ভবনটির ছাদে হেলিপ্যাড বা হেলিকপ্টার নামার জায়গা আছে, জানালা দিয়ে তাকালে বা বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায় আভিলা পর্বতমালার নয়নাভিরাম দৃশ্য। একটু নিচের দিকে চারদিকে কারাকাস নগরের সারি সারি বাক্স-বাড়ি, উঁচু উঁচু দালানকোঠার ছাদ। ভেনেজুয়েলার রাজধানীর প্রায় কেন্দ্রস্থলে ৪৫ তলার এই সুউচ্চ অট্টালিকা কোনো পাঁচ তারকা হোটেল বা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট নয়। এ আকাশ-বাড়ি আদতে এখন একটা বস্তি! সম্ভবত বিশ্বের উচ্চতম বস্তি! বার্তা সংস্থা রয়টার্স সম্প্রতি ভবনটি সম্পর্কে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
‘টাওয়ার অব ডেভিড’ বা ‘ডেভিডের টাওয়ার’ হিসেবে খ্যাত ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল কারাকাসের একটা অত্যাধুনিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে।
কিন্তু ১৯৯৪ সালে ভবনটির ডেভেলপার-বিনিয়োগকারী ঘোড়া ব্যবসায়ী ডেভিড ব্রিলেমবুর্গের মৃত্যুতে অসমাপ্ত থেকে যায় শেষ পর্যায়ের নির্মাণকাজ। সে সময় ভেনেজুয়েলার ব্যাংকিং খাতের মন্দায় ভবনটির ভাগ্যে জোটেনি অন্য কোনো আর্থিক উদ্যোগও। তবে, ডেভিডের মৃত্যু ভাগ্য খুলে দিয়েছিল কারাকাসের হাজারো হত-দরিদ্র মানুষের।
২০০৭ সালে কারাকাসের দারিদ্র্যপীড়িত পূঁতি-গন্ধময় বস্তি এলাকা থেকে শত শত মানুষ এসে দখল নেয় এই বিশাল কংক্রিটের কঙ্কালটির। অসমাপ্ত বাণিজ্য কেন্দ্রটি হয়ে উঠতে থাকে হতদরিদ্র মানুষের নতুন আশ্রয়স্থল।
কিছুদিনের মধ্যেই ৪৫ তলা ভবনটির সবগুলো তলাই ভরে ওঠে মানুষে। কয়েক শ পরিবার বাস করতে শুরু করে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে। পাশাপাশি ভবনের ভেতরেই বসতে শুরু করে হাট-বাজার, দোকানপাট। প্রয়াত নেতা হুগো চাভেজের নেতৃত্বাধীন ভেনেজুয়েলার তত্কালীন সমাজতান্ত্রিক সরকার ‘চোখ বুজে থেকে’ ডেভিডের টাওয়ারে দরিদ্র মানুষদের আবাসন গড়তে সহায়তা করেছিল। এখন প্রায় তিন হাজার মানুষ এ ভবনটিকেই তাঁদের বাড়ি বলে ডাকেন।
জবরদখল না অধিকার প্রতিষ্ঠা
কারাকাসের অনেক নাগরিকই ডেভিডের টাওয়ারের পরিণতিকে সম্পত্তির প্রতি ‘চরম অশ্রদ্ধার’ দৃষ্টান্ত বলতে চান। তাঁরা এখন এ ভবনটিকে ‘চোর-বাটপারের’ আখড়া হিসেবেও ডেকে থাকে। কিন্তু ভবনটির বাসিন্দারা বলছেন, কারাকাসের অপরাধে জর্জরিত বস্তির জীবন থেকে তাঁদের বাঁচিয়ে দিয়েছে এই ডেভিডের টাওয়ার। এখন তাঁরা আগের চেয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারছেন।
স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা জানিয়েছেন, কারাকাসে এক দশক ধরে চলা বিভিন্ন ভবনের এমন ‘জবর-দখল’ এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে।
অনেক সময়ই এসব ‘দখল-বাজি’ চলত চাভেজের নিজস্ব-ধারার বিপ্লবের সমর্থকদের ব্যানারেই। তবে, এসব কাজের মধ্যে দৃশ্যমান শৃঙ্খলার বিষয়টিকে অস্বীকার করতে পারবেন না কেউ। নিয়ম ভঙ্গ করলে সাজা হিসেবে নেতাদের বেঁধে দেওয়া ‘সমাজকর্ম’ করতে হবে বাসিন্দাদের। কারাকাসের এমন এলাকাগুলোতে দেখা মিলবে ‘নীতি ও নৈতিকতা ছাড়া সবকিছুই অযৌক্তিক’-এর মতো বাণী লেখা পোস্টারেরও।
নগরের অভিজাত এলাকার মানুষেরা একে সম্পত্তির জবর-দখল হিসেবে দেখলেও বাসিন্দারা মনে করেন এটা পতিত সম্পত্তিতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হিসেবে।
বাসিন্দারা বলেন, ‘আমরা তো কাউকে উত্খাত করিনি। একটা ফাঁকা পড়ে থাকা জায়গা, একটা পতিত সম্পত্তি নিজেদের মতো ব্যবহার করছি মাত্র। ’
এখন নিজেদের মতো একটা ‘ছোট্ট সরকার’ গঠন করেই এই ডেভিডের টাওয়ার পরিচালনা করে থাকেন বাসিন্দারা। ৪৫ তলা ভবনটির ২৮ তলা পর্যন্ত ভবনের বেশির ভাগ কাজই শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী তলাগুলোতে অনেক কিছুই করে নিতে হয়েছে বর্তমান বাসিন্দাদের। পানি, বিদ্যুতের সরবরাহব্যবস্থাটাও গড়ে নিতে হয়েছে নিজেদেরই।
