গোপনে মানুষের ওপর ওষুধের পরীক্ষাঃ
'গিনিপিগ' বানানো হচ্ছে গরিবদের!
--------------------------------------------------------------
ভারতের মধ্য প্রদেশের প্রৌঢ়া চন্দ্রকলা বাঈ। জাতপাতের হিসাবে সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ তিনি। ২০০৯ সালের মে মাসে বুকে ব্যথা অনুভব করলে পুত্রবধূ নিতু সোদে তাঁকে নিয়ে ইন্দোর শহরের মহারাজা যশোবন্তরাও হাসপাতালে যান। কিন্তু হাসপাতালে তাঁরা যে অভ্যর্থনা পান, তাতে নিতু অবাক হয়ে যান। এত দিন যেখানে তাঁদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হতো, এবার তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনাই জানানো হলো।
নিতু পরে জানতে পারেন উষ্ণ অভ্যর্থনার কারণ। তাঁর শাশুড়ির ওপর গোপনে বিদেশি এক কম্পানির ওষুধের কার্যকারিতার পরীক্ষা চালানোর জন্যই তাঁদের এমন সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। ওষুধটির নাম টোনাপোফিলিন, যুক্তরাজ্যের বায়োজেন আইডেক কম্পানির তৈরি। গবেষণা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এসেছে আজকের অগ্রগতি। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী গিনিপিগের ওপর পরীক্ষায়ই আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন নতুন ওষুধ।
এরপর তা মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়। সে ক্ষেত্রে কোনো জাতপাত দেখা হয় না, রোগীই মূল। কিন্তু ভারতে এভাবে বেছে বেছে গরিব মানুষের ওপর নতুন নতুন ওষুধের কার্যকারিতার পরীক্ষা চালানো হয়।
নিতু বলেন, 'আমরা অবাক হয়ে যাই। আমরা দলিত শ্রেণীর মানুষ।
হাসপাতালে সাধারণত আমাদের পাঁচ রুপির একটি রসিদ দেওয়া হয়। কিন্তু সেদিন চিকিৎসক জানালেন, আমাদের এক লাখ ২৫ হাজার রুপি দামের বিদেশি ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া হবে। '
শুধু চন্দ্রকলাই নন, ভারতে তাঁর মতো হাজারো দরিদ্র নিরক্ষর লোকের ওপর গোপনে চালানো হচ্ছে বিদেশি ওষুধের কার্যকারিতার পরীক্ষা। এই ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বহু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় আইন অনুযায়ী অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও এসব ক্ষেত্রে তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দরিদ্র নিরক্ষর লোকদের কিভাবে 'গিনিপিগের' মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশি বহুজাতিক কম্পানিগুলোর এ কাজে সহায়তা করছেন ভারতের দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু চিকিৎসক ও কর্মকর্তা। হাসপাতালগুলোয় মৃতের ময়নাতদন্তের কোনো প্রতিবেদন রাখা হয় না বলে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণও দাঁড় করানো যায় না।
চন্দ্রকলাকে হাসপাতাল থেকে যে ওষুধটি দেওয়া হয়, সেটি সেবনের পর তাঁর হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিকতা অসম্ভব রকম বেড়ে যায়। কয়েক দিন পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর এক মাস পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে (হার্ট অ্যাটাক) মারা যান ৪৫ বছর বয়সী চন্দ্রকলা। বায়োজেনের ওই ওষুধের প্রভাবে ইন্দোরে অনেকে মারা গেছে। কিন্তু কম্পানিটি কখনোই এর দায় স্বীকার করেনি।
বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ভারতে গোপনে ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সমালোচনা হলেও বিভিন্ন কম্পানি ও তাদের নিয়োজিত অসাধু চিকিৎসকদের তৎপরতা মোটেও কমেনি। দেশটিতে এসব ঘটনার তদন্তের দাবি জোরালো হয়ে উঠছে।
