ফেসবুকে কাজী রায়হান রাহীর সাথে বিখ্যাত ফারাবী শফিউর রহমানের একখন্ড কথোপকথন থেকে মনে হলো, কাজী রায়হান রাহী যেসব প্রশ্ন করেছেন, সবই যুক্তিসংগত এবং এটাকেই বলে মুক্ত বুদ্ধির চর্চা। তার উল্টো হলেই সেটা হবে অন্ধত্ব, গোঁড়ামী, অজ্ঞতাকে ঢেকে দেয়া। আর কতদিন এভাবে ধর্মকে প্রশ্ন না করে আন-চ্যালেজ্ঞ যেতে দেবেন? যুগ যত আগাবে সত্য-মিথ্যার প্রশ্নতে প্রতিটা ধর্মই কষ্টিপাথরে বাছাই করার প্রয়োজন হয়ে পড়বে। আসলে কোনটা সত্য ধর্ম, তা মানুষকেই বুঝে নিতে হবে সত্যানুসন্ধানীর মত। ইসলাম যদি সত্য ধর্ম হয়, তবে আপনাদের মানুষের সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে।
শুধু নবীজির স্ত্রীদের সম্পর্কে অশ্লীল কথা বলা হচ্ছে বলে আপনাদের এমন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে ও তার বহুল প্রচার করতে ব্যর্থ হবেন।
মানুষের স্বভাবই হলো দুনিয়ার তাবৎ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা এবং তার ভেতরের সত্যকে উন্মোচন করা। নবী করিম, ধর্ম বা তার স্ত্রীদের অপমানের অপবাদ দিয়ে আপনার ধর্মকে এভাবে হেফাজত বা রক্ষা করা আপনাদের জন্য আদৌ সম্ভব হবে না। আর তাই মুক্তবুদ্ধির চর্চাই আবশ্যক, কলমের উত্তর কলমেই দিতে হবে। গায়ের জোরে নয়।
আমার নবী রাসুলের স্ত্রী সম্পর্কে এমন প্রশ্ন করেছে, এটা সহ্য করবো না, তাহলো পুরোপরি ধর্মীয় উন্মাদনা। এই ধর্মীয় উন্মাদনাই ইসলাম তথা অন্য ধর্মগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করেছে, মানুষের মাঝে উগ্র ধর্ম-উন্মাদনা আমাদের মাঝে শান্তি নষ্ট করে একটা ধর্মকে জঙ্গী করে তুলেছে। শান্তির ধর্মের আদর্শ বিবর্জিত হয়ে শান্তির ধর্মের তথাকথিত অন্ধ-উন্মাদ ধারকরা পৃথিবীর শান্তি বিনষ্ট করছে।
আরেকটা কথা নবীনদের মনে সব সময় নবীন নবীন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। একজন মুক্তমনের মানুষ সব সময়ই সব কিছুকে প্রশ্ন করে এগিয়ে যাবে, যেমন একজন বৈজ্ঞানিকের গবেষণার প্রথম শর্ত হলো, তার সবকিছুকে প্রশ্ন করা, চুলচেরা বিশ্লেষণ করা।
যেমন, আমাদের জানা আছে, নিউটনের মনে/মাথায় প্রশ্ন উদয় হয়েছিলো 'আপেল কেন আকাশে না গিয়ে তার মাথায় উপর পড়লো'। / সেটাই তো মাধ্যাকর্ষণের সূত্রকে আবিষ্কার করলো। গ্যালিলিও যখন বললো, 'পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে' তখন ধর্মীয় কারণে তার উপর খড়গ নেমে এলো। কিন্তু গ্যালিলিও-র আবিষ্কারটা কি সত্য ছিলো না?
সুতরাং আমার প্রশ্ন, আপনাদের এত ভয় কেন? আমি তো ভালভাবেই জানি, তারাই হারানোর বা হারার ভয় করে যাদের ঈমান এবং বিশ্বাসে দুর্বলতা আছে। আপনার ধর্ম সত্য হলে, আপনার কাছে সব ধরণের সব প্রশ্নের উত্তরই থাকবে।
কাজী রায়হার রাহীর এইসব প্রশ্ন করার কারণে কেন তাকে দায়ী হতে হবে, আমার মাথায় ঢুকছে না। তার প্রয়োজন সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া, একজন সুস্থ, স্বাভাবিক এবং যুক্তি-তর্ক সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠার জন্য। অন্ধত্ব দিয়ে পৃথিবী বেশী দূর আগায় না, আগাতে পারে না।
ধর্মের সত্য-মিথ্যা উদঘাটনে ধর্মগুলোকেও মাইক্রোস্কোপের নীচে আসতে হবে। একজন মুসলমানের যেমন অধিকার আছে, তার ধর্মকে জানা, অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, তেমনি তার অধিকার আছে অন্যধর্মগুলোকেও জানা এবং তার অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।
এইজন্য সবচেয়ে সরল পথ হলো, জানার জন্য প্রশ্ন করা। শিক্ষক ক্লাসে আমাদের শেখায়, 'যদি বুঝতে না পারো প্রশ্ন করো', অথবা লেকচারের পর বলে, 'এই বিষয়ে কারো কোন প্রশ্ন আছে'?/ সে রকম প্রশ্ন মানুষ যদি নিজের বা অন্য ধর্ম সম্পর্কে করে তখন বিপত্তি ঘটে কেন?
