আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোলাপ কাঁটার আঁচড়ে লোহিত পাঞ্জাবি (গল্প )

ঘড়ির কাঁটার মত টিক টিক করে সময় যখন সামনের দিকে এগিয়ে চলে, ঠিক সেরকম বদলে যেতে পারি না কেন বাবার কাছ থেকে চাবি নিয়ে আলমারিটা খুলল সুমিত। প্যাকেট এ মোড়ানো নতুন একটি পাঞ্জাবি বের করল। বিছানায় বসে পাঞ্জাবিটা রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। অনেক দিন আগে থেকেই এর অবস্থান আলমারিতে, কিন্তু কারও হাত পড়েনি। অবহেলার ছাপ স্পষ্ট।

পাঞ্জাবিটা কিন্তু বেশ সুন্দর। ক্রিম কালার, বুকে এবং হাতে হালকা কারুকাজ করা। দেখেই বোঝা যায় বেশ দামি। হাতে নেয়ার সাথে সাথে মনে উৎফুল্ল ভাব চলে আসার কথা। কিন্তু সুমিতের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অনুভুতি হচ্ছে।

মন গভীর বেদনায় আচ্ছন্ন, ভুল বললাম এর সাথে পৃথিবীর কোন বেদনার তুলনা হয় না। বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠছে। ব্যথাটা কেমন যেন অন্যরকম, সেই সাথে চারদিকটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কি সুন্দর!(মা কখন রুমে এসেছে টের পায়নি সুমিত) যাক ভার্সিটিতে গিয়ে কালার চয়েজ করা শিখেছে আমার ছেলে। তোকে সব সময় বলি এরকম হালকা কালার এর কাপড় কিনতে, কিন্তু তুই কি করিস! এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দিস।

কি সব গাঢ় রঙের জামা কাপড় কিনিস! তোকে একদম মানায় না । বলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মিসেস রওশন আরা। কিন্তু মায়ের এই হাত আজ তার ব্যাথা কিছুতেই কমাতে পারছে না। মায়ের সাথে মধুর সম্পর্ক সুমিতের। বাবা কে ঠিক ভয় পায় না, তবে মা-ই সব আবদার মেটায় তার।

গতকাল রাতে বাড়িতে এসেছে, তাই মায়ের আদরটা আরও বেশি। মা ছেলেকে সবসময় চোখে চোখে রাখছেন। আবার এটাও জানেন ছেলে বড় হয়ে গেছে এখন আর বেশিক্ষণ থাকতে চাইবে না মায়ের কাছে। কিছুক্ষণ পরেই ছুটবে বন্ধুদের আড্ডায়। সকালের খাওয়া জোটেনি বলেই ঘরে বসে আছে।

বাড়িতে এসে মায়ের রান্না ছাড়া কিছু খেতে চায় না সুমিত। রান্না দেরি হলে বিস্কুট, মুড়ি কিংবা চানাচুর খেতে দিলে মুখে দেয় না; বলে ওখানে তো এইসব ছাইপাশ খেয়েই বেঁচে আছি ( শুনে কষ্টে বুকটা ফেটে যায় রওশন আরার) তুমি যাও তোমার রান্না না হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করছি। ঘুম থেকে উঠেই আজ ল্যাপটপটা অন করেছে সুমিত। লজ্জা লাগে তার। মামা টাকা না পাঠালে এটা কিনে দেয়ার এবিলিটি তার পরিবারের ছিলনা, আর মডেম দেখলে তো মায়ের মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

এর জন্য কত ভাবে না চাপ দিতে হয়েছে। কি আর করবে! আসাইনমেন্ট, ল্যাব টেস্ট এর বৈতরণী পার হবে কি করে! টিউশনি করে তো আর ল্যাপটপ কেনা যায় না। চুপিচুপি ফেসবুক এ ঢুকল সে। আগে দেখে নিল চারদিকে কেউ আছে কিনা। বাবাকে নিয়ে ভয় নেই, বাবা আসার আগেই টের পাওয়া যাবে।

