আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওয়াকা ওয়াকা –ট্যুর আফ্রিকা(চতুর্থ পর্ব)ঃ গলফ কোর্স, বমি লেক এবং এলোয়া বীচে কাটানো চমৎকার কিছু মুহূর্ত

সুখি হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় বিবেক হীন হওয়া। খুব একটা স্বাস্থ্য সচেতন না হয়েও আমি একজন বাধ্যতামূলক আর্লি রাইজার! বহুল প্রচলিত ইংরেজি প্রবাদ বাক্যটির ভাবার্থ মোতাবেক আমি ধনবান নই, জ্ঞানীও নই ততোটা। আমার এমন কোন জটিল রোগ ও নেই যে কারনে খুব সকালে উঠে দৌড় ঝাঁপ করে বেড়াতে হবে। তাহলে আমার প্রত্যহ এত সাত সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠার হেতু কি? কারণটা অবশ্য একটু ব্যতিক্রম ধর্মী; কিছুটা রহস্যময় ও বটে (অন্তত আমার কাছে) ; তাহলে বিষয়টা খুলেই বলা যাকঃ ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, যেদিন আমি আয়েশ করে ঘুমিয়ে দেরিতে ঘুম থেকে উঠি, সেদিন আমার সারাবেলা কাটে প্রচণ্ড বাজেভাবে। ঘুম থেকে জেগেই টের পাই কেউ যেন আমার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে অবিরাম পেটাচ্ছে।

কারন মাথায় শুরু হয় ভয়াবহ মাইগ্রেনের ব্যাথা। ব্যাথানাশক ঔষধ খেয়ে , কপালে টাইগার বাম মেখে চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে ফেললেও সহজে অবসান হয়না এ যন্ত্রণার। এ কারনে আজকাল হলিডেতে ও আমি এলার্ম দিয়ে খুব সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠি, যাতে উইক এন্ড টা মাটি না হয়ে যায়। ছাত্র জীবনে আমি একে ডাকতাম ‘ ফ্রাই ডে সিকনেস’ বলে। এখন সরকারী ছুটি দুই দিন হওয়ায় নতুন নাম করন করেছি – ‘ উইক এন্ড সিকনেস’ ; আমার এই উইক এন্ড সিকনেস এর কোন মেডিক্যাল ব্যাখ্যা আছে কিনা জানা নেই।

দেখি বিজ্ঞ কোন ডাক্তার পেলে বিষয়টা জেনে নিতে হবে। অবশ্য আমার এক সবজান্তা ডাক্তার বন্ধু আছে, তাকে ফোন করে এখনই ব্যাপারটা জিগ্যেস করা যায়। কিন্তু এখন ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না। এ নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। আজ অবশ্য আমার তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার কারন উইক এন্ড সিকনেসের ভয় নয়, উদ্দেশ্য মনরোভিয়ার শান্ত স্নিগ্ধ সকালটাকে উপভোগ করা।

কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি বাকীরাও উঠে তৈরি হয়ে গেল। আমরা সবাই মিলে বের হয়ে পড়লাম প্রাতঃ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। এখানেও জাতিসংঘের একটি বাংলাদেশী ক্যাম্প আছে, নাম- ‘ বাংলাদেশ ডেন’। চারিদেকে একেবারে শুনশান নীরবতা। মনরোভিয়ার রাস্তায় এখনো লোকজনের আনাগোনা তেমন একটা শুরু হয়নি।

শুধু এক সাদা চামড়ার বিদেশীকে দেখলাম আপন মনে জগিং করছে। রাস্তার পাশেই আছে সুন্দর একটা গলফ কোর্স। প্রচুর গাছপালায় ভরপুর জায়গাটা। গলফ মাঠ উজ্জ্বল করে উড়ে বেড়াচ্ছে এক ঝাঁক সাদা বক। কেউ কেউ আবার ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গলফ মাঠের সবুজ ঘাসের গালিচায়।

গলফ কোর্সের শেষ মাথায় আছে একটি মনোরম লেগুন। লেগুনের পাড়ে দাড়িয়ে অনুভব করলাম ভোরের কমলা রোদ আর লেগুনের স্বচ্ছ শান্ত জল মিলে তৈরি করেছে এক মোহনীয় আবহ। লেগুনের পাড়ে পড়ে আছে মাছ ধরার সামগ্রী - আমার আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় - আন্তা লেগুনের পাড়ে গলফ মাঠের উল্টোদিকে দেখা গেল বিরাট এক অডিটোরিয়াম। এর নাম – UNITY CONFERENCE CENTER . এদেশের গুরুত্বপূর্ণ সভা সেমিনার গুলো এখানেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমরা এর ভেতরে প্রবেশ করলাম ভাল করে দেখার জন্য ।

দায়িত্বপ্রাপ্ত এক জন মহিলা কেয়ারটেকার আমাদের ভেতরটা ঘুরে দেখালেন। ভেতরের মূল হলরুমটা বেশ বড় সড়। তবে পুরো বিল্ডিং জুড়েই চোখে পড়ল বড্ড অযত্ন আর অবহেলার ছাপ। একটু ঘষামাজা করলে ভবনটা হারানো শ্রী অন্তত ফিরে পেত কিছুটা। বিশাল ভবনের পিছনে আছে এরকম বিশাল বড় বড় গাছ হোটেলে ফিরে দেখি আমাদের ট্যুর লিডার ব্রেক ফাস্টের টেবিলে ওয়েট করছেন আমাদের জন্য! ও হ্যাঁ বলাই হয়নি যে উনাকে সকালে অনেক ডাকাডাকি করা হয়েছিল।

