আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কী ঘটেছিল প্রধান শিক্ষকের কক্ষে?

আমার সোনার দেশ, বাংলাদেশ লেখাটি প্রথম আলোতে লিখেছেন মানিক আনিসুজ্জামান: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। কী ঘটেছিল ডা. আবুবকর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে? জানার উপায় নেই। আমরা শুধু এটুকু জেনেছি, সনজিতা খাতুন আর নেই। সনজিতা চলে যাওয়ার সময় কাউকে কিছু বলে যায়নি। আমাদের উদ্দেশে কিছু লিখেও যায়নি।

সনজিতার মা বাড়িতে ছিলেন না। ছোট ভাই ছিল ঘরের বাইরে। বাড়ি বলতে সনজিতাদের একটি ঘর। তিনজনের সংসার। বাবা নেই।

মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে সনজিতাদের সংসার। মাটির ঘরটিতে নিত্য অভাব থাকলেও সুখের কমতি ছিল না। দেড়-দুই বিঘা জমি ছিল। বাবার অসুখের সময় তাও বিক্রি হয়েছে। এখন আয় বলতে বাড়ির সামনে ছোট একটি মুদির দোকান।

দোকানের আয়ে কি তিনজনের সংসার চলে? মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সনজিতার মা জানালেন, চেয়েচিন্তে কোনো রকমে বেঁচে আছি। আমরা যখন সনজিতাদের বাড়ি পৌঁছাই, সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। দর্শন বিভাগের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন সনজিতার মায়ের কান্না দেখে ঠিক থাকতে পারেননি। আমি শুধু সহকর্মীকে চোখ মুছতে দেখলাম।

সনজিতাদের বাড়ির সবাই বাকরুদ্ধ। এরা কথা বলছে না, এরা কান্না করছে। সনজিতার জন্য বিলাপ করছে। এ ছাড়া এদের আর কী করার আছে? সনজিতার চাচারা কাঁদছেন। প্রতিবেশীদের চোখে পানি।

বাড়ির পাশে মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে যাঁরা এলেন, তাঁদের চোখেও পানি। এঁরা সবাই অপরাধীর বিচার চান। সনজিতার বয়স কত হয়েছিল? শৈশব শেষে কৈশোরে পা রেখেছে মাত্র। এরই মধ্যে হায়েনার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে তার ওপর। অপমান সে সহ্য করতে পারেনি।

স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে এসে সোজা মাটির ঘরে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে পড়ার টেবিলের পাশেই ওড়না পেঁচিয়ে জীবন শেষ করেছে। অপমানিত জীবন সে রাখতে চায়নি। সে কারও কাছে বিচার চায়নি। সে হয়তো জানত, বিচার পাওয়া যায় না।

সনজিতার মতো অনেক মেয়ে নীরবে অপমান সহ্য করে। সনজিতা অপমানিত হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্মহননের পথকে উপযুক্ত মনে করেছে। সনজিতাকে যে ব্যক্তি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনিই প্রকৃত খুনি। খুন করা এবং হত্যার জন্য প্ররোচিত করা সমান অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এখনো অপরাধীকে ধরতে পারেননি।

তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানিয়েছেন, অপরাধীকে ধরার চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টা কত দিন চলবে? আমার শুধু একবার জানতে ইচ্ছে করে, সনজিতা যদি তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মেয়ে হতো, তাহলেও কি একই ধরনের চেষ্টা চলত? সনজিতা আমাদের বোন। সে আমাদের কারও সন্তান, কারও বোন, কারও নিকটাত্মীয়। কিন্তু সে আমাদের সমাজেরই একটি মেয়ে। এই সনজিতারা অপমানিত হয় হিংস্র দানবদের দ্বারা।

যারা হাত-পাবিশিষ্ট মানুষ। আমাদের চারপাশেই থাকে। কিন্তু মনুষ্যত্ব কি তাদের আছে? কখনো কখনো এই মানুষগুলো এত প্রভাবশালী যে সনজিতারা মুখ খুলে দাঁড়াতে পারে না। স্কুলে, কলেজে, মাদ্রাসায়, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভদ্রবেশী এই হিংস্র দানবেরা থাকে। এরাও কারও না কারও বাবা, কারও ভাই।

