আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কী ঘটেছিল চুলু ওয়েস্ট পর্বতে ?

এম এ মুহিত বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ পর্বতারোহী, একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট শিখরে দুইবার আরোহণ ছাড়াও ৮০০০ মিটারের আরও দুইটি পর্বত চৌ য়ু এবং মানাসলু তিনি জয় করেছেন। (উল্লেখ্য যে বিশ্বে ৮০০০ মিটার উচ্চতার পর্বত আছে মাত্র ১৪টা, সবই হিমালয়ে। এগুলোতে আরোহণ পর্বতারোহণের গ্র্যান্ড স্ল্যাম হিসেবে ধরা হয়। ) এছাড়াও ২০১০ সালে এভারেস্টে একবার, ও গত বছর কাঞ্চনজঙ্ঘায় ও শিশাপাংমায় তার দুইটি আরোহণ অভিযান ছিল যা সফলতার মুখ দেখে নাই। আর ৬০০০ মিটারের ৫টা পর্বত শৃঙ্গ তিনি আরোহণ করেছেন ।

এম এ মুহিতের প্রথম পর্বতারোহণ অভিযান ছিল ২০০৭ সালে মে মাসে বি এম টি সি (Bangla Mountaineering and Trekking Club)-র চুলু ওয়েস্ট অভিযান, যেখানে সহযাত্রী হিসেবে ছিলে ক্লাবের সদস্য সজল খালেদ (প্রয়াত), মুসা ইব্রাহীম ও নূর মোহাম্মদ। দলনেতা ছিলেন সজল খালেদ। গতকাল ৭১ টিভিতে ২০১০ সালে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট শিখর বিজয় নিয়ে বিতর্ক ও সন্দেহ আছে এবং সংবাদ প্রচার কালে মুসা ইব্রাহীম বলেন – পাহাড়ে জালিয়াতি বাংলাদেশে প্রথম শুরু করেছিল সজল খালেদ ও এম এ মুহিত, সেটি ৬ ৪১৯ মিটার (২১,০৫৯ ফুট) উঁচু চুলু ওয়েস্ট শিখরে।


(চুলুর সাথে )

এই বিষয়ে এম এ মুহিত, নূর মোহাম্মদ এবং বি এম টি সির প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকের সাক্ষাৎকার এবং নিয়ে মুসা ইব্রাহীমের লিখিত রেকর্ড থেকে (দুই ধরনের লেখা দুই টি ভিন্ন জায়গায় ছিল, এবং নেপালে অবস্থানরত অবস্থায় দৈনিক প্রথম আলোতে নিয়মিত অভিযানের বর্ণনা দিয়ে ফিচার লিখেছিলেন। ) সেই পর্বতে কী হয়েছিল, কেন এবং কীভাবে সেটা সোজা ভাষায় ব্যাখ্যা করার জন্যই এই পোস্ট ---

http://www.youtube.com/watch?v=1am0Olqixw4
( এখানে গতকালের অনুষ্ঠান )

বি এম টি সি-র সদস্যরা কাঠমান্ডু পৌঁছানোর পর তাদের সাথে আগের পরিকল্পনা মতই দেখা হয় দার্জিলিংয়ে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের (HMI ) মুসা ইব্রাহীমের ব্যাচমেট ও বন্ধু তরুণ শেরপা সারিন প্রকাশ প্রধানের সাথে, অভিযানের এই সমস্ত কিছু ব্যবস্থা কার বিনিমিয়ে সে বিনা খরচে অভিযানে যোগদান করে।

যে তাদের নিয়ে যায় সোম বাহাদুর তামাং নামের পর্বতের গাইডের কাছে, এবং যাত্রা শুরু হয় হিমালয়ের দিকে।


(চুলু ওয়েস্ট অভিযানের ছবি )

