সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ সাংবাদিক, প্রথিতযশা কলামিস্ট এবিএম মূসা আর নেই। দেশের সাংবাদিকতার জীবন্ত কিংবদন্তি এবিএম মূসা গতকাল দুপুরে নগরীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। স্বনামখ্যাত এবিএম মূসার মৃত্যু সংবাদে সারা দেশে সাংবাদিক সমাজসহ সুধীমহলে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
আমৃত্যু পেশানিষ্ঠ বরেণ্য এই সাংবাদিকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। এ ছাড়া শোক প্রকাশ ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ ও অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান-সহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। এবিএম মূসা দীর্ঘ ৬০ বছর সক্রিয় সাংবাদিকতায় জড়িত থেকে সাংবাদিকদের অভিভাবকতুল্য 'মূসা ভাই' হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য এবিএম মূসা সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন। বর্ণাঢ্যময় সাংবাদিকতা জীবনে সর্বশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ২০০৪ সালে দৈনিক যুগান্তরে।
এরপর কোনো সংবাদমাধ্যমে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও বিভিন্ন দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে সত্যভাষণের জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন কিংবদন্তি কলমযোদ্ধা এবিএম মূসা। বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারের সঙ্গে এই নির্ভীক সাংবাদিকের ছিল আত্দিক সম্পর্ক।
গত সোমবার রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে এবিএম মূসাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেদিন মধ্যরাতে তাকে লাইফ সাপোর্টের আওতায় নেওয়া হয়। অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় গতকাল বেলা সোয়া ১টায় তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।
গতকাল দুপুরের পর হাপসপাতাল থেকে এবিএম মূসার মরদেহ তার মোহাম্মদপুরের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাদ মাগরিব মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড মাঠে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবিএম মূসার বাসায় যান। তিনি তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান। তিনি সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন।
এরপর রাতে এবিএম মূসার মরদেহ ল্যাবএইড হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। আজ বেলা ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত তার মরদেহ জাতীয় প্রেসক্লাবে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। সেখানে বাদ জোহর এবিএম মূসার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাকে গ্রামের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজী থানার কুতুবপুর গ্রামে দাফন করা হবে বলে পারিবারিকভাবে জানানো হয়েছে।
ল্যাবএইড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. বরেন চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবিএম মূসা।
প্রবীণ এ সাংবাদিককে ফেরাতে সব চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তার নেতৃত্বাধীন বিশেষ টিম। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গতকাল সোয়া ১টায় জীবনপ্রদীপ নিভে আসে দেশ ও জাতির বিবেকসম এবিএম মূসার। এর পরই তার লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। ডা. বরেন চক্রবর্তী জানান, এর আগেও এবিএম মূসা কয়েকবার লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থা কয়েক মাস ধরে ভালো যাচ্ছিল না।
সাত-আট মাস আগে তিনি ব্লাড ক্যান্সারের মতো রোগ মাইলো ডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম-এ আক্রান্ত হন। এতে অস্থিমজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে এবিএম মূসা স্ত্রী বিশিষ্ট লেখিকা সেতারা মূসা, এক ছেলে ডা. নাসিম মূসা ও এক মেয়ে সাংবাদিক পারভীন সুলতানা ঝুমা, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বাসায় শোকাহত মানুষের ঢল : এবিএম মূসার মরদেহ মোহাম্মদপুরের বাসায় নেওয়ার পর বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, সিনিয়র সাংবাদিক ও দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা তার বাসায় ছুটে যান।
তাদের মধ্যে ছিলেন- শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, মাহমুদুর রহমান মান্না, শিরিন আখতার এমপি, আবদুল্লাহ আল নোমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শামীমুর রহমান শামীম, প্রবীণ সাংবাদিক ইকবাল বাহার চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, মাহফুজ উল্লাহ, রুহুল আমিন গাজী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামালউদ্দিন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, যুগ্ম সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন প্রমুখ।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : ১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেনীর ফুলগাজী থানার কুতুবপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে সাংবাদিক এবিএম মূসার জন্ম। তিনি ৬০ বছরের বেশি সময় সক্রিয় সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি কলাম লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবেও তার সমান খ্যাতি ছিল। বিশিষ্ট এ সাংবাদিক জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে চারবার প্রেসক্লাবের সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এবিএম মূসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহধন্য ছিলেন। ১৯৭৩-এ দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নির্বাচন করে তিনি এমপি হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে হুমকির মুখে দেশ ছেড়ে চলে যান লন্ডনে। সেখানে যোগ দেন সানডে টাইমসের রিসার্চ ফেলো হিসেবে। ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে এসে দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭৮ সালে যোগ দেন জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচিতে। এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনুরোধে মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআইবি)। এখানে চার বছর কাজ করার পরে এমডি হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস)। এখান থেকে এরশাদ সরকারের চাপে অবসর নেন ১৯৮৮ সালে।
এর আগে ১৯৫০ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে দৈনিক ইনসাফ-এ কাজ করার মধ্য দিয়ে এবিএম মূসার সাংবাদিকতা শুরু।
পরে ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এ যোগ দেন তিনি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান অবজারভারে বার্তা সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এবিএম মূসা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিবিসি, সানডে টাইমসসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন করে এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর তিনি বিটিভির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৪ সালে তিনি কিছুদিন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কলম লেখা ছাড়াও তিনি টেলিভিশন টকশোতে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলে বেশ জনপ্রিয় হন। জীবনভর তিনি তার লেখায় ও বক্তব্যে গণমানুষের কথা বলে গেছেন। একজন সাংবাদিক হয়েও সর্বমহলে তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কুড়াতে সমর্থ হন।
দেশব্যাপী শোক : প্রথিতযশা এবিএম মূসার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে মরহুম এবিএম মূসা বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্দার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শোক বার্তায় বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাকে 'প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ'-এর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি সাংবাদিকদের শিক্ষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অন্যায়, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সবসময়ই সোচ্চার কণ্ঠ। সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শোকবার্তায় বলেন, এবিএম মূসা ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিক। তার মৃত্যুতে সংবাদ মাধ্যমের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, এবিএম মূসার মৃত্যুতে সাংবাদিক গগন থেকে একটি সূর্যের অন্তর্ধান হলো।
এ রকম সাহসী ও সৎ সাংবাদিক জগতে বিরল। শোক জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী, জাতীয় পার্টি-জেপি'র চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা, জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব লায়ন এম এ আউয়াল এমপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ, জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমির ফয়সল, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ সভাপতি এইচএম কামরুজ্জামান খান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হক ও মহাসচিব হাসরাত খান, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম বাচ্চু, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ জালালী পার্টি ও ফেনী প্রেসক্লাব।
ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ চেয়ারম্যানের শোক : বিশিষ্ট শিল্পপতি ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এক শোকবার্তায় বলেন, একজন সমাজ সচেতন স্পষ্টভাষী সাংবাদিক হিসেবে এবিএম মূসা যে অবদান রেখে গেছেন জাতি চিরদিন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্দার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।