আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাহোর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাত্তর বাংলার রাজনীতি

লাহোর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাত্তর বাংলার রাজনীতি
মোহাম্মদ নজরুর ইসলাম
(সাবেক প্রভাষক, জাপিব কলেজ ও তথ্য সরবরাহকারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস)
এক
1940 সালে 23শে মার্চ বিকেল 3টা 45 মিনিটে ‘ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক রুপ রেখা’ প্রনয়নের লক্ষ্যে বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিমলীগের এক অধিবেশনে বাংলার কৃতিসন্তান শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একটি প্রস্তাব উপষ্থাপন করেন যা ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত’। এই প্রস্তাবে বলা হয়;
প্রথমত: নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুণ:ঘোষণা করছে যে,1935 সালের ভারত শাসন আইনে যে, যুক্তরাষ্ট্রের (Federal) পরিকল্পনা রয়েছে, তা এ দেশের উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষিতে অসঙ্গত ও অকার্যকর বিধায় তা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অগ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয়ত: সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করা হলে মুসলিম ভারত অসন্তুষ্ট হবে এবং মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধান রচিত হলে কোন সংশোধিত পরিকল্পনা ও তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।
তৃতীয়ত: নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সুচিন্তিত অভিমত এরূপ যে, ভারতে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না যদি তা নিম্নবর্ণিত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত না হয়: (ক) ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে 'অঞ্চল' হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, (খ) প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্ত করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ'(Independent States) গঠন করতে পারে, (গ) 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের' সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম।
চতুর্থত: এ সমস্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়,সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক,প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানের কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে।

ভারতবর্ষের মুসলমান জনগণ যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথেও আলোচনা সাপেক্ষে সংবিধানে কার্যকর বিধান রাখতে হবে।
এই প্রস্তাবের তৃতীয় ধারার ক ও খ উপধারায় বলা হয়েছিল ‘ভৌগলিক দিক থেকে পরস্পর সংলগ্ন ভারতবর্ষের উত্তর (আসাম)-পম্চিম (পশ্চিম পাকিস্তান)এবং পূর্ঞ্চলের (পূব বাংলা) মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে প্রয়োজনবোধে সীমানা রদবদল করে এমন ভাবে গঠন করা হবে যাতে ওই এলাকাগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ (ইনডিপেনন্ডেট ষ্টেট) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগঠনকারী ঐ সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো স্বশাসিত এবং সার্বভৌম থাকবে’ যা ছিল যুগযুগান্তকারী একটি পরিকল্পনা। লাহোর প্রস্তাব গৃহিত হবার পর থেকেই মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলমানদের হিস্যা নিয়ে দরকষাকষি করেন।
দুই
১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি বরাবরই ভারতকে স্বাধীনতা দানের পক্ষপাতী ছিলেন ১৯৪৬ সালে নৌ-বিদ্রোহের অগ্রগতি লক্ষ্য করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ভারতের রাজনৈতিক সংকট মোচনের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ নেন ।

তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে মার্চ তিন সদস্য বিশিষ্ট ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একটি প্রতিনিধি দলকে ভারতে পাঠান । এটি ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন নামে পরিচিত। এই দলে ছিলেন স্যার পেথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং এ.ডি. আলেকজান্ডার । ক্যাবিনেট মিশনের রিপোর্টে যে সব সুপারিশের কথা বলা হয় তাহল-
(১) ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে এবং ক্ষমতা বন্টন নীতি গৃহিত হবে ।
(২) ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশগুলি ‘ক’, মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলি ‘খ’ এবং বাংলা ও আসাম প্রদেশকে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত করা হবে ।


(৩) এই প্রদেশগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে ।
(৪) সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠন ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন হবে । (৫) কোনো প্রদেশ ইচ্ছা করলে নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে ।
(৬) এ ছাড়া নতুন সংবিধান রচনা না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল সমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে ।
ক্যাবিনেট মিশন তাঁদের পরিকল্পনায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে এক ঐক্যবদ্ধ ‘ভারত’ গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন।

এছাড়া ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় রাজন্যবর্গকে তাঁদের ভাগ্য নির্ধারণেরও সুযোগ দিয়েছিলেন । মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা লক্ষ্য করে মুসলিমগণ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন । কিন্তু অন্য সব বিষয়ে সম্মতি থাকলেও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রদেশগুলির শ্রেণীবিভাগ ও চিহ্নিত করণ কংগ্রেসের মনঃপুত হয়নি। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে অন্তবর্তী সরকার ও সংবিধান সভাকে যথাসম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলে কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে । ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় নেতৃবর্গের হাতে ব্রিটিশ ভারতের শাসনভার তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে।