আপনার সবাই জানেন সজল খালেদ ভাই কয়েক মাস আগে মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের পরে শিখর থেকে নামার এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই অভিযান নিয়ে তার সাথে অনেকবার কথা হয়েছে অতীতে, তার মতই দলের অন্য দুই সদস্য মুহিত এবং নূরও নিশ্চিত করেছেন পুরো অভিযানে দলনেতা সজল খালেদের সাথে সারেন প্রকাশের কারণে মুসা ইব্রাহীমের সাথে উদ্ভুত মন কষাকষি ( সারেন ছিল দলের Food Manager, যাবতীয় বাজেট তার হাতে। অন্যদের সাক্ষ্যে মনে হচ্ছে সে কিছু টাকা এখান থেকে সেভ করে নিজের পকেটে ভরার চেষ্টা করছিল, তার দেওয়া বাজেট এবং গাইডের ফির পার্থক্য থেকেই সন্দেহ শুরু হয়, পরে সারা পথ শুধু ডাল-ভাত খেতে খেতে ক্লান্ত অভিযাত্রীরা শক্তি অর্জনের জন্য মুরগীর মাংস সহ অন্যান্য খাবার কেনার জন্য বললে সারেন বারবার টাকা কম, টাকা নাই এমন কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, এমনকি একবার তার অনুমতি ছাড়া কেনা মুরগীর দাম দিতে অস্বীকৃতি জানায় ) চলছিল সারা অভিযানময়, যা মুসা ইব্রাহীমের প্রথম আলোর নিয়মিত কলাম এবং এই লেখাতে দেখতে পাবেন। কিন্তু একজন প্রয়াত সহঅভিযাত্রী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সেই তিক্ত সব ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে চাচ্ছি না, এবং পাঠকও আশা করি ব্যাপারটা বুঝবেন।

বিএমটিসি চুলু ওয়েস্ট জয় করেনি – মুসা ইব্রাহীম

১৬ মে, ২০০৭। তখন মধ্য রাত ঘড়ির কাঁটা ১টা ছুঁই ছুঁই করছে। বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) তিন সদস্য দলনেতা সজল খালেদ (মোহাম্মদ খালেদ হোসেন), এম এ মুহিত ও নূর মোহাম্মদ ঘুম থেকে উঠে চুলু ওয়েস্ট পর্বত চূড়া আরোহণের জন্য তৈরি হলেন। আর আমি শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে তাঁবু থেকে বের হলাম না। অজুহাত বলছি এ কারণে যে ট্রেইলে গত ১০ দিনে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে দলনেতার ওপর আর আস্থা রাখা সম্ভব হচ্ছিল না।

ক্লাইম্বিং গাইড সোম বাহাদুর তামাং আগেই তার পর্বতারোহণের সামর্থ ও জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। লেডার থেকে বেস ক্যাম্পে যাওয়ার সময় এক ফাঁকে তিনি বলছিলেন, সজল খালেদ জার্মানিতে নাকি বহু পর্বতে আরোহণ করেছে। আমাকে সে বহু গল্প বলল। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় আমার সন্দেহ আছে।

[u][i]দেখা যাক, চুলু ওয়েস্ট পর্বতে চূড়ান্ত আরোহণের সময়ই হয়তো এই সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।

এর মধ্যে ১৫ মে চুলু ওয়েস্ট ক্যাম্প ওয়ান থেকে হাই ক্যাম্প-এর মাঝে এক পর্বতের গায়ে রোপ ফিক্স করে ফিরে এসে তার সেই সন্দেহাতীত মন্তব্য করলেনÑ যে অভিযানের দলনেতা হাঁটু দিয়ে পর্বতারোহণ করে, তাকে তোমরা দলনেতা বানালে কেন? ঘটনা হলো পর্বতের যে অংশে সিঙ্গেল জুমার ক্লাইম্বিং করা যায় শরীরকে পর্বতের সঙ্গে প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে রেখে, সেখানে সজল খালেদ হাঁটু দিয়ে ক্লাইম্ব করেছে। সোম বাহাদুর বর্ণনা করছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে আইস বুটের ওপর না দাঁড়িয়ে তুমি হাঁটু ব্যবহার করছ কেন? জবাবে সে বলল, আমাকে তো কেউ বলে নি যে কিভাবে সিঙ্গেল জুমার ক্লাইম্ব করতে হবে। ১৫ মে দুপুরের খাবারের পর থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সারিনের সঙ্গে সোম বাহাদুরের তাঁবুতেই কাটালাম বহু সময়। তখনই আলাপে ওই ঘটনা জানালেন সোম। তার সঙ্গে ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে চুলু ওয়েস্ট পর্বত জয়ের বিভিনড়ব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হলো।

