মানুষ চিন্তাশীল জন্তু। জন্তুদের সঙ্গে মানুষের সব থেকে বড় পার্থক্য কী?
মানুষের সমাজে ভোট হয়। রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে ইশতেহার প্রকাশ করে। জন্তুদের মধ্যে মতাদর্শ বা ভাবাদর্শ আছে, এমন দাবি কি কোনও প্রাণীবিজ্ঞানী করেছেন? জানা নেই। কিন্তু আদর্শ নিয়ে আমরা মানুষেরা এখনও লড়াই করি।
সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনী ইশতেহার একে একে প্রকাশ করছে।
এই ইশতেহার ক্ষমতায় এলে আমরা প্রধান যে স্বপ্ন পূরণ করব, সেটি হল সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের ভাবনা। শিল্পপতি মুকেশ অম্বানী মুম্বাই শহরে একটি বাড়ি বানিয়েছেন। ২৭ তলা। চার লক্ষ বর্গফুট জায়গা।
১৬৮টি গাড়ি রাখার জায়গা। একাধিক হেলিপ্যাড। তিন তলা জোড়া শূন্যে উদ্যান। এর পাশাপাশি ভারত সরকার জানিয়েছে, আমাদের দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা ব্রিটেনের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। প্রত্যেক বছর বস্তিতে জায়গা করে নিচ্ছে আরও ২০ লক্ষ মানুষ।
একে বলে বৈষম্য। মানুষে মানুষে বৈষম্য আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারর মাধ্যমে ঘুচিয়ে দেওয়া হবে। ধনী-দরিদ্রের সংঘাত আর থাকবে না। এই সংঘাত অসুন্দর। দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী বলেছেন, সৌন্দর্য্যের অন্য নাম সুষমা।
যার বিপরীত শব্দ হল বৈষম্য। একটি সমাজে বাণিজ্য যতই বাড়বাড়ন্ত হোক, অল্প কিছু লোক যতই ক্রোড়পতি হয়ে উঠুন, তাদের বস্তি পরিবেষ্টিত ছশো ভৃত্য পরিচালিত ব্যক্তিগত প্রাসাদ যতই লক্ষ্মীমন্ত দেখাক, উৎকট বৈষম্যের ফলে সেই সমাজ অলক্ষ্মীরই উপাসক বুঝতে হবে। আসলে অন্য কোনও মানুষ বা প্রাণীকে উৎপীড়িত, যন্ত্রণায় বা দুঃখী দেখে যে সমবেদনার ভাব জাগে, মহাভারতে তাকে বলা হয়েছে অনুক্রোশ। আর সেই বোধই মানুষকে 'মানবতা' দেয়।
আমাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে আর্থিক বৃদ্ধি, অগ্রগতি, বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতা, শেয়ার বাজারের উত্থান— এই সব কিছুর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে এই আর্থিক বৈষম্য দূর করার উপর।
মহাভারতের শান্তি পর্বে যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নৃশংস বলতে আপনি কী কী ধরনের লোককে বোঝান? জবাবে ভীষ্ম বলেছিলেন, যে মানুষ অভুক্ত লোকেদের সামনে বসে উত্তম ভোজ্য, পেয়, লেহ্য উপভোগ করে খায়, সেই মানুষটিকে নৃশংস বলা উচিত। অতএব নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করছি, যে বা যারা সমবণ্টনে বিশ্বাসী নন, যারা ফলাও করে নিজের দানবৃত্তি সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান, তারাই নৃশংস। রুঁশো থেকে প্রুধোঁ যে বৈষম্যবিরোধী সমাজচিন্তা, আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার তাকে ভারতীয় প্রজ্ঞার রসে পুনরুজ্জীবিত করবে।
মন্দিরেও যদি যান, সেখানেও দেখবেন আম আদমি ভক্তদের দীর্ঘায়িত লাইন। ভিভিআইপি ভক্ত পুলিশ কর্ডন করে গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন ভিভিআইপি সমাদরে।
এই আম আদমির হয়ে মাঝে মাঝে কোনও কোনও নেতা স্বপ্ন দেখান যে, তাঁরা এই নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু ক্ষমতার সিংহাসনে আসীন হয়ে দেখা যায়, সেই রুমালও বিড়াল হয়ে যায়। গরিব বাউল একতারা নিয়ে আমেরিকা গিয়ে গান গেয়ে ডলার কামান। জ্যোতি বসু পাঁচতারা হোটেলে বসে জন্মদিন পালন করতেন। ভোজসভায় যোগ দিতেন।
এক কমিউনিস্ট নেতা, যার পাঁচতারা হোটেলে বসে মদ্যপানে ছুৎমার্গ নেই, তিনি এই প্রতিবেদককে বুঝিয়েছিলেন, আমরা পাঁচতারা বিরোধী নই। আমরা ধনী বিরোধী নই। আসলে আমাদের ইস্তাহারে বলা হয়, আমরা গরিব মানুষকেও পাঁচতারা হোটেলে ভুরিভোজের সুযোগ করে দেওয়ার সাম্য রচনা করতে চাই।
কপিল সিব্বলের মতো সুপ্রিম কোর্টের দুঁদে আইনজীবী ধনী রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন, বড়লোক হওয়াটা ঘৃণার বিষয় নয়। কাঁধে ঝোলা নিয়ে গরিবিয়ানা দেখানোটা সিউডো সাম্যবাদ।
বাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবেই। এক জন গরিব যদি বড়লোক হতে চায়, সে যদি ব্যবসা করে সমাজে সফল হয়, তাতে কার কী বলার আছে?