মাও তেমন সমস্যা করবে না, ছেলে অনেক দিন পর বাড়িতে এসেছে; এখন সব মাফ। ভয় শুধু বিচ্ছুটাকে নিয়ে। সুমিতের ছোট ভাই রাজন। এবার হাইস্কুলে উঠেছে। লেখাপড়ায় প্রথম সারির না হলেও রেজাল্ট খারাপ না।

কিন্তু তার বাবা-মা সন্তুষ্ট নয়। মা রেজাল্টের জন্য বকেছে, এখন চেষ্টা করবে বকাটা ডাইভারট করার। বাড়ির অন্যান্য মেম্বারদের বিরক্ত করা শুরু করবে, করবে কি! ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। বারবার সুমিতের রুমে আসছে আর যাচ্ছে। অবশ্য মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়েই কাজটি করছে সে।

বোঝা যাচ্ছে এই কাজে সে মোটামোটি পটু। বারবার এসে মনিটর এর দিকে তাকাচ্ছে। যার ফলে সুমিতকে বারবার ডেস্কটপ এ ফিরে যেতে হচ্ছে আর উদাস হওয়ার একটা ভাব নিতে হচ্ছে। ঝাড়ি দেয়া দরকার,কিন্তু সাহস পাচ্ছে না সুমিত। রাজন এর ল্যাপটপ এর প্রতি আগ্রহ কম, সবসময় ক্রিকেট আর মোবাইল নিয়েই ব্যাস্ত সে।

কিন্তু ক্লাস এ বন্ধুরা সবসময় ফেসবুক নিয়ে আলোচনা করে বলে বিষয়টি নিয়ে ধারনা আছে। সে যদি বুঝতে পারে ফেসবুক ব্যাবহার করছে,মাথা খারাপ করে ফেলবে মা’র। মা না বুঝলেও এমনভাবে বুঝাবে যে আর রক্ষা নেই। তাই তাকে সমীহ করতেই হচ্ছে। যাইহোক লোক চক্ষুর আড়ালে ফেসবুক এ ঢুকতে পেরেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সে।

ফেসবুকটা দিনদিন বোরিং হয়ে যাচ্ছে। আজাইরা প্যাঁচাল, আর ছবি দিয়ে ভর্তি। তাই দেখা বাদ দিয়ে চ্যাট এর দিকে গেল সে। আরে! মেহেদি লাইনে আছে। একে তো সকালে পাওয়াই মুশকিল।

সারারাত ফোনে কথা অথবা অনলাইনে থেকে দিনভর ঘুমায়। সুমিত নিজেও অবশ্য ঘুম থেকে দেরিতে উঠে। কিন্তু মাকে বুঝতে দেয়া যাবে না। হল এ যাই করুক বাড়িতে সে ভদ্র ছেলে। আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে ।

অনেক টারগেট। ফ্রেন্ডদের ম্যানেজ করতে হবে। রাহাতকে গিটারটা আনতে বলতে হবে। অনেক দিন পর দেখা হবে সবার সাথে, আড্ডা দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বাড়িতে আবার সান্ধ্য আইন।

তার আগ পর্যন্ত বাবা কিছু বলবে না। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই বিপদ, বাবা বারবার কল করতে থাকবে, সেই সাথে প্রাথমিক বকাটা খাবে মা, ছেলেকে আশকারা দেয়ার অপরাধে। এতকিছু যখন ভাবছে তখনই দুঃসংবাদটা দিল মেহেদি। টেক্সট এর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, চোখ যেন আটকে গেছে তার। প্রথমে মনে করল দুঃস্বপ্ন দেখছে, ভাবল কিছুক্ষণ পরেই মা ডাক দিবে আর জেগে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।

কিন্তু না সেরকম কিছু হল না। স্বপ্ন নাকি সত্যি টেস্ট করার জন্য চিমটি কাটতে গিয়ে টেবিল এর পেরেক লেগে হাতের আঙ্গুল বেশ কিছুটা কেটে গেল। পুনরায় স্ক্রিন এর দিকে তাকানোর সাথেসাথেই মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। বমিবমিও লাগছে সেই সাথে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।

