আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লালন ফকিরের জন্ম পরিচয়ের প্রমাণযোগ্য ইতিবৃত্ত ॥

সুবাসিত পুষ্প যেমন তার সুগন্ধ ছড়িয়ে মানব মনকে আমোদিত করে, তেমন সমাজেও এমন কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ জন্ম গ্রহন করেন, যারা তাদের চিন্তা-চেতনা ও ভাব-ভাষা প্রকাশের মাধ্যমে মানব মনে স্থায়ী আসন করে নেন। তেমনই আলোচ্য ব্যক্তি হচ্ছেন মহাত্মা লালন ফকির, যাকে বাংলার সক্রেটিস বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। বিগত ব্রিটিশ আমলে গান্ধিজী ও লালন ফকিরকে মহাত্মা উপাধিতে বিশেষিত করা হয়েছিল এইজন্য যে তারা নিজ করন ও প্রজ্ঞাবলে জনমনে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিলেন। এছাড়া ১৯৭৪ খ্রীষ্টাব্দে বি.বি.সি বেতারের জরীপ তথ্যমতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ জন বাঙ্গালীর মধ্যে লালন ফকিরকে অন্যতম বলে বিবেচিত করা হয়েছিল। এমন একজন বিশ্বনন্দিত কবির ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ও আধ্যাত্ব দর্শনের ব্যাপ্তি দেশের পরিসীমা অতিক্রম করে বৈশ্বিক ভাববাদী ভূগোলকে স্পর্শ করার কারনে তথাকথিত কিছু গবেষক যথেষ্ট অনুসন্ধান না চালিয়ে লালন ফকিরকে তাদের স্বজাতির অন্তর্ভুক্ত করার মন-মানসে ধর্মীয় সম্প্রসারণবাদী মানসিকতা পোষণ করেছিলেন।

তারা কেন এবং কী উদ্দেশ্যে লালনের স্বঘোষিত জন্ম সম্বন্ধীয় “যা তিনি তার গীতিতে সুকৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রকাশ করে গেছেন” সেই অভিমতকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে অল্প সংখ্যক কিছু গবেষক কল্পিত ও মনগড়া জীবন কাহিনী প্রকাশ করেছেন তা আজও বোঝা গেল না।
লালন ফকিরের জাত-ধর্ম ও জন্ম পরিচয় নিয়ে স্বদেশ ও বিদেশে বেশ কিছু লেখক ও গবেষকের পরস্পর বিরোধী মতামত তুলে ধরা হলো। যারা লালানকে মুসলিম বংশোদ্ভুত এবং হরিণাকুন্ড থানাধীন হরিশপুর গ্রামের অধিবাসী বলে মনে করেন, তারা হচ্ছেন :- মো: আব্দুল ওয়ালী, মো: আবু তালিব, খোন্দ: রিয়াজুল হক, এস.এম লুৎফর রহমান, খোন্দ: রফিউদ্দিন, ড: আনোয়ারুল করিম।
অন্যদিকে, যারা লালন ফকিরকে হিন্দু বংশোদ্ভুত এবং কুষ্টিয়া জেলাধীন কুমারখালী থানা অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামের বাসিন্দা মনে করেন, তারা হচ্ছেন :- অক্ষয় কুমার মৈত্র, বসন্তকুমার পাল, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, কাজী মেতাহার হোসেন, ড: আবুল আহসান চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সনৎকুমার মিত্র, শেখ আবুল হোসেন আল কাদেরী, ড: আহাম্মদ শরীফ, বিনয় ঘোষ, অন্নদা শংকর রায়, বিশ্বনাথ মজুমদার, শশীভূষন দাস গুপ্ত, সৈয়দ মুর্তজা আলী, এইচ এম ইমাম উদ্দীন, প্রফেসর মুনছুর উদ্দীন প্রমুখ।
এছাড়া কাঙাল হরিনাথ তাঁকে কুষ্টিয়া জেলাধীন ঘোড়াই গ্রামের অধিবাসী বলে উল্লেখ করেছেন এবং অনেক গবেষক স্থীর সিদ্ধান্তে পৌছুতে না পেরে তাঁর জন্ম বিষয়ে অনেক স্ববিরোধী মন্তব্য করেছেন।

