রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের বাতাসে আছে অবাক জাদু। সেই জাদুর পরশেই তৈরি হয়েছে বিশ্ব মাতানো জামদানি । শীতলক্ষ্যার পানি, আবহাওয়া ও জলবায়ুর অদ্ভুত রসায়নই বিস্ময়কর কাপড় তৈরির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এখানকার রোদের তেজে সুতায় আসে আলাদা ঔজ্জ্বল্য, যা পাওয়া যায় না পৃথিবীর অন্য কোথাও। আবহাওয়া এখানে তাঁতিদের মধ্যে তৈরি করেছে উদ্দীপনা, কর্মস্পৃহা।
ফিনফিনে মসলিন আজ ইতিহাস। বিশ্ব দরবারে স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জ্বল অভিজাত তাঁতবস্ত্র এই জামদানি। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে এ দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। বিশ্ব মাত করা মসলিন শাড়ির সংস্করণ অধুনা এ জামদানি। নারীর সৌন্দর্যসুধাকে বিমোহিত করে তুলতে জামদানির অপরিহার্যতা বিশেষ স্মরণীয়।
জামদানি নিয়ে উচ্চারিত হয়েছে চিরঞ্জীব পঙ্ক্তিমালা, যেখানে বন্ধুকে হাট থেকে তার প্রিয়তমা ঢাকাই জামদানি শাড়ি এনে দিতে বলেছে-'কতো রঙ-বেরঙের/ শাড়ি দিলাম/ নাম নাহি জানি/ হাটের পথে বন্ধু কয়/ আইনো ঢাকাই জামদানি। ' এভাবেই ঢাকাই জামদানি শাড়ির বন্দনা করেছেন কবিকুল। অথচ বিশ্বমাতানো এ শিল্পে আজ সমস্যার পাহাড়। তবে রয়েছে সম্ভাবনার সমুদ্রও। মুক্তবাজার অর্থনীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিদ্ধান্ত প্রদানে সরকারের দীর্ঘসূত্রতা, প্লট প্রদানে অনিয়ম, প্রকৃত জামদানি তাঁতিদের মধ্যে প্লট হস্তান্তর না করা ও ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতার কারণে জামদানি শিল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
জামদানির নামকরণ : জামদানি শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ। এর অর্থ জাম। জাম হচ্ছে পারস্য দেশীয় একশ্রেণীর উৎকৃষ্ট সুরা, আর দানি হচ্ছে বাটি বা পেয়ালা। অর্থাৎ উৎকৃষ্ট সুরা ধারণকারী পাত্র।
জামদানিশিল্পী পরিবার : এ শাড়ি যারা তৈরি করেন তাদের তাঁতি না বলে জামদানিশিল্পী বলাই ভালো।
জামদানিশিল্পীদের সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে এখানে ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো জামদানিশিল্পী ছিলেন। জেলা জামদানি শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্র জানায়, ৬০ হাজার লোক এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। অথচ আড়াই দশক আগেও এ সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। পরিবারের সংখ্যার বিচার বর্তমানে তা দেড় হাজার।
জামদানিশিল্পীদের কথা : বাদশাই আমলে জামদানি পরতেন রাজা-বাদশাহ-জমিদার পরিবারের নারীরা। আর এখন পরেন ধনী ও অভিজাত রমণীরা। জামদানির বর্তমান গরবিনী রমণীরা অনেকেই জানেন না তাদের পরিধেয় সেই শাড়িটির ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে কত দুঃখ, বেদনা আর বঞ্চনার ইতিহাস। ইংরেজ আমলে আঙুল কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে হাল আমলে লুণ্ঠনের ঘটনাও ঘটেছে। এর পরও ঢাকাই এ জামদানি শিল্প টিকে আছে মাথা উঁচু করে।
একেকটা শাড়ির পেছনে লুকিয়ে আছে একেকজন জামদানিশিল্পীর জীবন্ত ইতিহাস। প্রতিটি সুতার ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে তাদের ঘাম, কষ্ট, বেদনার কাহিনী। এই অসহায়-অশিক্ষিত দরিদ্র শিল্পীদের জীবনের কথা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শাড়িগুলো তৈরি করে তাদের মা-বোন-বউদের ভাগ্যে এক চিলতে সস্তা শাড়িও জোটে না। তারা দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখেন এ শিল্প একদিন সমৃদ্ধ হবে।
দূর হবে তাদের নিত্যদিনের অভাব-অনটন। সুখী জীবনের প্রত্যাশার প্রহর আর শেষ হয় না তাদের। বিরাট ফারাক থেকে যায় স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে। স্বপ্ন ফিকে হওয়ার যন্ত্রণায় জামদানিশিল্পীরা আজ দিশেহারা। ৮০ বছরের আবদুল গফুর মিয়া জীবনের প্রায় পুরোটা সময় পার করে দিলেন জামদানি তৈরি করে।