আমাদের আজকের সনজিতার বাড়ি রাজশাহী জেলার তানোর থানার শেষ সীমানায় চান্দুড়িয়া ইউনিয়নের জুড়ানপুর গ্রামে। সনজিতা স্থানীয় ডা. আবুবকর উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। দরিদ্রতা জয় করে স্কুলে মেধার স্বাক্ষর রেখেছিল। সনজিতার খাতার ওপর লেখা রোল নম্বর আট। গতবারের সমাপনী পরীক্ষায় সে ভালো করেছিল।

স্কুল থেকে এসে মায়ের সঙ্গে মুদি দোকানে সনজিতাকে বসতে হতো জীবন বাঁচানোর জন্য। তারপর পড়াশোনা। সনজিতা যেখানে আত্মহনন করেছে, তার পাশেই রয়েছে পড়ার টেবিল। মাটির দেয়ালে পড়ার রুটিন। কখন বাংলা পড়বে, কখন ইংরেজি পড়বে, কত সময় পড়বে—সবই লেখা রয়েছে।

দোকান শেষে মাটির এই ঘরটিতে মেয়েটি আর কখনো পড়তে বসবে না। তার পড়ার শব্দও কেউ শুনবে না। রুটিনের দিকেও কেউ তাকাবে না। সনজিতা এসবের ঊর্ধ্বে। ঘটনার দিন সকালে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সনজিতার চাচাকে ফোন করে সনজিতাকে স্কুলে যেতে বলেন।

গ্রীষ্মকালীন ছুটি। স্কুল বন্ধ। উপবৃত্তি দেওয়ার নাম করে সনজিতাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে যান প্রধান শিক্ষক। সঙ্গে সনজিতার ছোট ভাইটিও ছিল। কিন্তু ভাইকে প্রধান শিক্ষকের ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে আসার সময় ছোট ভাইয়ের কথার উত্তরে সনজিতা শুধু বলেছিল, স্বাক্ষর দিয়েছি। সনজিতাকে আর কখনো উপবৃত্তি নেওয়ার জন্য স্বাক্ষর দিতে হবে না। স্কুল বন্ধের সময়ও প্রধান শিক্ষকরূপী দানব বৃত্তি দেওয়ার নাম করে ডাকবে না। সনজিতার উপবৃত্তির প্রয়োজন নেই। সনজিতা আত্মবিসর্জন দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, সমাজের দায়িত্বশীল তথাকথিত মহান মানুষগুলো আসলে মানুষ নয়।

এরা হিংস্র, এরা জানোয়ার। এই জানোয়ারদের রুখবে কে? আসুন, আমরা অন্তত একবার এই জানোয়ারদের ঘৃণা করি। সনজিতার পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শুনলাম, কে যেন বলছে, এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাব কীভাবে? শিক্ষক সমাজের দায়িত্বশীল অংশ। শিক্ষকের চরিত্র যদি ডা. আবুবকর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মতো হয়, তাহলে আমরা দাঁড়াব কোথায়? সত্যিই, আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা ছোট হয়ে আসছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এ কথা শোনার পর সনজিতার বাড়ি থেকে পালিয়ে না এসে উপায় ছিল না।

আমরা একে একে পালাচ্ছি আর সনজিতারা আত্মহনন করছে। আমাদের শিক্ষার হার সরকারি হিসাবে ৫৩ শতাংশ। প্রকৃত শিক্ষার হার আরও কম। নারীশিক্ষার হার আরও কম। শিক্ষার হার বাড়ানোর চেষ্টার অন্ত নেই।

কিন্তু ডা. আবুবকর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে বাবা-মা কি মেয়েদের পাঠাবেন? স্কুলে গেলে যদি মেয়ে আত্মহনন করে? মেয়েদের স্কুলে না পাঠালে শিক্ষার হার বাড়বে না। সনজিতা আত্মহনন করে ডা. আবুবকর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের চরিত্র উন্মোচন করেছে। শিক্ষাঙ্গনে ও সমাজে আরও বহু দুর্বৃত্ত আছে। তাঁদের চরিত্র উন্মোচন করবে কে? মানিক আনিসুজ্জামান: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.