ইংরেজ দার্শনিক, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পথপ্রদর্শক স্যার ফ্রান্সিস বেকন। তিনি একাধারে একজন ইংরেজ দার্শনিক, আইনজ্ঞ, কুটনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পথপ্রদর্শক। ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ এবং সম্রাট প্রথম জেমসের উপদেষ্টা আর বিতর্কিত অথচ অসাধারন এক ব্যাক্তিত্ব স্যার ফ্রান্সিস বেকন। ফ্রান্সিস বেকনকে অভিজ্ঞতাবাদের জনক বলা হয়। তিনি দার্শনিক চিন্তাধারায় মৌলিক কিছু তত্ত্ব প্রবর্তন করেন।
এগুলোকে বেকনিয়ান মেথডও বলা হয়ে থাকে। তিনি পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ওপর জোর দেন। কোন জিনিষের উৎস অনুসন্ধানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াগুলো তিনিই প্রবর্তন করেন। ধর্মীয় চিন্তায় ও সাহিত্যে তিনি জোর দিয়েছেন নীতিদর্শন ও ধর্মতাত্ত্বিক আনুধ্যানের ওপর। আইনের ক্ষেত্রে তিনি বড় ধরনের সংস্কারের চেষ্টা করেছেন।
আইনজীবি হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও তিনি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের প্রবক্তা এবং জ্ঞানান্ধতা ও গোঁড়ামি বিরোধী হিসেবে সুখ্যাত হন। রাণী এলিজাবেথের আমলে ইনি আইনজীবী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়া বেকন ছিলেন পার্লামেন্ট সদস্য। তবে রাণী এলিজাবেথের মৃত্যুর পরই ইনি গৌরবের শিখরে উপনীত হন এবং কতিপয় উচ্চপদ অলঙ্কৃত করার পর রাজা জেমস এর রাজত্বকালে ইনি লর্ড চ্যান্সেলারের পদে নিযুক্ত হন। রাজনীতিজ্ঞ এবং আইনজীবী হিসাবে কর্মবহুল জীবন যাপনের পরও তিনি সেকালে প্রচলিত বিজ্ঞান সংক্রান্ত ধ্যানধারণা পর্যালোচনা ও পুনর্বিন্যাসের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৬২৬ সালের আজকের দিনে মৃত্যুৃবরণ করেন এই দার্শনিক। আজ তার ৩৮৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ইংরেজ দার্শনিক স্যার ফ্রান্সিস বেকনের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon) ১৫৬১ সালেল ২২শে জানুয়ারি লন্ডনের কাছাকাছি মিডলসেক্সের ইয়র্ক হাউসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইংল্যান্ডের রাজসভায় উচ্চপদস্থ সভাসদ স্যার নিকোলাস বেকন এবং মাতা অ্যানে বেকন।
দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে শৈশবে তিনি ঘরেই পড়ালেখা করেন। ১৫৭৩ সালে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। তিনি মূলত ল্যাটিন ও মধ্যযুগের পাঠক্রম অনুসরণ করেন। কেমব্রিজে পড়াকালে তার সঙ্গে রানী এলিজাবেথের সাক্ষাৎ ঘটে। রানী তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে লর্ড উপাধির যোগ্য বলে মন্তব্য করেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি আইন নিয়ে পড়েন। ফ্রান্সিস বেকন ১৫৮২ সালে আইনবিদ্যায় শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং ১৫৮৪ সালেপার্লামেন্টে আসন পান। কিন্তু স্যার নিকোলাসের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাননি যদিও তিনি বেশ অমিতব্যায়ী ছিলেন। এর ফলে চিরকালই তাঁকে টাকা পয়সার অভাবে ভুগতে হয়েছে। পার্লামেন্টের প্রবেশে অল্প দিনের মধ্যে তিনি রানির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সভাসদ আর্ল অফ এসেক্সের সহযোগি ও বন্ধু হয়ে ওঠেন।