তিনি বলেন, 'অহন আর জামদানি কারিগররা ভালা নাই। হগল সমস্যা জামদানি কারিগরগো। ' জামদানিশিল্পী চম্পা-আনোয়ারা। তারা তৈরি করলেও নিজেরা কখনোই পরতে পারেননি জামদানি। দুজনই বললেন, 'কাপড় বুইন্যাই গেলাম, পরবার পারলাম না।
'
জামদানি রফতানি : বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে জামদানি শাড়ি রফতানি হচ্ছে। এ রফতানির সঙ্গে জড়িত শাড়ি ব্যবসায়ীরা। জামদানিশিল্পীদের কাছ থেকে তারা শাড়ি কিনে তা রফতানি করেন। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ওঠে এসব মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর ঘরে। শিল্পীরা স্বাদ পান না বৈদেশিক মুদ্রার।
প্রতিবছর জামদানি শিল্প এলাকা থেকে ৫০-৬০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি রফতানি করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, করাচি, লাহোর ও ইউরোপে প্রতিবছর বসে জামদানি মেলা।
সংকটে জামদানি শিল্প : ১৯৯৭ সাল থেকে জামদানি শিল্পে সংকটের সূচনা। নানা অনিয়মের কারণে ওই বছরই বন্ধ হয়ে যায় জামদানির রফতানি। ফলে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায় এ শিল্প।
সুতা, জরি, রঙ, কর্মচারীদের বেতন, খাওয়া-দাওয়ার খরচের পর লাভের মুখ দেখা যায় না। এ ছাড়া ভারতীয় শাড়ির দাম কম হওয়ায় বেশি দামে জামদানি শাড়ি কেউ কিনতে চায় না। কথাগুলো বললেন নোয়াপাড়া এলাকার জামদানিশিল্পী মনির হোসেন। তিনি বলেন, 'কোনো লাভ নাই ভাই। বাপ-দাদাগো পেশা তো।
তাই ছাড়বার পারি না। '
জামদানির আড়ত : শাড়ি বিক্রিকে ঘিরে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ায় জামদানি পলি্লতে রয়েছে আড়ত। এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত ভোররাতে হাট শুরু হয়ে শেষ হয় শুক্রবার সকালে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসেন জামদানি শাড়ি কিনতে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির 'হাঁ' : মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে চাকচিক্যে ভরা ভারতীয় শাড়ির আমদানি বাড়ছে।
বিদেশি শাড়ির প্রভাব, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি আর ক্রেতাদের বিদেশমুখী মনোভাব- এ সবকিছুই জামদানি শাড়ির আজকের এ অবস্থার জন্য দায়ী। আর মুক্তবাজারের এই 'হাঁ'-ই গিলে খাচ্ছে জামদানির ঐতিহ্যকে। বললেন জামদানিশিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন। তিনি দুঃখভরে বললেন, সরকার সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা দিলেই এ শিল্পকে বাঁচানো যেত।
দাদন-মহাজন প্রথা : বর্তমানে জামদানিশিল্পীদের দুঃসময় যাচ্ছে।
পিঁপড়ায় খাচ্ছে তাদের লাভের গুড়। অসচ্ছল ও নিরীহ প্রকৃতির জামদানিশিল্পীদের অক্ষমতার সুযোগকে ষোল আনাই কাজে লাগাচ্ছে একশ্রেণীর দাদন ব্যবসায়ী, মহাজন। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ওই সব মহাজনের কাছে পণবন্দী হয়ে পড়েছেন জামদানিশিল্পী ও কারিগররা। রূপগঞ্জে জামদানি এলাকাগুলোতে ৬০-৭০ জন মহাজন রয়েছেন।
শেষ কথা : স্বর্ণতুল্য সুতার কারুকাজসমৃদ্ধ মানসম্পন্ন রফতানিযোগ্য বউ-বরণীয় জামদানি শাড়ি তৈরির বিপুল সম্ভার রূগগঞ্জের নোয়াপাড়ার এ পলি্লকে করে তুলবে অতুলনীয়।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার লাগোয়া রূপগঞ্জের জামদানি পলি্লই হবে একমাত্র এলাকা, যা দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের শুভাগমনে হয়ে উঠবে মুখরিত। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ শিল্পকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠ করতে হবে। আর বিকশিত করতে হবে উৎকর্ষ, মান ও বৈচিত্র্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।