টাইম মেশিন যেন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল অর্ধ-যুগ আগে, যেদিন তমাকে প্রথম দেখল সে। কলেজে ক্লাস এর প্রথম দিন। চেহারা আহামরি কিছু নয়, তবে ভাল ক্লাসিকাল গান করে। অসহ্য! প্রথমদিন টিচাররা কিছু পড়াচ্ছেন না। পরিচিত হচ্ছেন সবার সাথে।

সেই সাথে টুকটাক কো কারিকুলার আক্টিভিটিজ দেখছেন, যেগুলো ক্লাসে পারফরম করা যায় আর কি। এতে তমার ডিমান্ড সবচেয়ে বেশি। ওহ হো, ভুলেই গেছি সে আবার ভাল কবিতাও আবৃতি করে। নাচটা জানলে প্যাকেজ ফুলফিল হত, টিপ্পনি কাটার সাথে সাথেই সুমিতকে দাড় করালো ম্যাম। বেশ একটা ঝাড়ি খেল ক্লাসের হারটধ্রুব (শুধুই ছেলেদের কাছে, মেয়েদের সাথে তার রিলেশন হাই, হ্যালো পর্যন্তই।

কোন কো কারিকুলার আক্টিভিটিজ বলতে গেলে তার নেই। তবে সব কিছুতেই আছে সে। ইদানিং রক ব্যান্ড এর সাথে যোগ দেয়ার কথা চিন্তা করছে, কিন্তু আশায় গুরে-বালি। মা’কে বলার সাথে সাথেই মা গোল টেবিল বৈঠকে তা উপস্থাপন করলেন। ফলাফল যা হবার তাই।

বাবা এক কথায় না করে দিলেন। মা নন-স্টপ ঝাড়ি দিতে লাগলেন। কোথায় একটু ভাল রেজাল্ট করার চেস্টা করবে, পরিবারের দায়িত্ত নেবে, তা না! উনি আছেন নিজের ধান্দায়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল সুমিতের, সে জানত মেনে নেবে না।

কিন্তু তাই বলে এত কিছু শোনার মত প্রস্তুতি তার ছিল না। ইস! মাকে বলাই ভুল হয়ে গেছে, এসব কেউ বাসায় বলে! এখন মা সবসময় কড়া নজর রাখবে। তবে বন্ধুদের এসব বলে নি সে। এটা তার ইমেজ এর সাথে যায় না। বাবা অবসর নিয়েছেন বছর খানেক হল, মা গৃহিণী।

পরিবার চলে জমি বর্গা দিয়ে আর মামাদের সাহায্য। বাড়িতে ডিশ নেই, সিডি প্লেয়ার নেই। বিটিভিই একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। তার নিজের চলতে হয় টিউশনি করে। কখনো বন্ধুদের বুঝতে দিত না সে।

সবসময় এড়িয়ে যেত। বেশ মিশুক মেয়ে জুঁই। সে এসে পরিচিত হল এবং তমাকেও পরিচয় করিয়ে দিল সুমিতের সাথে। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। নোট, ক্লাস লেকচার আদান-প্রদান, টিফিনে আড্ডা থেকে আস্তে আস্তে সখ্যতা বাড়তে লাগল।

বিপত্তিটা ঘটালো তমা! ফেয়ার ওয়েল এর দিন সুমিতের হাতে একটি ছোট কাগজ দিল। সুমিত: এটা কি? তমা: পড়ে দেখ, তবে এখন দেখার দরকার নেই। বলেই চলে গেল সে, একবারও ঘুরে তাকাল না। কাগজের ভাঁজ খুলেই অবাক সুমিত। লাভ লেটার, কোন ধরনের রাখঢাক ছাড়াই সরাসরি প্রপোজ।