১৬০১ সালে আর্ল রানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং বিচারে আর্লের প্রানদন্ড হয়। বেকন তাঁর বন্ধুর বিচারে তার বিপক্ষে এবং এই শাস্তি হওয়ার পক্ষে কাজ করেছিলেন। এটাকে হয়ত সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতার থেকেও অসম্মানজনক কিছু বলা উচিৎ। এই ঘটনার কালো ছায়া বেকনের উপর চিরকাল ছিল ও থাকবে। তিনি সম্ভবত বন্ধুত্বের থেকে রাজ আনুগত্যকে বেশি বড় মনে করেছিলেন।
যাই মনে করে থাকুন, এই অমানবিকতার জন্য ইতিহাস তাঁকে ক্ষমা করেনি ও করবেওনা। তাঁর সময়ে ও তার পরে বহু প্রশংসা, অতি প্রশংসা ও নিন্দার লক্ষ হয়েছেন তিনি।
এরপর বেকন সম্পূর্ণভাবেই মনন চিন্তন ও লেখালেখির মধ্যে আত্মনিয়োগ করেন এবং জ্ঞান ও বুদ্ধি নিয়ে চর্চা করতে করতেই তাঁর জীবনের শেষ দিনে পৌঁছান। ইংরেজি ভাষার প্রতি ফ্রান্সিস বেকনের বড় একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। কারণ, তিনি মনে করতেন, এ সমস্ত আধুনিক ভাষা একসময় উপযুক্ত গ্রন্থের অভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়বে।
তাই ল্যাটিন ছিল তার একমাত্র প্রিয় ভাষা। অথচ সেই ফ্রান্সিস বেকন ইংরেজি ভাষায় যে অবদান রেখেছেন, তা নি:সন্দেহে অবিস্মরণীয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ও সম্ভাবনার প্রবক্তা হিসেবে শ্রেষ্ঠদের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হয়। বেকনকে বলা হত Philosopher of utilities। ব্যবহারিক জগতের দার্শনিক, জাগতিক জ্ঞান ও বুদ্ধির আশ্চর্যজনক আকর তাঁর রচিত প্রবন্ধসমূহ, এত গল্প কথায় ব্যবহারিক চিন্তার এত দিক, এত দিগন্ত উন্মোদিত করেছেন তিনি, যে অবাক হতে হয়।
তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, শিক্ষা ও রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পঞ্চাশের অধিক বই লিখেছেন। তার বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ এসেইজ (১৫৯৭), দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব লার্নিং ডিভাইন অ্যান্ড হিউম্যান (১৬০৫), নাভাম অর্গানাম সায়েন্টিয়ারম (নিউ মেথড, ১৬২০) ও নিউ আটলান্টিস (১৬২৭)। ‘এসেস’ বইটির তিনটি সংস্করণ রয়েছে। এর মধ্যে নোভাম অর্গানাম বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন ফজলুল করিম।
বেকন তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘এসেইজ’ এর প্রবন্ধগুলো নিখুঁত অলঙ্কারে সুশোভিত করেছেন।
তার রচনাশৈলী নমনীয় এবং আধুনিক না হলেও বিশেষ ভাব প্রকাশে বলিষ্ঠতা ও অর্থব্যাঞ্জনার জন্য অতুলনীয়। তাঁর রচিত প্রবন্ধ সংগ্রহের তিনটি সংস্করণ বের হয়। ১৫৯৭ সালে প্রথমটিতে মাত্র ১০টি লেখা ছিল। দ্বিতীয়টির প্রকাশ হয় ১৬১২ সালে ৩৮টি রচনা নিয়ে। আর তৃতীয় ও শেষ সংস্করণে ৫৮টি লেখা ছিল।
তাঁর মৃত্যুর অল্প দিন আগেই তা শেষ হয়। ১৬০৫ খ্রীস্টাব্দে তাঁর ‘এডভ্যান্স মন্ট অব লানিং’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানসমূহের শ্রেণি-বিভাগ সংবলিত ‘দি গ্রেট ইনসিচুয়েশন’ মূল গ্রন্থের প্রথম খণ্ড হিসাবে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এর পনের বৎসর পর ১৬২১ সালে তাঁর মহতী গ্রন্থ ‘নোভাম অর্গানাম’ পরীক্ষামূলক প্রাকৃতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এক নয়া পদ্ধতির সূচনা করে। নোভাম অর্গানাম’-এর প্রথম খণ্ডটি বৈজ্ঞানিক দর্শনে তাঁর অবদানের প্রতিনিধিত্বমূলক রচনা।