অভিযানের সদস্যদের কার কি অবস্থা? কার পারফরমেন্স কেমন? চুলু ওয়েস্ট পর্বত জয়ের ক্ষেত্রে কতটুকু সময় লাগতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরের দিনটিই সেই বহু কাঙ্খিত দিনচুলু ওয়েস্ট পর্বত জয়ের আকাঙ্খা পূরণের দিন। অথচ দলের বাকি তিন সদস্য তাঁবুতেই শুয়ে আছে। সন্ধ্যার পরপরই রাতের খাওয়া সেরে নেয়া হলো। তাঁবুতে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পুরো দিনের কর্মকা- পর্যালোচনা করছিলাম।

সেই সঙ্গে মনে পড়ল ফ্রে পর্বতে অভিযানের কথা। তখন কেনো এবারের দলনেতাকে চিনতে পারিনিতার এবারের কাজকর্ম কেমন যেন অপরিচিত ঠেকছে। কোথায় যেন গরমিল।

সেই সঙ্গে সোম বাহাদুর তামাংয়ের এই অভিজ্ঞতা বর্ণনার পর শেষ মুহূর্তে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলাম। তবে সেটা ঘোষণা দিয়ে নয়।

এবং প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করেও নয়। মনে মনে ভাবলাম, যার সঙ্গে যতো বিরোধই থাক না কেন, দেশে ফিরে তা মিটমাট করে নেয়া যাবে। যে কাজে এসেছি, তা আগে ভালোয় ভালোয় শেষ করি। এমন চিন্তা থেকে সবাইকে জানালাম, আমার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। সুতরাং আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

নেপাল থেকে এ অভিযানে যোগ দেয়া বন্ধু সারিন দলনেতার সঙ্গে মতবিরোধের কারণে বহু আগেই দল ত্যাগ করতে চেয়েছিল। সেসব ছেলেমানুষি বিরোধ নয়। শুধু আমার অনুরোধেই দু’বার সে সিদ্ধান্ত পাল্টেছে। যাই হোক। রাত আড়াইটার দিকে নুডুল সুপ ও চা খেয়ে এবং পর্বতারোহণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পরে নিয়ে সোম বাহাদুর সজল, মুহিত, নূর ও সারিনকে নিয়ে ওয়েস্ট পর্বত চূড়ার দিকে রওয়ানা দিল।

তাঁবুতে শুয়ে শুয়ে আমি তাদের যাওয়া দেখছিলাম। তখন ভোররাত প্রায় সাড়ে চারটা। কিচেন-টেন্ট থেকে আসা চুলার হিসহিসানি থেমে গেছে। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধতা এমনই যে একটা পাথরকণা গড়িয়ে পড়লেও তার শব্দ কানে আসবে।

হঠাৎ সোম বাহাদুর আর সজলের জোরে চিৎকার কানে এল। ঘটনা কি? কান খাড়া করলাম। যে উচ্চতা থেকে শব্দ আসছিল, বুঝতে পারলাম তখন পর্বতের যেখানে রোপ ফিক্স করা হয়েছিল, সেখানে সবাই পৌঁছেছে। সবাই নূর মোহাম্মদের নাম ধরে কি যেন বলছে। পরে ভোরের আলো ফুটতেই পোর্টারদের কেউ একজন আমার তাঁবুর কাছে এসে ‘নূর ফিরে আসছে’ বলে শোরগোল তুলতেই তাঁবু থেকে বের হতেই হলো।

দেখলামÑ ঠিকই নূর ফিরে আসছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ক্লান্তিতে তার পা চলছে না। তাঁবুর কাছে এলে তিনি ফিরলেন কেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর দল ফিক্সড রোপের প্রান্তে পৌঁছে। এখান থেকেই সরঞ্জাম ব্যবহার করে টেকনিক্যাল ক্লাইম্বিং শুরু করার কথা। সবাই একের পর এক জুমার ক্লাইম্বিং করে উঠছিলাম। কিন্তু সবার ওঠার গতি ছিল খুবই ধীর।