জাস্ট তিনটি শব্দ। সুমিতের বুকে ডেথ মেটাল বাজা শুরু হয়ে গেছে! বলে কি এই মেয়ে! কোথায় ধনীর দুলালি আর কোথায় সুমিত। কি পেয়েছে সে সুমিতের মাঝে? রাহাত ভাল গিটার বাজায়, সানি ফুটবল-ক্রিকেট ভাল খেলে, সাদমানের জিম করা ফিগার! এসব ছেড়ে তাকে! কিছুদিন আগে কি এক কথা প্রসঙ্গে তমা বলেছিল জুঁইকে, ‘সুমিতকে ভালবাসতে যাব কোন দুঃখে। ভেরি অরডিনারি, ভেরি অ্যাভারেজ একটি ছেলে’। সুমিতও ঠোঁটকাটা বলেছিল, ‘তাতে আমার বয়েই গেল।

ঘুমপাড়ানি গান জুনিয়র স্যারদের শুনাতে বলিস। আর কবিতা! লেখে ছ্যাঁকা-খাওয়া প্রেমিক/প্রেমিকা আর পড়ে! নব্য প্রেমিক/প্রেমিকা’। সহ্য করতে পারে নি তমা উঠে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আজ তমা এটা কি করল? গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন সুমিতের মন। মুখে যাই বলুক তমাকে কিন্তু তার বেশ লাগে।

মিষ্টি একটি মেয়ে। সুমিতকেও তমার ভাল না লাগার কোন কারন নেই। কথা বলার ভঙ্গি বেশ সুন্দর, স্পষ্টভাষী, মিশুক। আড্ডা মাতিয়ে রাখে সবসময়। মুক্ত চিন্তাভাবনার অধিকারী।

উপযুক্ত কমেন্ট করাতে তার জুড়ি নেই, ফলে ক্লাশে বেশ কিছুদিন শাস্তি পেতে হলেও এটা তার জনপ্রিয়তা কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়েছে। এসব অবশ্য সুমিত নিজেও জানে না, কিংবা ভাবে না। ভাববে কি করে? বাড়িতে ফিরার সময় সদর দরজার উপরে তাকালেই ইট-সুড়কি ঝড়ে পরতে থাকে। শৈল্পিক চিন্তা ভাবনার অবকাশ কোথায়! আর প্রেম তো বহুদূরের পথ। এদিকে তমা ভাবছে অন্য কথা, সুমিত ঠিকই বলেছে সেদিন, সে তো নব্য প্রেমিকাই, ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় মুখটা তার।

কিন্তু সেদিন অতগুলো ফ্রেন্ডদের সামনে না বললে কি হত না! আচ্ছা ঠোঁট কাটা ছেলে। সুমিত ভাবছে এরকম একটা মেয়েকে পেলে তার জীবনটা ধন্য হয়ে যাবে। কিন্তু ভালবাসার সুবাস বেশিক্ষণ নিতে পারল না। নাহ! সুমিতরা আসলে এসব পারে না। পিছুটানের সীমারেখা ক্রস করা তাদের পক্ষে সম্ভব না।

অভাব তাদের শৃঙ্খল পরিয়ে রাখে। আর মা যা বলেছে তাতে আর এক পাও এগুতে হবে না। রওশন আরাঃ কোন মেয়ের সাথে কিছু করলে তাকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবি, আর আমার মরা মুখ দেখবি! মা যে কি নিষ্ঠুর! কোন কথাই মুখে আটকায় না। নাহ! ননীর পুতুলকে কোন সুযোগ দেয়া যাবে না, কড়া কথা শুনিয়া দিতে হবে। সুমিত কি পারবে? ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে, কষ্ট দেয়া যাবে না।

তার জন্য ইতিমধ্যে সফট কর্নার তৈরি হয়ে গেছে সুমিতের মনে। এরপর ৩ দিন ক্লাসে এল না তমা। পরে জানতে পারল তার জ্বর ছিল। সুমিত কিছুই বলতে পারল না তমাকে, বিষয়টা এড়িয়ে গেল। তমা বুঝতে পারল উত্তর নেগেটিভ।