লালন ঘরানাভুক্ত লালন অনুগামী ভেকধারী ফকির আনোয়ার হোসেন (মন্টু শাহ) কোন যুক্তি ব্যতিরেকেই তাকে আবির্ভুত অবতার বলে অভিহিত করেছেন। আমার নিজেস্ব মতামত হচ্ছে, এত যুক্তিতর্ক ও লেখালেখির পরও লালন ফকিরের যথার্থ পরিচয় আজও উদঘাটিত হয়নি অর্থাৎ পূর্ব অবস্থায় রয়ে গেছে, (যথা পূর্বং তথা পরং)। মহাত্মা লালন ফকির তদানিন্তন আমলের ধর্মীয় বিভেদ, ছুঁৎমার্গ, বর্ণবাদী নিপীড়ন, মানবতার অবক্ষয়, উচ্চ নীচের জাতিগত বিভেদ, ছুঁৎমার্গ, ফ্যাসাদ নিজে অবলোকন করে জাত-ধর্মের উপর বিতৃষ্ণাহেতু তাঁর ধর্মীয় ও জন্ম পরিচয়টি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে বিশ্ব মানব সম্প্রদায়ের একজন অতি নগন্য সদস্য হতে চেয়েছিলেন। পৃথিবীতে এমন অনেক কামেল গাউজ-কুতুব ও সাধু সন্যাসী জন্মগ্রহণ করেছিলেন যাঁদের সঠিক জন্ম পরিচয় আজও পাওয়া সম্ভব হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে লালন ফকিরকেও তাদের দলভুক্ত করা চলে।

তিনি তাঁর রচিত কাব্যের ছত্রে ছত্রে শুধু মানুষ ও মানবতার জয়গানই গেয়ে গেছেন। লালনের মূল দর্শন হচ্ছে “মানুষতত্ব” অর্থাৎ সৃষ্ট মানুষই সকল কারণের আদি কারণ। এবং পালনীয় ধর্মের নাম “মানুষ সেবা ধর্ম”। মানুষের গুনগান ও সেবা করাই এই ধর্মের মূলনীতি। সেই কারণে লালন ফকির স্বেচ্ছায় ক্ষুদ্্র জাত, ধর্ম ও জন্ম পরিচয় ত্যাগ করে বিশ্ব মানবের বিস্তৃত হৃদয় রাজ্যে আসন পাবার জন্য আজীবন ধর্মনিরপেক্ষ সংগ্রাম করে গেছেন।

তিনি গেয়েছেন : “যথা যায় মানুষ দেখি, মানুষ দেখে জুড়াই আঁখি। ” তাঁর প্রিয় শিষ্য দুদ্দু শাঁহ বলেছেন যে, “যার মনের কথা সে যদি না কয়, অন্যে কি তা জানিতে পায়”। অতএব, শুধুমাত্র জনশ্রুতি, কথিত গল্প শুনে লালনের মত গুরুত্বপূর্ণ, ও জগৎ বরেণ্য, বিশ্বসেরা একজন ভাবগীতিকার সম্বন্ধে এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া কখনও উচিত হয়নি। অর্থাৎ আমরা লালন ফকিরের জন্ম বিষয়ক প্রমানাদী গ্রহণ করব শুধু তার গীতিবাক্য ও তদ্বীয় শিষ্যবর্গের লেখনির বিষয়বস্তু থেকে, কারও অনুমান ভিত্তিক মনগড়া বিবৃতি, কাহিনী, প্রমানহীন উপকথা বা রূপকথা থেকে কখনই নয়। আজ সারা বিশ্বে মানবতার পূজারী অনুসন্ধিৎসু গবেষকগণ বিশ্ব মানবতার ধারক-বাহক ও প্রকাশক মহাত্মা লালন ফকিরের কাব্য পাঠে পরিতৃপ্ত হয়ে তাঁর স্মৃতি বিজাড়িত পূর্ণভূমি পরিদর্শনের জন্য লালনের স্মৃতিধন্য আাখড়া বাড়িতে আসছেন, দেখছেন, শিখছেন এবং লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রকৃত মানবতাবাদী প্রিয় মানুষকে অবগত করাচ্ছেন।