বেকন ক্ষমতা অর রাজসম্মানের শিখর থেকে শিখরে পৌঁছেছিলেন। ১৬০৩ সালে তিনি নাইট উপাধি পান, ১৬১৮ সালে ব্যারন হন, ১৬২১ সালে সেন্ট আলবান-এর ভাইকাউন্ট উপাধি পান। এরই সঙ্গে তিনি সলসিটর জেনারেল, এ্যাটর্নি জেনারেল, লর্ড কীপার এবং পরে লর্ড চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। লর্ড চ্যান্সেলর ছিল বিচার বিভাগের সর্ব্বোচ্চ পদ, অনেকটা সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির মত। যেহেতু মৃত্যুর সময় তার কোন উত্তরশুরী ছিল না, তাই পরবর্তীতে তার উপাধিগুলো বিলীন হয়ে যায়।
এরপরই তাঁর পতন ও সম্মান হারানোর পালা। ১৬২১ সালে তাঁর মহতী গ্রন্থ প্রকাশিত হবার কিছুদিন পার রাজনৈতিক দুর্ভোগে বেকন জর্জরিত হয়ে পড়েন এবং তাঁর বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অভিযোগ সম্পর্কে বেকনের স্বীকৃতির পর থেকেই তাঁর পতন শুরু হয়। অবশ্য তাঁর স্বীকারক্তিতে তিনি বলেন যে উপঢৌকন নিলেও তার দ্বারা তাঁর সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়নি।
তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়নি কিন্তু রাজার সভাসদ হিসেবে তাঁর রাজনীতিকে জীবনের এখানেই ইতি টানতে হয় বলা যায়। লন্ডন টাওয়ারে তিনি কারাভোগ করতে থাকেন, এবং এছাড়াও তাঁকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তাঁর পার্লামেন্টের সদস্যপদ বাতিল করা হয় এবং ভবিষ্যতেও পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অধিকার হরণ করা হয়। কারাবাস শেষ হলে জীবনের বাকি দিনগুলোতে বেকন শুধুমাত্র গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। এই সময়ই তিন বিখ্যাত ‘এসেইজ’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন
ফ্রান্সিস বেকনকে অভিজ্ঞতাবাদের জনক বলা হয়।
তিনি দর্শনিক চিন্তাধারার কিছু মৌলিক তত্ব প্রবর্তন করেন যেগুলোকে বেকনিয়ান মেথডও বলা হয়ে থাকে। কোন জিনিষের উৎস অনুষন্ধানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াগুলো তিনিই প্রবর্তন করেন। এইসব প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বলা হয়। ফ্রান্সিস বেকন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, কুসংস্কার ও স্বতঃসিদ্ধের প্রতিবন্ধকতা থেকে মানুষের মনকে মুক্ত করা হলে মানুষ তার জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃতির উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হবে। বেন জনসন, যিনি বেকনকে জানতেন, তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন 'তার লেখার ও কাজকর্মের বিচার করলে আমার মনে হয় সে অকেন যুগের সবথেকে প্রশংসনীয় সেরা মানুষদের একজন।
' আবার আইজাক ওয়ালটন তার সম্বন্ধে বলেছেনঃ 'তিনি ছিলেন বিশ্ব প্রকৃতির একজন বিশ্বস্ত সহচর ও অনুলেখক। ' কিন্তু পরের শতকেই আলেকজান্ডার পোপের তীক্ষন কলম বোধহয় বেকন সম্বন্ধে শেষ কথা বলেছেনঃ
'মানুষের মন আর মননের গভীর অতল
কেমনে তা ছুঁতে হয় যদি নাই শিখে থাকো
চেয়ে দেখো, সামনে উদাহরন রয়েছেন
মেধাবী বেকন ।
সব থেকে জ্ঞানী আর উজ্জ্বল মানুষ একজন,
বিকীর্ণ করেছেন আলো,
যদিও সবার থেকে ছোট তার মন'
১৬২৬ সালের ৯ এপ্রিল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লন্ডনের বাইরে হেইগেট এলাকার অরুনডেল ম্যানশনে মৃত্যুবরণ করেন এই দার্শনিক। আজ এই বিতর্কিত অথচ অসাধারন ব্যাক্তিত্ব স্যার ফ্রান্সিস বেকনের ৩৮৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ইংরেজ দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পথপ্রদর্শক স্যার ফ্রান্সিস বেকনের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।