সে আর কথা বাড়াল না। আগের রিলেশনে ফিরে গেল। হঠাত একদিন তমার ফোন পেল সুমিত। ম্যাথ নোট নেয়ার জন্য তাড়াতাড়ি যেতে বলল কলেজের সামনে। সুমিত তাড়াতাড়ি কলেজের সামনে গিয়ে দেখে একটা প্যাকেট হাতে তমা দাঁড়িয়ে আছে।

তমাঃ কাল আমার জন্মদিন, এটা পড়ে আসবে। বলে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল তমা। সুমিতঃ মিথ্যে বলে আমাকে এখানে আনলে কেন? তমাঃ সত্য বললে কি তুমি আসতে? কাল আসবে কিন্তু, তুমি তো আবার সব কিছু ভুলে যাও। আর এটা পড়ে আসবে। বলেই চলে গেল তমা।

পরদিন টিউশনিতে হঠাত ফোন এল তার, সাদমান এর কল। সাদমানঃ কই তুই? আমরা কতক্ষণ ধরে বসে আছি তোর জন্য। কোথায় তোরা? তমার বাসায়, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়। বলেই লাইন কেটে দিল সে। চিন্তায় পড়ে গেল সুমিত, এই ড্রেসে যাবে কই যাবে না ভাবতে লাগল।

পার্টি মিস করে না সে, তাই না গেলে বন্ধুরা ক্ষ্যাপাবে তমার নামে। যাওয়ার ডিসিশন ফাইনাল করল সে। ছাত্রকে বলল আজ আর পড়াব না, জরুরী একটা কাজ আছে। নেক্সট ডে তে পড়িয়ে দেবে। তমার বাসায় ঢুকে বুঝতে পারছিল না এটা জাস্ট একটা বার্থডে সেলিব্রেশন।

মনে হচ্ছিল রাজ্যের সব মানুষ আজ এখানে উপস্থিত। ভীরু ভীরু পায়ে এগিয়ে গেল। তমা ছাড়া পরিচিত কাউকে দেখছিল না সে। তমা ব্যাস্ত, সবার সাথে গ্রিটিংস বিনিময়ে। সুমিতকে এক-পলক দেখে আবার গল্প করতে লাগল।

বিপদ যখন আসে তখন সব দিক দিয়েই আসে। কাউকে যে কল দিবে! মিস-কল দেয়ার মত ব্যাল্যান্স ও নেই তার। তমাই এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিল কোথায় আছে সবকটা , কোন দিক দিয়ে যেতে হবে। নিশাতঃ তোর গা... ( বলতে গিয়ে চারদিক তাকিয়ে থেমে গেল) এর জন্মদিন, তুই এলি সব শেষে! একটু পরেই তো যাই যাই করবি। কি যেন আইনটার নাম তোর বাপের? সাদ-মানঃ সান্ধ্যাআইন, চুপ কর বাপ-মা তুলে কিছু বলিস না এখানে।

খাওয়া ভালই হল। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে সন্ধ্যার আগে আগে বাড়িতে ফিরে আসল সে। পরদিন আবার সবাই একত্রিত হল, তমা ছাড়া। তমা আসে নি, হয়তবা ক্লান্ত ছিল তাই। জুঁই এসে সুমিতকে আড়ালে ডেকে প্রশ্ন করা শুরু করল।

জুইঃ তমার দেয়া পাঞ্জাবিটা পড়ে আসলে কি খুব ক্ষতি হত? সুমিতঃ স্যরি, আমি প্রস্তুত ছিলাম না, টিউশনি থেকে সরাসরি যেতে হল তাই...আমতা আমতা করতে লাগল সুমিত। জুইঃ তোকে এতটা কেয়ারলেস ভাবি নি, পাগলি যে কি দেখে পছন্দ করল তোকে! সুমিতঃ আমারও একই প্রশ্ন। জুইঃ ইয়ার্কি করবি না আমার সাথে, আমি তোর ইয়ার লাগি না। সুমিতের সাথে কথা বলার আগে জুঁই কে ফোন করেছিল তমা। তমাঃ সুমিতের কাছে শুনিস তো গতকাল আমার দেয়া পাঞ্জাবিটা পড়ে আসে নি কেন? জুইঃ এটা আমার বলার কি দরকার? তুই নিজেই ওর কাছে ফোন করে শোন! তমাঃ তুই আমার এত দিনের বান্ধবী আর এই কাজটা করতে পারবি না।