তাই উঠতে সময় লাগছিল। আমি ছিলাম সবার শেষে। ওরা ওপরে উঠে গিয়ে আমাকে ডাকাডাকি করছিল যে আমি ঠিক আছি কি না? আমিও সময়মতোই কথা বলছিলাম। কিন্তু ওখানে পর্বতের গা একটু ওভারহ্যাং ধরনের। তাই আমার কথা ওরা শুনতে পারছিল না।

এভাবে ধীরে ধীরে মূল দল থেকে খানিকটা বিচ্ছিনড়ব হয়ে পড়লাম। এরপর সজল ফিরে যেতে বলায় দলের স্বার্থে ক্যাম্প ওয়ানে ফিরে এসেছি। সেই পর্বতের গা থেকে চুলু ওয়েস্ট চূড়ার পথ বেশ লম্বা। পুরোটাই গ্লেসিয়ার। ক্যাম্প ওয়ান থেকে পুরো পথই চোখে পড়ে।

এমনকি চূড়াও। কাজেই তাঁবু থেকে বের হয়ে গ্লেসিয়ার, চুলু ওয়েস্ট চূড়া এবং ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর রাখছিলাম যে কখন কোথায় কাকে দেখা যায়। নূর যে জায়গা থেকে ফিরে এসেছে, তার উচ্চতা প্রায় ১৯ হাজার ফুট। আর বাকি সদস্যরা পর্বতের যে গায়ে ট্র্যাভার্স করছিল, তার উচ্চতা প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার ফুট। ক্যাম্প ওয়ান করা হয়েছিল প্রায় ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায়।

তখন সকাল সাতটা। নজরে এল সোম বাহাদুরকে। একটু পরে সারিন। এর পরপর সজল ও মুহিত। তারা সবাই সেই পর্বতের গায়েই ঘুরপাক খাচ্ছে।

ঘড়ি দেখছি আর ভাবছি, ওদের তো এখন গ্লেসিয়ার পাড়ি দিয়ে পর্বত চূড়ার পাদদেশে চলে যাওয়ার কথা। সোম বাহাদুরের হিসেব অনুযায়ী তাদের সেই অবস্থান থেকে গ্লেসিয়ার পাড়ি দিয়ে চুলু ওয়েস্টে আরোহণ করতে হলে কমপক্ষে চার ঘণ্টা সময় লাগার কথা। সে হিসাবে তাদের চুলু ওয়েস্ট আরোহণ করে ফিরতে ফিরতে তো বিকেল হয়ে যাবে। কিন্তু আবহাওয়া যেভাবে দুপুরের পর থেকে খারাপ হতে শুরু করে, তাতে ওরা বিপদে পড়বে না তো? এমন সব চিন্তার ফাঁকে ওপরের দিকে চোখ রাখছি যে ওরা কতদূর এগোল? এরপর সকালের প্রাতরাশ সারলাম। ক্যাম্প ওয়ানের আশপাশে কিছুটা ঘোরাঘুরি করলাম।

সৌভাগ্যবশত হিমালয় পর্বতশ্রেণীর পাথরে সৃষ্ট একটা ফসিলও পেয়ে গেলাম। এরপরই হঠাৎ সেই পর্বতের গা থেকে উল্লাসধ্বনি, চিৎকার ভেসে এল। ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা। সবাই দেখলাম যে পর্বতের গায়ে রোপ ফিক্স করা হয়েছিল, তার খানিকটা ওপরেই সজল ও মুহিত চিৎকার করছে। আমরা ক্যাম্প ওয়ানে থেকে যাওয়া সদস্য এবং পোর্টাররা সবাই অবাক।

হঠাৎ এমন কি হলো যে তারা এমন উল্লাস করছে? কারণ সেই জায়গা থেকে চুলু ওয়েস্ট পর্বত বেশ দূরে, অনেক উঁচুতে। তাহলে? এসব প্রশেড়বর জবাব পাওয়া গেল যখন সবাইকে আরো অবাক করে দিয়ে মুহিত, এর পর সজল ও সোম বাহাদুর এবং সবশেষে সারিন ফিরে এল। সজল ফিরেই জানাল, সামিট করেছি। বললাম, আপনারা তো এই পর্বতের ওই মাথায় ছিলেন, আমি তো তাঁবুতে বসেই তা দেখেছি। আর চুলু ওয়েস্ট তো সেই ওইখানে।

