আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কামারুজ্জামানের গড়ে তোলা আলবদরই হত্যা করে বুদ্ধিজীবীদের !

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে ইসলামী ছাত্র সংঘের বাছাই করা একান্ত অনুগত কর্মীদের নিয়ে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে মাসখানেকের মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সমস্ত ছাত্র সংঘ কর্মীদের আলবদর বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটরদের দেয়া অভিযোগপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার, আল বদর ও আলশামস বাহিনীর প্রধান ও কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা হলেন ১. মতিউর রহমান নিজামী সভাপতি, পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ। ২. আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ।

৩. মীর কাশেম আলী ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা। ৪. মোঃ ইউনুস রাজাকার বাহিনী প্রধান। ৫. মোহাম্মদ কামারুজ্জামান আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক। ৬. আশরাফ হোসেন আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও ময়মনসিংহ জেলা প্রধান। ৭. মোঃ শামসুল হক সিটি বদর বাহিনীপ্রধান।

৮. মোস্তফা শওকত এমরান, ঢাকা আল বদর বাহিনীর কমান্ডার। ৯. আশরাফুজ্জামান খান, ঢাকা শহর আলবদর বাহিনীর প্রধান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের চীফ এক্সিকিউটর। ১০. চৌধুরী মঈন উদ্দিন বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের অপারেশন ইনচার্জ। ১১. সরদার আবদুস সালাম ঢাকা জেলার প্রধান। আসামি মোহাম্মদ কামারুজ্জামান কেবল তাঁর নিজের কৃত অপরাধের জন্যই দায় বহন করে না।

বরঞ্চ তাঁর উর্ধতন অবস্থানের কারণে আসামি তার অধীনস্থ এবং প্রভাবাধীন সাংগঠনিক পরিকাঠামোর অধীন বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তিবর্গের কৃত অপরাধের দায়ও আসামির ওপর বর্তায়। উক্ত পরিকাঠামোর অধীন সংগঠনসমূহ হলো : জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, আলশামস বাহিনী, আল-মুজাহিদ ইত্যাদি। অতএব আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ধারা ৪(১) এর আলোকে আসামি অপরাধমূলক দায়ের স্বরূপ একই সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং যৌথ। অভিযোগে বলা হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ নিচে আসামির সাংগঠনিক পরিকাঠামোতে আসামির নেতৃত্বের বলয়ে অবস্থান করতেন এবং সে অনুযায়ী সাংগঠনিক কার্যক্রম পালন করতেন। এমন কয়েক ব্যক্তি ও সংগঠনের উল্লেখ করা হলো যাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য আসামি নিজেও একক ও যৌথভাবে দায়ী।

আসামি কামারুজ্জামান তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন আলবদর বাহিনীর মাধ্যমে ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর জেলার বিভিন্ন থানায় ষড়যন্ত্র, উস্কানি ও সম্পৃক্ততা তথা পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, আদেশ প্রদান ও অপরাধ সংগঠনের বাস্তবায়নের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকল অধস্তন নেতাকর্মীদের কৃত সকল অপরাধ সংগঠনের দায়ে দায়ী। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সাংগঠনিক পরিকাঠামোতে নেতৃত্বে ও প্রভাবসংবলিত নিজের উর্ধতন অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করেন। এছাড়াও দেশের সাধারণ জনগণ এবং নিজের সাংগঠনিক পরিকাঠামোর আওতাধীন নেতাকর্মীদের প্রতি আসামির পক্ষ থেকে সরাসরি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের আহ্বান এবং উস্কানি দেয়া হয়। আসামি তার এই উস্কানি কৌশলের অংশ হিসেবে প্রধানত দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ, হিন্দু সম্প্রদায়, প্রগতিশীল সেক্যুলার গোষ্ঠী, আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দেশের শত্রু, ইসলামের শত্রু, ভারতের চর, দুষ্কৃতকারী ইত্যাদি অভিধায় বর্ণনা করে তাদের বিরুদ্ধে জনমনে, বিশেষত আসামির সাংগঠনিক এবং আদর্শিক অনুসারীদের মনে, ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছাড়ানোর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল উল্লিখিত এই নিরীহ নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হয় পাকিস্তান রক্ষার নামে, না হয় ইসলাম রক্ষার নামে, না হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে কার্যকর সহায়তা প্রদানের নামে বিভিন্ন গুরুতর অপরাধমূলক কর্মকা- উৎসাহিত করা।

এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম হলো হত্যা নির্যাতন ধর্ষণজনিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, গণহত্যা ইত্যাদি যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপরাধকর্মের মূল নীলনকশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও পরিপূরক ছিল। চীফ প্রসিকিউটরের অভিযোগ থেকে এটা দেখা যায়, মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এবং প্রভাবাধীনে যে সাংগঠনিক পরিকাঠামো, তার পুরোটা নিয়েই ছিল সহযোগী বাহিনীসমূহ। এই সংগঠনসমূহ বা বাহিনীগুলো তৈরিই করা হয়েছিল সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন অপারেশন এবং পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে সহায়তা করা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এসব অপারেশন এবং পরিকল্পনাগুলো বস্তুত ছিল অপরাধমূলক কর্মকা-ের নীলনকশা। অতএব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এহেন পরিকল্পনা এবং কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের সহযোগী বাহিনীসমূহের সহায়তার কিংবা সম্পূরক ভূমিকা পালনের অর্থই হলো নিজেরাও সরাসরি অপরাধমূলক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়া।

তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যে আসামির বিরুদ্ধে উক্তি এবং পদক্ষেপসমূহ সন্দেহাতীতভাবে এটা প্রমাণ করে যে, আসামি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সাংগঠনিক পরিকাঠামো নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপরাধে সম্পৃক্ত ছিলেন। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের তরুণ মেজর রিয়াদ হোসাইন মালিক চলমান অগ্রগামী যুদ্ধের ময়দানের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তার কাছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস হয়েছিল যে, এখন আর বেশিদিন রাজাকার ফোর্সের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখা যাবে না। এ কারণে তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রদের পৃথক করেন। বৃহত্তর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যে আল-বদরের প্রত্যেক ইউনিটকে তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা।

যেহেতু জনগণ অনবরত গুজব, বিবিসি রেডিও, মস্কো এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওর খবর শুনে খুবই হতাশাগ্রস্ত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত বিভাগ : এই বিভাগের দায়িত্বরত বিভিন্ন দল আকারে সরকারী সম্পত্তি রক্ষা করা, মাঠপর্যায়ে শত্রুর মোকাবেলা করা এবং আগ্রাসন প্রতিহত করা। এসব ব্যাপারে আলবদর জেলাপর্যায়ে দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্দেশ কিংবা অনুমোদনক্রমে অভিযান পরিচালনা করত। তৃতীয় বিভাগ : এই বিভাগে দেশীয় চক্রান্তকারীদের দ্বারা পরিচালিত দেশের প্রতি শত্রুতামূলক তৎপরতা বিষয়ে নির্ভুল তথ্য যোগান দেয়ার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল। পাকিস্তানী ফৌজ এবং আলবদর যার ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা বাহিনী, শত্রুর গতিবিধি ও তৎপরতা আন্দাজ করে পরিকল্পনা গঠন করত।

এছাড়াও আলবদরের স্বতন্ত্র মেডিক্যাল ইউনিট ছিল যা মেডিক্যাল কলেজসমূহের কর্মীদের নিকট গঠন করা হয়েছিল। ছাত্র সংঘের প্রাক্তন সদস্য ডাক্তাররাও মেডিক্যাল ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আলবদর বাহিনীর প্রত্যেক ইউনিটে তিনটি শাখা ছিল। ১. জনসংযোগবিষয়ক দফতর ২. প্রতিরক্ষাবিষয়ক দফতর ৩. তথ্যবিষয়ক দফতর। প্রত্যেক ইউনিটে একজন কমান্ডার ও দুইজন সেকেন্ড কামান্ডার থাকত।

আলবদরের এলাউন্স প্রত্যেক স্থানে আলবদরের এ্যাকাউন্টে জমা হতো। এই এলাউন্সের পরিমাণ ছিল মাসিক মাথা পিছু ৯০ টাকা। অবশ্য যুদ্ধ চলাকালে আলবদর কর্মীরা যাতায়াত ও খাদ্য খোরাকের সুবিধাদি গ্রহণ করেছিল। আলবদরের পোশাক প্রথমে ছিল কোর্তা ও পায়জামা। পরে তারা রীতিমতো ফৌজি ড্রেস পরত।

আলবদরকে রেশন সরবরাহ করা হতো। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.