ইন্দোরে চন্দ্রকলার মতো নারায়ণ সুরভায়া নামের আরেকজন অন্য একটি কম্পানির ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার শিকার হন। সুরভায়া জানান, মায়ের পায়ের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে যান তিনি। তাঁদেরও একইভাবে বিনা মূল্যে বিদেশি ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই চিকিৎসা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ পর তাঁর মা মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তাঁর মায়ের স্বাস্থ্যের এত ব্যাপক অবনতি ঘটে যে তিনি হাঁটতে পারছিলেন না।
সুরভায়া বলেন, 'মায়ের সমস্যার কথা চিকিৎসককে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি বলেছেন, ওষুধ যেন বন্ধ না করি। এটা সাময়িক পক্ষাঘাতগ্রস্ততা এবং তিনি সেরে উঠবেন। '
বিবিসি জানায়, ওই হাসপাতালে ৫৩ জন রোগীর ওপর ব্রিটিশ ও জার্মান কম্পানির তৈরি ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়েছিল। ওই সব ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় তাদের আটজন মারা গেছে, অভিযোগ উঠলেও কখনোই এর তদন্ত করা হয়নি।
আর লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়নি বলে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণও দাঁড় করানো যায়নি কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মহারাজা যশোবন্তরাও হাসপাতালে গত সাত বছরে তিন হাজার ৩০০ লোকের ওপর ৭৩টি ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৮৩৩টি শিশু রয়েছে। ওষুধ সেবনকালেও কয়েক ডজন রোগী মারা যায়।
হাসপাতালের দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০৫ সালের পর সেখানে ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার অন্তত ৮০টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়।
এরই একটি ঘটেছে নরেশ জাতেভ নামের এক শিশুর জীবনে। নরেশের বয়স এখন চার বছর। তার বাবা আশীষ জাদব জানান, নরেশের বয়স যখন তিন দিন তখন হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে পোলিও ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলেন। তাঁদেরও বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের সম্মতি আদায়ের জন্য যে কাগজটি ধরিয়ে দেয়, সেটা ইংরেজিতে লেখা ছিল বলে কিছুই বুঝতে পারেননি তাঁরা।
আশীষ বলেন, 'ফরমটি ইংরেজিতে লেখা ছিল। তাই এর এক বর্ণও বুঝতে পারিনি। ' নরেশ বেঁচে গেলেও এখন স্থায়ী শ্বাসকষ্টে ভুগছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতে ২০০৫ সালে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার বা গবেষণার বিধিবিধান অনেকটা শিথিল করা হয়। এর পর থেকেই বিদেশি ওষুধ কম্পানিগুলো এর সুবিধা নিতে উঠেপড়ে লাগে।
তারা দেশটির ইংরেজি শিক্ষিত চিকিৎসকদের হাত করে ভারতকে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়।
গত সাত বছরে দেশটির লোকজনের ওপর দুই হাজার ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয়। এসব ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মৃতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ২০০৮ সালে মৃতের সংখ্যা ২৮৮ জন থেকে ২০০৯ সালে ৬৩৭ জনে দাঁড়ায়। ২০১০ সালে মারা যায় ৬৬৮ জন।
তবে ২০১১ সালে মারা যায় কিছুটা কম ৪৩৮ জন।
বিদেশি ওষুধের পরীক্ষার শিকার ভূপালের রামাধর শ্রীবাস্তব এসব কম্পানির প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, 'দয়া করে এসব পরীক্ষা গরিবদের ওপর করবেন না। ধনী লোকেরা তাদের সমস্যা সহজেই উতরাতে পারে। কিন্তু আমি যদি কাজ করতে না পারি, তবে পুরো পরিবারকেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কেন তারা আমাদের বেছে নিচ্ছে? তাদের উচিত নিজেদের পরীক্ষা নিজেদের লোকদের ওপরই চালানো।
' সূত্র : বিবিসি।
[ কালের কন্ঠ / ৩ নবেম্বর ২০১২ ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।