তাহলে আপনাদের সামিট হয় কিভাবে? এরপর তার ব্যাখ্যা ‘আমরা যে উচ্চতায় উঠে যে জায়গাটিতে পৌঁছেছি, এর পরপরই গ্লেসিয়ারের শুরু। কিন্তু শুরুর মুখেই গ্লেসিয়ার ধ্বসে যাওয়ায় চুলু ওয়েস্টের দিকে আর যাওয়া যায় না। কাজেই আমরা যে জায়গাটিতে পৌঁছেছি, সেটাই ছিল চুলু ওয়েস্ট পর্বতের বর্তমান ‘সামিট পজিশন’। কাজেই আমাদের সামিট হয়েছে। ’ সে মুহূর্তে এ নিয়ে আর তর্ক বাড়ালাম না।

বিশ্রাম ও খাওয়া-দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ পরেই পুরো তাঁবু প্যাক আপ করে আমরা নামতে শুরু করলাম। বেস ক্যাম্পে দক্ষিণ কোরিয়ার এক পর্বতারোহীর সঙ্গে সাক্ষাত হলো।

শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আমাদেরকে ‘কোল্ড টি’ পানের অনুরোধ করল। এ সময়ে তার আর গাইডের সঙ্গে বিভিনড়ব তথ্য বিনিময় করছিলাম। আমাদের যেতে কতো সময় লাগল, কিভাবে কিভাবে গেলাম ইত্যাদি।

তার গাইডের কাছে জানতে চাইলাম, চুলু ওয়েস্ট পর্বতের সামিট পজিশন বদলে গেছেÑ এমন কোনো তথ্য তার জানা আছে কি না? গাইড মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর জানাল। আগে থেকে মনে গেঁথে থাকা প্রশড়বটা তখন ডালপালা মেলতে শুরু করেছিলÑ আসলেই কি চুলু ওয়েস্ট জয় করেছি আমরা? না কি এটা প্রোপাগা-া হিসেবে চালানো হবে? এসব প্রশেড়বর উত্তর আর কারো কাছে পাওয়া সম্ভব কি? এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে একই ট্রেইলে ফিরতি পথ ধরলাম। এ নিয়ে আর কোনো কথা হলো না। নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশণ থেকে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা হলো। নূর মোহাম্মদও সার্টিফিকেট পেল।

এমনকি যে আমি তাঁবুতে বসেছিলাম, সেই আমিও চুলু ওয়েস্ট জয়ের সার্টিফিকেট পেলাম। হায় চুলু ওয়েস্ট! দেশে ফিরলাম সবাই। এখানে তখন চুলু ওয়েস্ট জয়ের ডামাডোল বাজছে। বিএমটিসি’র ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আল হককে ব্যাপারটা জানানোর পরও সেই ডামাডোল বন্ধ হয় নি। বরং শুক্রবার, ৮ জুন ২০০৭ তারিখে প্রেস কনফারেন্স করা হলো জাতীয় প্রেস ক্লাবে।

এখানে অবশ্য বলা হলো সজল ও মুহিত চুলু ওয়েস্ট জয় করেছে, বাকি দু’জন করতে পারে নি। এরপর ২০ জুন মাসের তৃতীয় বুধবার ইনাম আল হকের বাসায় মাসিক মিটিংয়ে চুলু ওয়েস্ট অভিযানের স্লাইড দেখানো সময় সজল খালেদ বর্ণনা করছিল এভাবেÑ ‘এটা হলো আমাদের সামিটের ছবি। আমরা ১৬ মে অফিসিয়ালি চুলু ওয়েস্ট জয় করি। ’ তখন থেকেই দেশের অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে শুরু হয় কানাঘুষা। এরপর নেপালের সারিন ই-মেইলে চুলু ওয়েস্ট অভিযানের বৃত্তান্ত সবিস্তারে জানানোর পরই ব্যাপারটা খোলাসা হয়।