কিন্তু কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমরা ভাবলাম টায়ার্ড হয়ে হয়তো বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন তিনি। তাই আর ডিস্টার্ব করা হয়নি। তাকে ছাড়াই আমরা বের হয়ে পড়ি মর্নিং ওয়াকে। কিন্তু এখন উনি বললেন – ‘ আমি তো অনেক সকালেই উঠেছি। টেলিফোন রুমে ফোন করতে এসে ফিরে দেখি তোমরা কেউ নেই’ আহারে বেচারা ট্যুর লিডার……পরে ছবি দেখে টের পাবেন কি মিসটাই না তিনি করেছেন।

ব্রেক ফাস্ট সেরে আমরা রওনা দিলাম ‘ বমি লেক’ এর উদ্দেশ্যে। ইস, কি বিচ্ছিরি নাম! একটা সুন্দর রোম্যান্টিক নাম দিলে কি এমন ক্ষতি হত ? যাত্রা পথে এক মোটর বাইক চালকের বেপরোয়া বিপদ জনক কসরত আমাদের বিনোদিত করল। প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতে। লেকটি দেখে মনে হল এটিও কোন এক সময়ের খনি খোঁড়াখুঁড়ির ফসল। লেকের দুই পাশে আছে লালচে- সবুজাভ পাহাড় আর চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি।

পানিতে ডাইভ দেয়ার জন্য একটা কাঠের পাটাতন লাগানো রয়েছে লেকের পাড়ে। আরও আছে রাবারের বোট। আমাদের কেউ কেউ ডাইভিংয়ে আগ্রহী হল, কেউ আগ্রহ দেখাল বোট রাইডে। আমি দ্বিতীয় অপশন বেছে নিলাম। একজন আমাদের ভয় দেখাল, এসব লেকের পানিতে নাকি এক ধরণের ওয়ার্ম আছে যারা মানুষের মাংস ভেদ করে ভেতরে বাসা বাঁধে! কি অদ্ভুত ভয় জাগানিয়া কথা।

বিষয়টা রসিকতা হতে পারে। আফ্রিকার ‘ তাম্বু’ ফ্লাইয়ের গল্প শুনেছি। এ মাছির ডিম মানুষের শরীর স্পর্শ করলে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে সেই লার্ভা মাংস ভেদ করে শরীরে ঢুকে পড়ে। তারপর ওই স্থানে ফোঁড়ার মত হয়। ফোঁড়া পাকলে যখন পুঁজ নির্গত হয়, এর সাথে লার্ভাটিও পরিণত তাম্বু ফ্লাই হয়ে মাংস থেকে বের হয়ে উড়ে চলে যায়! ন্যাশনাল জিওগ্রাফীতে একবার ‘ আই ওয়ার্ম’ এ আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে দেখলাম।

তার চোখের ভেতর দৌড়ে বেড়াচ্ছে লম্বাটে এক ধরনের কৃমি। ডাক্তাররা চোখ অপারেশন করে সেই কৃমি বের করে দেখালেন। এসব জেনে আর কে নামে লেকের পানিতে? আর কিছু না থাকুক , আই ওয়ার্ম থাকা তো অস্বাভাবিক কিছুনা। তাই আর সাহস করলাম না লেকের পানিতে নামতে। বোট রাইড টা এ ক্ষেত্রে নিরাপদ।

এখন বমি লেকের কিছু ছবি দেখুন। কোথাও বেড়াতে গেলে আমার কাছে সব মনে হয় ঘড়ির কাঁটা যেন একটু দ্রুত চলছে। আর সবচেয়ে স্লো চলে বলে মনে হয় বিমান বন্দরের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসলে। দুই ঘণ্টা কিভাবে পার হয়ে গেল টের পেলাম না কিছুতেই। ট্যুর লিডার ফেরার তাড়া দিলেন।

ঝটপট সবাই উঠে পড়লাম গাড়িতে। ফেরার পথে দেখলাম একটা কয়লা বোঝাই গাড়ি। এদেশের মানুষের জীবিকার অন্যতম উপায় এ কাঠ কয়লার ব্যবসা। কয়লা উৎপাদনের জন্য মাটিতে বড় গর্ত করে চুলা বানিয়ে তাতে কাঠ পোড়ানো হয়। কাঠের উপর বালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে আগুন বাইরে ছড়াতে না পারে।

লাইবেরিয়ার বিভিন্ন স্থানে রাস্তার মোড়ে, বাড়ির সামনে কত দেখলাম মাটির নীচ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তখন বিষয়টা বুঝতে পারিনি। কাঠ কয়লা উৎপাদন পদ্বতি জানার পর ব্যাপারটি পরিষ্কার হল। হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে কিঞ্চিৎ ভাত ঘুমের বিরতি দেয়া হল। বিকেলে গেলাম আমরা ‘এলয়া’ বীচে।

বীচটা দেখতে অনেকটা আইভরিকোস্টের গ্র্যান্ড বাসাম বীচের মত। দেখুন বীচের কিছু ছবি। কেমন লাগল পাঠক? জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আগামী কাল ইনশাআল্লাহ আমরা রওনা হব ঘানার উদ্দেশ্যে। আপনাদের কমপ্লিমেন্ট পেলে লিখতে বসব আমার ঘানা ভ্রমণ কাহিনী।

সে পর্যন্ত থাকল শুভ কামনা। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। আল্লাহ হাফেজ।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.