আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেলুলয়েডের মহাকবি সত্যজিৎ রায়

মানুষ আমার সাধন গুরু. সেই মোকামে যাত্রা শুরু সেলুলয়েডের মহাকবি সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র, সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক আর সংগীত শিল্পকলার নানা শাখায় ছিল সত্যজিত রায়ের বিচরণ। বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে তিনি পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। চলচ্চিত্রে যোগ করেছেন নিজস্ব ভাষা। বাংলা সাহিত্যেও রেখেছেন অবদান। সৃষ্টি করেছেন ফেলুদা আর প্রফেসার শঙ্কুর মতো অবিস্মরনীয় চরিত্র।

উপমহাদেশের গর্বিত ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন সত্যজিত রায়। এই মনীষীর জন্মদিন ০২ মে। সত্যজিতের রায়ের জন্মদিনে তার অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিমুহূর্তের বিশেষ আয়োজন। বহুমূখি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন সত্যজিত রায়। সবকিছু ছাপিয়ে চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের পরিচিতি।

মানুষের জীবনের নানা দিক চলচ্চিত্রের ক্যামেরায় তিনি একেঁছেন সহজ সরল বর্ণিল রঙে। সেলুলয়েডে গল্পের সঙ্গে জুড়েছেন আবেগ, কাব্যময়তা,বাস্তবানুগতা ও মানবিকতার সমাবেশ। জীবনকে দেখেছেন খুব গভীর দৃষ্টিতে। তাই তার ছবিগুলোতে দেখা যায় অজস্র গল্পের ভাঙা-গড়া। সহজ গল্প তিনি বলেছেন খুব সোজা করে।

সৃষ্টিতে ছিল তার বিস্ময়। তুলির মতোই ব্যবহার করেছেন ক্যামেরা। সেলুলয়েডের এই মহাকবি চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। রেখে গেছেন তার অসামান্য সৃষ্টিকর্ম। প্রবাদপ্রতিম এই মহাপুরুষ শুধু বাংলা বা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব-চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

সত্যজিত রায়ের আদিপুরুষদের বসতি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায়। তার পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক, প্রকাশক ও শখের জ্যোতির্বিদ। বাংলা শিশু সাহিত্যে তার রচনাকর্ম আজও হয়ে আছে উজ্জ্বল। উনিশ শতকের শেষভাগে তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে সপরিবারে কলকাতায় আবাস গাড়েন। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সত্যজিত রায়ের বাবা সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের রসময় ধারার অন্যতম প্রবর্তক।

বাংলা শিশু সাহিত্যেরও সেরা লেখকদের একজন ছিলেন তিনি। একজন দক্ষ চিত্রকর ও সমালোচক হিসেবেও সুকুমার রায়ের খ্যাতি ছিল। ১৯২১ সালের ২ মে যুদ্ধোত্তর এক কঠিন সময়ে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিত রায়। জন্মের মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবা সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাকে বড় করে তোলেন।

সত্যজিত রায় বড় হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলকাতার কলেজে অর্থনীতি পড়াশোনা শুরু করেন, যদিও চারুকলার প্রতি সবসময়ই ছিল তার দুর্বলতা। ১৯৪০ সালে মা সুপ্রভা দেবীর ইচ্ছা পূরণ করতে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শেষ করে সত্যজিত রায় কলকাতায় চলে আসেন এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘ডি জে কিমার’-এ জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালের দিকে তিনি প্রকাশনা সংস্থা ‘সিগনেট প্রেস’এর সঙ্গে জড়িত হন। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হওয়া বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকাই ছিল তার কাজ।

সিগনেট প্রেস থেকে বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র একটি শিশুতোষ সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছিল। বইটির প্রচ্ছদ আঁকার দায়িত্ব পড়ে সত্যজিতের উপর। এ সময় উপন্যাসটি তিনি প্রথম পড়েন। উপন্যাসটি সত্যজিতকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে সত্যজিত রায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় ‘পথের পাঁচালী’-কে বেছে নেন।

প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও তিনি বইটির ভিতরের বিভিন্ন ছবিও এঁকে দেন। এই ছবিগুলোই পরে দৃশ্য বা শট হিসেবে তার সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রে স্থান পায়। ১৯৪৭ সালে সত্যজিত রায় অন্যান্যের সঙ্গে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির সদস্য হওয়ায় বিশ্বের বহু বিখ্যাত ছবি দেখার সূযোগ আসে। ছবি দেখতে দেখতেই একসময় তিনি নিজেই ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৫২ সালের শেষ দিকে সত্যজিৎ তার নিজের জমানো টাকায় ‘পথের পাঁচালী’ ছবির দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন প্রাথমিক দৃশ্যগুলো দেখার পর হয়তো কেউ ছবিটিতে অর্থলগ্নি করতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু সে ধরনের আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় ধীরগতিতে এগিয়ে চলে ছবির কাজ। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটির নির্মাণ শেষ হয় এবং সে বছরই মুক্তি পায় ‘পথের পাঁচালী’। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে।

ছবিটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্টারি’ হিসেবে পুরস্কৃত হওয়া ছাড়াও ১১টি আর্ন্তজাতিক পুরষ্কার পায় ‘পথের পাঁচালি’। ‘পথের পাঁচালি’-এর মাধ্যমে শুরু হয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের পথচলা। পরবর্তী ছবি ‘অপরাজিত’ তাকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক পরিচিতি। ছবিটি ইটালির ভেনিসের বিখ্যাত গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার অর্জন করে। এরপর একে একে ‘অপুর সংসার’, ‘পরশপাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘চারুলতা’, ‘দেবী’, ‘মহানগর’, ‘অভিযান’, ‘কাপুরুষ’, ‘মহাপুরুষ’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘জনারণ্য’, ‘হীরক রাজার দেশ’, ‘গণশত্রু’, ‘আগন্তুক’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘আগুন্তক’ প্রভৃতি অসাধারণ ছবি নির্মাণ নিজেকে করে তোলেন অমর।

ডকুমেন্টারি ফিল্ম, শর্ট ফিল্ম, ফিচার ফিল্মসহ সত্যজিত রায় পরিচালনা করেছেন মোট ৩৭ টি ছবি। চলচ্চিত্রেও সত্যজিত রায় নিবেদিত ছিলেন ৩৭ বছর । ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালি’ থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালের ‘আগন্তুক’। এই একটানা সৃজন জীবনের কোথাও তিনি পিছু হটেননি। পেইন্টিং সুলভ আলোছায়ার ব্যঞ্জনা, উপন্যাসের কাহিনী ও পরিবেশ বর্ণনা, নাটকীয় দ্বন্দ্ব, সঙ্গীতের গতি ও ছন্দ- এসব কিছুরই সুনিপুণ ব্যবহার আমরা দেখতে পাই সত্যজিতের ছবিগুলোতে।

চলচ্চিত্রের ফ্রেমে তিনি বেধেঁছেন মানুষের জীবনকে। স্বল্প সময়ে, সুন্দর সাবলীল ও চিত্তাকর্ষকভাবে ছবিতে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন সত্যজিত। চলচ্চিত্রকে মূল প্লাটফর্ম করে শিল্প-সাহিত্যের অন্যসব শাখায় হেঁটেছেন সত্যজিত রায়। হেঁটেছেন যে পথ দিয়ে রেখে গেছেন পায়ের দাগ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় দুটি চরিত্র গোয়েন্দা ফেলুদা ও বিজ্ঞানী শঙ্কুর স্রষ্টা।

এছাড়াও তিনি প্রচুর ছোটগল্প লিখেছেন। চলচ্চিত্র নিয়েও লিখেছেন বেশ কিছু বই। আজও চলচ্চিত্রের প্রতি উৎসাহীদের জানার আকাঙ্খা মেটাচ্ছে তার প্রবন্ধ সংকলন ‘আওয়ার ফিল্মস’, ‘দেয়ার ফিল্মস’, ‘বিষয়: চলচ্চিত্র’, এবং ‘একেই বলে শুটিং’। চিত্রশিল্পী হিসেবে সত্যজিত রায় প্রমাণ করেছেন নিজেকে। তিনি ‘রে রোমান’ ও ‘রে বিজার” নামের দুইটি টাইপফেস নকশা করেন।

চলচ্চিত্রে পদার্পণের অনেক পরেও তিনি অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ ও গ্রাফিক ডিজাইনার কাজ করেছেন। নিজের লেখা সব বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভেতরের ছবি তিনি নিজেই একেঁছেন। এছাড়াও নিজের চলচ্চিত্রের সব বিজ্ঞাপনও তিনি নিজে তৈরি করতেন। ১৯৮৩ সালে ‘ঘরে বাইরে’ ছবির কাজ করার সময় সত্যজিত রায় হার্ট অ্যাটাক হয়। যার ফলে কাজের গতি কমে যায়।

জীবনের অবশিষ্ট নয় বছর তার কাজের পরিমাণ ছিল সীমিত। প্রায়ই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ১৯৯২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সত্যজিত রায় ভর্তি হন হাসপাতালে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে কাটে তার শেষ দিনগুলি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে তিনি পেন্সিলে আঁকেন একটি গাছের স্কেচ।

যার মধ্যে ছিল উপমহাদেশের ১১জন কৃতিমানের মুখাবয়ব। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই মহান চলচ্চিত্রকার। মৃত্যুর মাত্র একসপ্তাহ আগে সত্যজিত রায় পান বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সন্মানজনক অস্কার পুরস্কার। জীবদ্দশায় তিনি অর্জন করেন ৩২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। নিজের কাজের মধ্য দিয়ে তিনি হয়েছেন অমৃতলোকের বাসিন্দা।

সত্যজিত থেকে হয়েছেন মৃত্যুজিত।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।