ই-মেইলে সারিন জানায়, বিএমটিসি চুলু ওয়েস্ট জয় করে নি। এবং ২০০৭ সালের ১২ ডিসেম্বর কাঠমা-ু থেকে ঢাকায় আসার পর দেশের অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাছে সারিন সরাসরি ব্যাখ্যা করার পর বিএমটিসি’র টিম যে চুলু ওয়েস্ট জয় করেনি, এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। তখন সারিনের কাছেই জানতে পারিÑ ক্যাম্প ওয়ানের পর চুলু ওয়েস্ট পর্বতচূড়ায় যাওয়ার পথে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পর্বতের গায়ে পৌঁছে সজল ও মুহিত যে আনন্দোল্লাস করেছে চুলু ওয়েস্ট জয় করেছে বলে, তা ছিল সজলের পরিকল্পিত। এবং যেহেতু সজলের সঙ্গে তার সম্পর্ক তখন ভালো নয়, তাই সে এর কোনো প্রতিবাদ করে নি। আর এভাবেই প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে বিএমটিসি চুলু ওয়েস্ট জয় করেছে, আদতে যা ছিল মিথ্যা দাবি।

[/u][/i]

অবশ্য এই লেখার আগের বি এম টিসির মুখপাত্র পত্রিকা শিখর পেরিয়েতে মুসা ইব্রাহীম নিজেই অন্য ভাবে শিখর জয়ের গল্প শুনিয়েছিলেন-

সেই অভিযানের আগের সজল খালেদ এবং মুসা ইব্রাহীমে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আমন্ত্রণে ফ্রে পিক অভিযানে গিয়েছিলেন কিন্তু নূর মোহাম্মদ ও এম এ মুহিতের সেইটিই ছিল প্রথম উচ্চ শিখর অভিযান, যেখানে এক তাবুতে মুসা এবং সজল, অপর তাবুতে মুহিত ও নূর থাকতেন। গাইড, সারেন ও অন্যরা আলাদা আলাদা তাবুতে থাকত। যেহেতু মুসা ইব্রাহীমের উপরের লেখাতে যাত্রা পথের অনেক কিছুরই বিবরণ আছে, তিনি অসুস্থ হয়ে যাবার অজুহাত দেখিয়ে তাবুতে ছিলেনা তাও উল্লেখ আছে ( যদিও বাকী ৩ জন অন্য কথা বলেছেন, কিন্তু সেটা প্রাসঙ্গিক নয় বিধায় টানছি না) কেবল নেই চূড়ার কাছে কী হয়েছিল-


(চুলুর পথে )

গ্লেসিয়ারের যে খানে পাথরধ্বস, বরফধ্বস বা যে কোন প্রাকৃতিক কারণে যে দুরতিক্রম্য ফাটলের সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে গাইড সোম বাহাদুর তামাং বলেছিল যেহেতু মূল সামিটে (৬ ৪১৯ মিটার বা ২১,০৫৯ ফুট) যাওয়া আর সম্ভব না, এইটাই অফিসিয়াল সামিট যা মূল সামিট থেকে ৫০ মিটার (১৫০ ফিট) নিচে । সেখানে অবস্থিত কিছু দণ্ড, রঙ ঝলমলে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দেখিয়ে সোম বাহাদুর বলেন , এই যে দেখ পতাকা বাঁধবার দণ্ড, এইখানে এসেই অন্য অভিযাত্রীরা পতাকা উড়িয়ে ছবি তুলে Official Summit করেন। ব্যস, অভিযাত্রীরা খুশি হয়ে, ছবি তুলে, আনন্দ নিয়ে নিচের দিকে নেমে যান।



(অফিসিয়াল সামিটের সেই ছবি , বামে এম এ মুহিত, ডানে সজল খালেদ )

অবশ্য ক্যাম্পে ফেরার পর যাত্রা পথের এই অবস্থা শুনে মুসা ইব্রাহীমও সামিট করার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং বলেন সম্ভব হলে দলের সবাইকে নিয়েই আবার পরের দিন অভিযানটির পুনরাবৃত্তি করতে। কিন্তু অন্যদের ক্লান্তি ও দলের সময়ের অভাবে ইত্যাদির কারণে সেটা আর সম্ভব হয় নি। পরে কাঠমান্ডুতে এসে দলের চারজনের নামেই শিখর জয়ের সার্টিফিকেট এনে দেন সোম বাহাদুর তামাং। অভিযাত্রীরা ঢাকায় ফিরে আসার পরে প্রেস কনফারেন্সে বলা হয় সজল এবং মুহিত শিখরে পৌঁছেছেন কিন্তু জয় হয়েছে পুরো দলের।