সমস্যা কিন্তু আছে। আমাদের ইস্তাহার বলছে, গরিব নিম্নবর্গের ব্যবসা করার অধিকার আর ধীরুভাই অম্বানীর ব্যবসা করার অধিকার একই জায়গায় অবস্থিত নয়। যে পূর্বশর্ত ব্যবসা ক্ষেত্রে অম্বানী তনয় পান, সেটি কি কোনও নিম্নবর্গের দলিত পেতে পারেন? আর এই কারণেই সেই ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই আম জনতার লড়াই চলছে এবং চলবে। রুশো তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ফরাসি সমাজও সেই সময় তিন ভাগে বিভক্ত ছিল।
একটি হল, দ্য ফার্স্ট এস্টেট। এরা অভিজাত সম্প্রদায়ের উচ্চবংশের বিত্তশালী মানুষ। সেকেন্ড এস্টেট ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মযাজক পাদ্রীদের নিয়ে। আর থার্ড এস্টেট হল সাধারণ মানুষ। কৃষক, শ্রমিক, অতিদরিদ্র, সর্বহারা।
আর এই তৃতীয় শ্রেণির উপরেই অত্যাচার চলত বাকিদের। রুশো লিখেছিলেন এবং চেয়েছিলেন বৈষম্য দূর হোক। তিনিও প্যারিস ছেড়ে ডেভিড হিউমেনের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানেই তাঁর আত্মজীবনী লেখা শুরু হয়। শেষ জীবনে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন।
গাছের সঙ্গে কথা বলতেন। বলতেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কোথায় ফরাসি বিপ্লব আর কোথায় ঊনিশ শতকের বাংলা সমাজ? তবু দেখুন সেখানেও কিন্তু জমিজার মহাজনের অত্যাচার চলছে। তিতুমীরের বিদ্রোহ হচ্ছে, দুদু মিয়া ও ফরাজি আন্দোলন হচ্ছে। সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, পাবনায় কৃষক বিদ্রোহ।
তৎকালীন সংবাদ সাময়িকপত্রে খুঁজে পাওয়া যায়, আধিপত্যকামীদের বিরুদ্ধে সে দিনের আম জনতার লড়াইয়ে নজির।
ভারতে আবার আর একটা লোকসভা নির্বাচন সমাগত। ৬৮ বছরের গণতন্ত্রে ধুঁকছে। ক্লান্ত তার শরীর। ’৬২ সালের চিনা আক্রমণের পর ’৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যু।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বহু চিঠিতে তিনি লিখেছেন দু'টি সমস্যার কথা। একটি মুদ্রাস্ফীতি, অন্যটি দুর্নীতি। নেহরুবাদী সমাজতন্ত্র দিয়ে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগঠন করে সমস্যা ঘোচাবেন এমন প্রতিশ্রুতি ছিল সে দিন। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাস স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। ’৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস প্রথম ধাক্কা খেয়েছে।
তার পর থেকে কখনও জয়, কখনও পরাজয়।
এ বার এসেছে এক নতুন পরীক্ষা। অনেক ইস্তাহারের মধ্যে আমাদের ইস্তাহার বলছে, এ বড় সুখের সময় নয়। আসুন, এক নতুন ইস্তাহার গড়ে তুলি। যে ইস্তাহার কোনও ম্যাজিক নয়, কোনও অতি বাস্তবতা নয়, আমাদের চিন্তা করতে শেখাবে।
বৈষম্যের অসুন্দরতাকে দূর করতে সাহস যোগাবে।
শম্ভু মিত্র এক বার বলেছিলেন, আমরা এমন এক সময়ে এসে পড়েছি তাতে মনে হচ্ছে আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতাটাকে কোনও এক ইনজেকশন দিয়ে বাড়ানো যেত, তা হলে বড় ভালো হত। বাজার অর্থনীতিতে কি নৈতিকতার কোনও স্থান নেই? দারিদ্র্যকে দমন করার জন্য তা হলে রাষ্ট্রীয় সৈন্যবাহিনী ঘুরে ঘুরে গরিবদের গুলি চালিয়ে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু তাতেও তো সমস্যার সমাধান হয় না। গরিবদের হঠাও বললেও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ হয় না! পুঁজিবাদেও আজকাল জনকল্যাণমুখীনতার দাপট দেখা যাচ্ছে।
বলা হচ্ছে, সৃজনশীল পরোপকারী পুঁজিবাদ।
ভারতে বলা হচ্ছে, সকলের জন্য বৃদ্ধি। কিন্তু আম আদমির কল্যাণ করতে গিয়েও তো দেখা যাচ্ছে ভর্তুকিরাজও মধ্যবিত্তদের জন্য, যথার্থ অন্ত্যজ গরিব নিম্নবর্গ দূরতর দ্বীপেই থেকে যাচ্ছে। নতুন ইস্তাহার চাই এই অন্ত্যজ সমাজের জন্য।
লেখক: সম্পাদক, দিল্লি আনন্দবাজার
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।