প্রাণের জোবায়দা ! জানালার নিচে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছেন।
খলিফা আনন্দে দৌড়ে ভিতরে প্রবেশ করতে গেলেন।
দারোয়ান বাধা দিলো। খলিফার রাগ হলো। কিন্তু তিনি এখানে কে? অনুনয় করে বললেন, "আমার সমস্ত রাজত্ব তোমায় দেবো, আমার বেগমের নিকট আমাকে যেতে দাও। "
নিষ্ঠুর সে। খলিফার কথায় কর্ণপাত করলো না।
খলিফা কেঁদে বললেন, "বেগম তুমি আমায় ভিতরে নিয়ে যাও। "
উত্তর এলো - "জাঁহাপনা, এই আমার সে বেহেশত যা আমি হারের বদলে কিনেছি। অন্যের এখানে আসবার অধিকার নেই। "
খলিফা কাতরভাবে কেঁদে উঠলেন। ঘুম ভেঙে গেলো।
পাশে বেগম নিদ্রা যাচ্ছেন। খালিফার মাথার বালিশ চোখের জলে ভিজে গেছে।
* * *
তখন ভোর হয়েছে। সিংহ দরজায় নহবত বাজছে। চারদিকে সুস্বরে পাখি গান করছে।
কর্পূরের বাতি নিভে গেছে। আগরবাতি পুড়ে গেছে। কিন্তু তখনো একটা সুগন্ধ ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে।
খলিফা ডাকলেন, মশরুর।
-জাঁহাপনা, গোলাম হাজির।
-যাও, বহ্লুলকে রাজসভায় নিয়ে আসো।
খলিফা সিংহাসনে বসে আছেন। চারদিকে উজির-নাজির উপবিষ্ট। এমন সময় বহ্লুল এসে উপস্থিত।
খলিফা - "এসো বহ্লুল, এসো এখানে বসো।
"
বহ্লুল - "কি গো, কি জন্য ডেকেছ? গর্দান নিবে নাকি? তোমাদের তো ঐ ই কাজ। হি হি হি। "
খলিফা - "না, বহ্লুল। তুমি বেহেশত বিক্রি করবে?"
বহ্লুল - "নাগো না। তোমার বাদশাহী দিলেও না।
"
খলিফা - "তবে বেহেশত কিসে পাওয়া যায়?"
বহ্লুল - "সরল বিশ্বাসে। আমি যাই। "
(সংক্ষেপিত ও চলিত ভাষায় রূপান্তরিত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।