মনে রাখতে হবে, জোর করে কোন কিছুকে সত্য বলে টিকিয়ে রাখা যায় না, বা মানুষের ভেতরের প্রশ্নের উদঘাটন হলে, তার উত্তর না পেলে সে কোন কিছুকেই উপযুক্ত সন্মান দিতে পারে না। এটাই শিক্ষা। তসলিমা নাসরিনের প্রশ্নের উত্তর কাঠমোল্লারা দিতে পারেনি। যদি দিতে পারতো, তবে তারা তসলিমা নাসরিনের সাথে তার প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বসতো, তার কল্লা চাওয়ার অনেক আগেই।
তসলিমা নাসরিনের প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার মত আইন-বিরুদ্ধ কাজে লিপ্ত হতো না। আর সত্য কি এমন ঠুনকো বিষয় যে, তার সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলেই 'ধর্ম গেলো, ধর্ম গেলো' বলে রব উঠবে? ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে তবে এত কাপুরুষতা কেন?
মানুষ দিন দিন অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠছে বলেই তাদের নেতা বা রোল মডেলদের চরিত্র এবং সব কার্যকলাপের উপর শ্যেন দৃষ্টি রাখছে, তুমুল চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমে পড়ছে, সামান্য এদিক-সেদিক হলে হাউ-কাউ শুরু হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তা থেকে ধর্মগুলোর ধর্মীয় গুরু, নেতা বা নবী-রাসূলরা বাদ যাবে কেন? তারা তো মানুষ হিসেবেই এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন! তবে তাদের কার্যকলাপ মানুষের অনুকূলে কী না,সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে, চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে।
মনে রাখতে হবে, একজন অন্য ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিক (নিরীশ্বরবাদী) বা সন্দেহবাদী মানুষের কাছে, নবী-রাসূলরা শ্রেফ একজন মানুষই, তাদের মাধ্যমে আসা ধর্মগ্রন্থ শ্রেফ একটা গ্রন্থ। যেমন, মুসলমানদের কাছে হিন্দু ধর্মের দেব-দেবী, রাম-শ্রীকৃষ্ণ যেমন, তেমনি হিন্দুদের কাছে মুসলমানদের নবী-রসূল আল্লাহ তেমন।
সেখানে তারা একে অন্যের ধর্মকে সন্দেহের চোখে দেখবেই। আর সেজন্যই আমাদের যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে হবে।
যখন অন্য ধর্মাবলম্বীরা আমাকে বলে, তোমাদের নবী তো একজন লম্পট, এতগুলো বিয়ে করেছে। তখন কি আমাকে রক্তচক্ষু করে, হৈ হৈ রৈ রৈ করে তার গর্দান থেকে কল্লাটা পৃথক করতে হবে? তার এই প্রশ্ন কোটি কোটি বিধর্মী, নিরীশ্বববাদীদের প্রশ্ন। কয়জনের কল্লা আপনি ফেলে দেবে্ন? নাকি সহজ হবে, স্রেফ নবীজির এতগুলো বিয়ের করার কারণ বা উত্তরটা তাদের জানিয়ে দিলে, যদি সে উত্তরটা আপনার কাছে থাকে।
সুতরাং বুঝুন, রাহী মোটেও ভুল করেননি। সে নির্দোষ, নিষ্পাপ। তার প্রশ্ন একজন সুস্থ, যুক্তিবাদী, চিন্তাশীলদের প্রশ্ন। এতে অফেন্ডেড হওয়ার বা আত্মশ্লাঘাতে লাগার কিছু নেই। মানুষকে বা তার যৌক্তিক প্রশ্নকে কখনো দাবিয়ে রাখা যায় না।
বাংলাদেশ সরকার এই নির্দোষ কাজী রায়হান রাহীকে গ্রেফতার করে, জামিন না দিয়ে এই অন্ধবাদীদের আশকারা দিচ্ছে। তাদের কাছে সরকার প্রমাণ দিচ্ছে, সরকার ইসলাম ধর্মের হেফাজত করছে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, মূর্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও সেসব ধর্মের হেফাজতের জন্য কাউকে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত কাউকে আইনের অধীনে আনতে পেরেছে বলে শুনিনি। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণদের জীবনের শুরুর প্রশ্নগুলোর প্রতি নির্মমভাবে খড়গহস্ত হচ্ছে। রাজনীতির দলীয় শক্তি, সমর্থন এবং ভোট ব্যাংক সক্রিয় রাখতে ধর্মীয় উন্মাদদের সন্তুষ্টিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছে না। অথচ নিজেরা পুষে চলেছে অপরিসীম দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সহিংসতা, অশান্তি, বিশৃংখলা।
বাংলাদেশের সমাজ একটা সন্ধিক্ষণে উপনীত। পুরাতনকে ছেড়ে নতুন আরেক অবস্থানে যাত্রায় রত। আপাতঃ সর্বগ্রাসী অন্ধকার মনে হলেও, আশাবাদী, ভোর হবেই। আলোর ঝলকানি অন্ধকারের মানুষরা সইতে পারে না। তাই এখন ওলোট-পালটের সময়।
ধৈর্য ধরুন সবাই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।