আর আমরা চোখ থাকতে অন্ধের মত কূপমন্ডুক হয়ে জাতাজাতির আবর্তে সংকীর্ণ মন-মানসিকতা নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি।
জগতে মানুষ মাত্রই জন্মগ্রহণ ক‘রে থাকেন, সেই রকম মহাত্মা লালন ফকিরও কোন রতœগর্ভা মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু জগতের বিভেদনীতি ও অসম জাতা-জাতীর গোড়ামী অবলোকন করে তাঁর জন্ম পরিচয় তিনি স্ব-ইচ্ছায় ত্যাগ করে গেছেন। তিনি তাঁর রচনামূলে নিজের সম্বন্ধে কি বলে গেছেন সেই বিষয়ে বিচার বিশ্লেষন করে দেখা যেতে পারে। লালন বলছেন যে, “আমি লালন এক সেঁড়ে, ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে, একদিন ভুগেছিলাম পক্সজ্বরে, দরবেশ সিরাজ সা করলেন উদ্ধার।

” এই পদে লালন ফকির দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষনা করেছেন যে, আমি জগতে একা এসেছি, আমার আত্মীয়স্বজন ভাই বন্ধু কেউ নেই। একদিন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে অথর্বের মত পড়েছিলাম, দয়াল গুরু দরবেশ সিরাজ সাঁই’র অসীম কৃপাবলে রোগমুক্ত হয়েছিলাম। এই দুটো প্রমানিত ছন্দে লালন ফকির তার জন্ম বিষয়ক সমস্ত বর্ণনা দিয়েছেন, এর পরেও কি আর কিছু প্রমানের দরকার পড়ে? আসল সত্য কি? দেখার মত চোখ থাকলে অবশ্যই দেখে নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। লালন : “সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন, লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান। একই পথে আসা-যাওয়া একই পাটনি দিচ্ছে খেয়া।

” এই পদটিতে, লালন ফকির জগৎবাসীর উদ্দেশ্যে বলতে চেয়েছিলেন যে, আমি হিন্দু কি মুসলমান তা আমি নিজেই জানিনা। জাগতিক নিয়মের আবর্তে মানুষ মায়ের উদর থেকে জন্ম গ্রহন করে, এবং দুনিয়াবী কর্ম সম্পাদন শেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাটি-মার কোলে আশ্রয়ের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে। সৃষ্টিকর্তার নিকটে শুধু মানুষ পরিচয়টিই থাকে, জাতের পরিচয় থাকে না। এই আসা-যাওয়া কর্মকান্ডটি সৃষ্টিকর্তা সু-কৌশলের সঙ্গে নিজে পরিচালনা করে থাকেন।
এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে যে, লালন ফকিরের নিজের স্বীকারোক্তির পরেও গবেষকদের বোধোদয় হল না কেন? তারা কেন মানুষ-লালনকে বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত বা জাতীভুক্ত করতে চাইলেন? এটা কি লালনের প্রতি অবিচারের সামিল নয়?
লালন: “যাতায়াত একদ্বারে হয়, নারী পুরুষ দুই জাতি কয়, একই ঈশ্বর এই দুনিয়ায়, লালন কয় তা কেউ ভাবে না।

” তিনি বলছেন ঈশ্বর যেমন নারী পুরুষরূপে মানব সম্প্রদায়কে ভবে পাঠিয়েছেন, তেমন লালন ফকির ও মানুষ সম্প্রদায়কে দুটি জাত “নারী ও পুরুষ” হিসেবেই মান্য করে গেছেন। অন্য কোন জাত হিসেবে নয়। অর্থাৎ জাত শুধু নারী ও পুরুষ। কি অপরূপ বিস্ময়কর চিন্তা চেতনা! কি মহিমাময় চিরন্তন ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাবাদের জ্বলন্ত উদাহরন, এমন উদার ও দূরদর্শী চিন্তা চেতনা না থাকলে জগতের মানুষকে কখনো কি শুধু নারী- পুরুষরূপে বিভক্ত করে দেখা সম্ভব হতো? আসুন, আমরা সবাই মিলে লালন ফকিরের কন্ঠের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে “মানুষ জাতিকে শুধু মানুষ রূপে” ভাবতে শেখার চেষ্টা করি। তাহলে জগতের সমস্ত বর্ণবাদ, হিংসা-নিন্দা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অন্যায়-অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটবে।



মো: নিয়ামত মাষ্টার
(লালনগীতির ভাবার্থকারী, গবেষক, সংগ্রাহক ও প্রবন্ধকার। )
গ্রাম: গোবিন্দপুর
ডাকঘর+থানা: আলমডাঙ্গা
জেলা: চুয়াডাঙ্গা।
মোবাইল নং- ০১৯৩৫ ৫০৭ ২০৩
ই-মেইল: niamotmaster@gmail.com।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.