এর মধ্যে কাঠমান্ডুতে সারেনের সাথে খাবার ও অন্যান্য বাপারের অভিযাত্রীদের কথা কাটাকাটি হলে সবাইকে অবাক করে মুসা ইব্রাহীম নিজ দলের ও দেশের সহযাত্রীদের বাদ দিয়ে তার ব্যাচ মেটের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন যার জের চলতে থাকে ঢাকাতেও।

এক পর্যায়ে মুসা বি এম টি সি-র প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হককে জানান সজল ও মুহিত আসলে চুলু ওয়েস্টের শিখরে পৌঁছান নি, কিছুটা নিচ থেকেই চলে এসেছে। সারেনের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে এর সত্যতা জানতে চাইলে সে সজল খালেদের নামে ব্যপক বিষেদাগার করলেও লিখিত ভাবে জানিয়েছিল যে তারা Official Summit করেছে। (ইমেইলের কপি আছে আমার কাছে)

প্রতিষ্ঠানের মাঝে এমন মন কষাকষি ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কারণে সকলের বক্তব্য শুনে ইনাম আল হক মুসা ইব্রাহীমের সর্বত সাফল্য কামনা করে তাঁকে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে অ্যাডভেঞ্চার চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ নিয়ে বি এম টি সি থেকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। এই পরে মুসা গড়ে তোলেন নিজের সংগঠন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে হিমু ভাইয়ের নেয়া এই সাক্ষাৎকার এম এ মুহিত স্পষ্ট বলেছিলেন অনভিজ্ঞ বিধায় তারা তাদের গাইডের প্রতারণার শিকার হয়েছেন, অফিসিয়াল সামিট বলে কিছু নাই আসলে পর্বতে ! এই ব্যাপারে দায়ভার স্বীকার করার বর্ণনা চাইলেই শুনতে পারেন লিঙ্কে ক্লিক করে।

কে এই সোম বাহাদুর তামাং?

যার নামে প্রথম আলোতে লেখা হয়েছিল সোম বাহাদুর মাউন্ট এভারেস্টকে হাতের তালুর মত চেনেন যদিও আজ পর্যন্ত সেখানে ওঠা হয় নি তার ( এমন হাস্যকর কথা জীবনে খুব কম শুনেছি যদিও ), যে পরবর্তীতে মুসা ইব্রাহীমের সাথে বিতর্কিত সবগুলো পর্বত অভিযানে ছিল ( লাংসি সি রা, অন্নপূর্ণা ৪ এবং এভারেস্ট)। লাংসি সি রা এবং অন্নপূর্ণায় কী হয়েছিল এইটা জানতে পড়ুন এই পোস্ট, এবং সোম বাহাদুরের এই সমস্ত জালিয়াতি ও প্রতারণা নিয়ে তো পর্বতারোহী মীর শামছুল আলম বাবুর কথা শুনলেনই কালকের অনুষ্ঠানে।

http://www.youtube.com/watch?v=Z9gkJ6bIOkw

আসল কথা হচ্ছে কেউ যদি চুলু ওয়েস্ট অভিযান নিয়ে জল ঘোলা করতে চায়, তার জন্য স্পষ্ট বলা হচ্ছে বি এম টি সি সেই শৃঙ্গ জয় করে নি, কিন্তু গাইডের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে অনভিজ্ঞ দলটি মনে করেছিল তারা সামিট করেছে, যেটা এম এ মুহিত অনেক আগেই স্বীকার করেছেন।

পর্বতে উঠতে হলে ফেসবুকে, ব্লগে, খবরের কাগজে ঝড় তোলার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অনুশীলন করা, পর্বতে যাওয়া, এবং তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ একটি বড় মনের অধিকারী হওয়া।



সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.