প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে মাসে ৩২ ডলার করে নিয়ে একটা যৌথ তহবিল থেকে চালানো হয় ভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা।
গরিবদের আকাশ-বাড়ি না অপরাধের আখড়া
বাসিন্দাদের কাছে আকাশে স্বর্গ গড়ার স্বপ্নের মতোই মনে হয় তাঁদের এই নতুন আকাশ-বাড়িকে। কিন্তু নগরের অভিজাতদের মতোই আশপাশের নগরবাসীরাও বলে আসছেন, এটা অপরাধ জগতের একটা আখড়া। এর আশপাশের এলাকায় প্রায়ই ছোটখাটো চুরি, মাদকের ব্যবসা, ব্যাংকের এটিএম বুথে অস্ত্র ঠেকিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়া এবং কিছু ডাকাতির ঘটনাও ঘটে। স্থানীয় পুলিশ বেশ কয়েকবার নানান অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডেভিডের টাওয়ারে অভিযানও চালিয়েছে।
বাসিন্দারাও স্বীকার করেন, এই ভবনকে ঘিরে নানান অপরাধের কিছু সমস্যাও আছে। তবে, বাসিন্দাদের দাবি, গত ১৮ মাসে স্থানীয় নতুন নেতৃত্ব সেসব সমাধানের চেষ্টা করেছেন। ৬৩ বছর বয়সী লুইস রাউল পিন্টো বলেন, ‘সবাইই ভাবে, এখানে চোর-বাটপারের বসবাস। কিন্তু আমরা জবর-দখলকারী না, আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় বসত গেড়েছি মাত্র। ’ সাবেক সরকারি চাকুরে পিন্টো এখন ট্যাক্সি চালান।
চার বছর আগে এখানে উঠে প্রথমে তিনি একটা হ্যামক বা ঝোলানো দোলনায় ঘুমাতেন। এখন থাকেন ২৮ তলার একটা ফ্ল্যাটে।
পিন্টো বলেন, ‘কখনো কখনো আমার ট্যাক্সিতে বসে এই টাওয়ারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় যাত্রীরা একে অপরকে বলেন, দেখো দেখো, ওই বাটপারগুলোর দিকে দেখো। ওদের নামিয়ে দেওয়ার সময় আমি জানাই, আমিও ডেভিডের টাওয়ারেই থাকি এবং আমি বাটপার নই। একদিন এসে আমার ওখানে কফি খেয়ে যেয়ো।
’
‘অমর কমান্ডার’ চাভেজের কিংবদন্তি
ডেভিডের টাওয়ার সম্পর্কে আবেগ এবং রোমান্টিক উচ্ছ্বাসের ফলে অনেক সময়ই এ ভবনের সঙ্গে বা এমন পরিত্যক্ত ভবন জবর-দখলের সঙ্গে কোনো না-কোনোভাবে জড়িয়ে থাকা অপরাধ প্রবণতাকে খাটো করে দেখা হয়। ভেনেজুয়েলায় এ ধরনের ‘দখল-বাজি’ চাভেজের শাসনামলের অনেক আগে থেকেই চলে এলেও তাঁর আমলে এর বিস্তার ঘটেছে। আর এসব ঘটনায় চাভেজের নীরব সমর্থন এবং কখনো কখনো তাঁর সক্রিয় উপস্থিতির কারণে বিষয়টিকে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থনপুষ্ট বলেও মনে করা হয়।
ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত বছর মারা যাওয়া হুগো চাভেজ বেশ কয়েকবারই দেখা করেছিলেন, দরদ নিয়ে কথা বলেছিলেন ডেভিড টাওয়ারে আকাশ-বাড়ি বানানো হতদরিদ্রদের সঙ্গে। ফলে এই ‘জবর-দখলের’ সংস্কৃতিকে শাভেজের আবাসন নীতির একটা বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও সমালোচনা করেন অনেকেই।
আর ডেভিডের টাওয়ারে বসতি গড়া গরিব মানুষেরা নিজেদের ‘চাভিস্তা’ বা চাভেজের অনুসারী হিসেবেই পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন।
‘অমর কমান্ডার’ লেখা চাভেজের পোস্টার ডেভিড টাওয়ারের অনেক দেয়ালেই শোভা পায়। অনেক বাসিন্দার ঘরের দেয়ালে বা বিছানার কাছে রাখা আছে চাভেজের ছবি। ৩৮ বছর বয়সী আলোকচিত্রী-চলচ্চিত্র নির্মাতা নিকোলাস আলভারেজ বলেন, ‘চাভেজের কিংবদন্তি প্রতিফলিত হয়েছে এই টাওয়ারের বাসিন্দাদের মূল্যবোধে’। প্রথমে একটা আলোকচিত্র প্রশিক্ষণ কর্মশালা করাতে এখানে এসেছিলেন আলভারেজ।
বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে আবাসন-সংকটে পড়ে তিনি নিজেও এসে বাসিন্দা হন এই টাওয়ারের। তিনি মনে করেন, চাভেজ যা করেছেন তা হলো—সবার মধ্যে এই বোধ গড়ে দেওয়া যে, আমাদের সবারই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।