জনবল সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না বাংলাদেশ পুলিশ। মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোর চাহিদা মেটাতে গিয়ে জেলা শহরগুলোয় দিন দিন পুলিশের জনবল সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। জেলা পর্যায়ে কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী বা ধর্মীয় উগ্রপন্থী রাজনৈতিক দল পরিকল্পিতভাবে অরাজকতা সৃষ্টি করলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে। অনেক সময় এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পাশের জেলা থেকে জরুরিভাবে পুলিশ ডেকে আনা হয়। ততক্ষণে যা ঘটার তা কিন্তু ঘটে যায়।
পুলিশের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- গত বছর গাইবান্ধা, বগুড়া, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সাতকানিয়া, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে নাশকতা ও সহিংস ঘটনা ঘটানো হয়। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে জেলা পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেক সময় পাশের জেলা থেকে পুলিশ চেয়েও পাওয়া যায়নি। ওই সময় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে পুলিশের ১৭ জন সদস্যের জীবন গেছে। গুরুতর আহত হয়েছেন ৪০০ এবং সাধারণভাবে আহত হয়েছেন ২ হাজার ৮০০ পুলিশ।
পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ হবে যদি পুলিশবাহিনীতে নতুন করে আরও ৫০ হাজার সদস্য নিয়োগ দেওয়া যায়। তাই সম্প্রতি শেষ হওয়া পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে কর্মকর্তারা ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগের দাবি তোলেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী পুলিশবাহিনীতে নতুন লোক নিয়োগের বিষয়ে মৌখিকভাবে সম্মতি জানিয়েছেন বলে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, বর্তমানে পুলিশে ১ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি সদস্য থাকলেও ভিআইপিদের নিরাপত্তাসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবিলায় বড় একটি অংশ ব্যস্ত থাকছে। এর বাইরে নতুন-নতুন ইউনিট গঠনের কারণে 'অপারেশনাল' পুলিশের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
ফলে পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে দিনদুপুরেই ঘটছে হত্যা, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, পুলিশে জনবল সংকটের কারণে মামলার তদন্ত কার্যক্রমও বিঘি্নত হচ্ছে চরমভাবে। সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রতি মাসে গড়ে ১৫-১৬টি মামলার তদন্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে সুষ্ঠু তদন্ত নিয়েও শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশে পুলিশের সংখ্যা অনেক কম।
সীমিত এ পুলিশ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার পুলিশে জনবল বৃদ্ধিতে অত্যন্ত আন্তরিক। বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে জনসংখ্যা ও পুলিশের আনুপাতিক ফারাক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র বলেছে, মহাজোট সরকার গত পাঁচ বছরে ৩০ হাজার ৪৭৪ জন পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেয়।
দেশের বর্তমান প্রায় ১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশের এ সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ কাজ করে। আর বাংলাদেশে ১ হাজার ১৭০ জনের বিপরীতে বর্তমানে একজন পুলিশ কাজ করছে। দেশে যে হারে অপরাধ বাড়ছে স্বাধীনতার পর সে হারে পুলিশে জনবল বাড়ানো হয়নি। পুলিশের জীবনযাত্রার ব্যয়, কর্তব্য পরিধি, ঝুঁকি বিবেচনায় বেতন-ভাতা ও আবাসন সমস্যার সমাধানে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন।
তবে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশের আধুনিকায়নসহ জনবল সংকট এবং বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশে ১ লাখ ৫৪ হাজার জনবল থাকলেও ছয়টি মেট্রোপলিটন এলাকায় ৯০ হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করছে। বাকি ৫৭ হাজার পুলিশ সদস্য সারা দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। এত অল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছে পুলিশ সদর দফতর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৭৫ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন, পাকিস্তানে ৩১৩ জনের বিপরীতে একজন, নেপালে ২১৭ জনের বিপরীতে একজন, ভুটানে ১১৩ জনের বিপরীতে একজন, মালয়েশিয়ায় ২৪৯ জনের বিপরীতে একজন, জাপানে ১৪৩ জনের বিপরীতে একজন, আমেরিকায় ২১৫ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে।
অথচ আমাদের দেশে ১ হাজার ১৭০ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ভিআইপিদের প্রটোকলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবিলায় পুলিশের বড় একটি অংশকে ব্যস্ত থাকতে হয়। সূত্রগুলো বলেছে, রাজধানীর থানাগুলোয় প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক মামলা ও সহস াধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। জনবল সংকটের কারণে একজন সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাকে প্রতি মাসে ১৫-১৬টি মামলার বাইরে ২৫-৩০টি জিডির তদন্তের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর ফলে তদন্তের মান নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জনবল সংকটের কারণে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।