এই প্রস্তাবে একটি নতুন ভারত অধিরাজ্য ও তার সরকার গঠনেরও প্রস্তাব জানানো হয়। এর অব্যবহিত পরে, একটি বিকল্প প্রস্তাবে হিন্দুপ্রধান ভারত ও মুসলমানপ্রধান পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কংগ্রেস বিকল্প প্রস্তাবটি সম্পূর্ণত প্রত্যাখ্যান করে।
তিন
এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে এবং একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট একটি সাধারণ ধর্মঘটের (হরতাল) ডাক দেয়। এই প্রতিবাদ আন্দোলন থেকেই কলকাতায় এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম হয়।

মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শহরে চার হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান ও এক লক্ষ বাসিন্দা গৃহহারা হন। কলকাতার দেখাদেখি দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী, বিহার, যুক্তপ্রদেশ (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) পাঞ্জাব, ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও। তবে সর্বাপেক্ষা ভীতিপ্রদ দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল কলকাতা ও নোয়াখালীতে (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে)। এই ঘটনাই ভারত বিভাগের বীজ বপন করে। এহেন পরিস্থিতিতে দ্বি-জাতিতত্বের বিত্তিতে 1946 সালের দিল্লি অধিবেশনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ লাহোব প্রস্তাবের গুরুত্ব উপলব্ধি করে কৌশলে ‘একক পাকিস্তান’ প্রস্তাব পাশ করে নেন।

ইতিপূর্বে পাঞ্জাবী মুসলিম লীগ নেতাদের ষড়যন্তে 1941 সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। ফলে পূর্বাঞ্চলের প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও পূর্ববাংলার মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদক আবুল হাশিম মুসলিম লীগের এহেন আচারনে বীত শ্রদ্ধ হয়েছে পড়েন। 1946 সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও বাংলার জনপ্রিয় মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে যথাযোগ্য মর্যাদা না দিয়ে পাঞ্জাবী বংশবদনেতা খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করেন। ফলে পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য অনেকটাই পরিস্কার হতে থাকে। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং মিশনের পর বিট্রিশ প্রধান মন্ত্রী ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে আরও একধাপ এগিয়ে যায়।

ভারতীয়দের বিভিন্ন প্রকার স্বদেশী আন্দোলনের মুখে ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী বৃটিশ সরকার ঘোষনা করে যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটবে। এ সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য লর্ড ওয়াভেল এর স্থলে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনেকে ভারতের বড়লাট নিযুক্ত করে পাঠানো হলো। এ সময় নতুন করে পাঞ্চাবে এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে নতুন করে হাঙ্গামা শুরু হল। মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির দাবিতে অবিচল থাকল। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস দল অখন্ড ভারতের দাবি ত্যাগ করে ভারত বিভাগে রাজি হল।

কিন্তু তারা নতুন করে দাবি উত্থাপন করল যে, বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে হিন্দু ও মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা গরিষ্ঠ এলাকা অনুসারে দ্বিখন্ডিত করতে হবে। মুসলিম লীগ শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব মেনে নেয়। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। অবশেষে ভোটাভুটির ভিত্তিতেই ভারতীয় উপমহাদেশ বৃটিশ আধিপত্য থেকে মুক্তি লাভ করে এবং ভুতপূর্ব ব্রিটিশ ভারতের স্থলে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাজ্যের উদয় হয়। ১৯৪৭ সালের ১৬ জুলাই বিলাতের পার্লামেন্টে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা বিল উত্থাপিত হয় এবং ১৮ জুলাই ঐ বিল সর্বসম্মতি ক্রমে গ্রহিত হয়ে আইনে পরিণত হয়।

এই আইন অনুসারে স্থির হয় যে, ১৫ আগস্ট তারিখে ভারত বর্ষে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটবে এবং ভারতবর্ষ স্বাধীন রাজ্য বলে গণ্য হবে। ঐ আইন অনুসারে ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যরাতে বৃটিশ ভারত বিভক্ত হয়। পাকিস্তান ১৪ আগষ্ট এবং ভারত ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস রূপে গণ্য করে। জিন্নাই পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারতের গভর্ণর জেনারেল হন।


বাঙ্গালী মুসলমানেরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পম্চিমারা নানান অযুহাতে বাঙ্গালীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্ঠায় লিপ্ত হয়। একথা সত্য যে, কমিউনিষ্ট পার্টি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই রাষ্ট্রটিকে কৃত্রিম রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত করে। ‘ইয়া আজাদী ঝুটা যায়; লাখো বাঙ্গাল ভূয়া হ্যায়’ এই আওয়াজ তুলে এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে। কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন, টন্ক, নানাকার প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সাওঁতাল, হাজং আদিবাসী বিদ্রোহ, এবং সমাজতন্ত্র ও জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষকের আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে।

পাকিস্তান শাসকদের বিরোদ্ধে এটাই ছিল প্রথম বলিষ্ট বিদ্রোহ। (চলবে----)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।