জুইঃ জানিনা বাবা, তোর ঢং আর ভাল লাগে না, আচ্ছা যা বলে দেখব। জুঁই ফোন করল তমাকে, শুনে রাগে গা জ্বালা করতে লাগল তমার। এইচ,এস,সি তে রেজাল্ট খারাপ করার পর ভগ্নমনোরথে ঢাকা চলে গেল সুমিত। সেখানে কোচিং করে একটি পাবলিক ভার্সিটিতে কোন রকম মাথা গোঁজার ঠাই করে নিল। তমা সিলেট মেডিকেলে চান্স পেল।

মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করল সুমিত। নির্দিষ্ট কিছু বন্ধু-বান্ধবি দের নাম্বারটা দিল। যার ফলে তমার সাথে কন্টাক্ট বন্ধ হল। ভার্সিটির নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগল সুমিতের। তমার কথা কিছুটা হলেও ভুলে থাকার চেষ্টা করল।

পড়ালেখার দিকে মন দিল, পূর্বের ভুল আর করা যাবে না, ভাবল সুমিত। সেকেন্ড ইয়ার এর শেষ দিকে, ইয়ার ফাইনাল এর ঠিক আগে আগে একটা ফোন এল, অপরিচিত নাম্বার থেকে। মোবাইল এর স্ক্রিন বলছে অপরিচিত, কিন্তু নাম্বারটা দেখেই বুকটা ছলাৎ করে উঠল সুমিতের! মোবাইল বিট্রে করছে তার সাথে, কারন নাম্বারটা সেভ করা নেই। কিন্তু এই নাম্বার থেকে ফোন এলেই হার্ট বিট বেড়ে যেত এক সময়। আজও মেটাল ব্যান্ড বাজা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

সুমিতঃ হ্যালো। তমাঃ ভাল আছ, নিশ্চয়ই। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সুমিতঃ কার সাথে? তমাঃ খানিক নীরবতা...এক ডাক্তারের সাথে। সুমিতঃ এভাবে বলছ কেন? ভাল হয়েছে তো, পেশা এক না হলে স্পাউসদের মতের অমিল হয়।

তমাঃ জ্ঞান নেয়ার জন্য তোমাকে কল করিনি, এটা দেয়ার আমার বহুউউ লোক আছে। [এরপর যে কাজটা করল তমা তার জন্য প্রস্তুত ছিল না সুমিত] তমাঃ ডাস্টারড! বলেই ফোন কেটে দিল। চমকে উঠল সুমিত। মেয়েটা সেই আগের মতই আছে, একটুও বদলায় নি। মতের অমিল হলেই রাগে গজরাতে থাকে, এখন কি করবে উপরওয়ালাই ভাল জানেন।

যা করে করুক, সুমিতের কি? ঠিক ই তো বিয়ে করছে ডাক্তারকে। এসব মেয়েদের কোন ঠিক নেই, তারা সবই পারে। নাচতে না পারলেও তমা ভাল নাচাতে পারে। যাহ্‌! পড়ার মুডটাই নষ্ট করে দিল। জুঁই কে নাম্বারটা দেয়া ঠিক হয় নি, ঝাড়ি দিতে হবে।

নাম্বার বিলিয়ে বেড়াচ্ছে!হাহ! জুঁই কে ফোন দিল তমা। জুইঃ কিছু হলে তুই আমাকে ফোন জ্বালাস কেন? তমাঃ জানি না, হয়তবা মনের জ্বালা উপশম করার জন্য। জুইঃ জ্বালা কমেছে?। তমাঃ কমবে। একটা কাজ কর।

জুঁইঃ কি কাজ? তমাঃ বলছি। সুমিতকে একটা কার্ড দিবি আমার বিয়ের, আর ওই পাঞ্জাবিটা পড়ে আসতে বলবি। জুঁই কার্ড পোস্ট করে ফোন দিল সুমিতকে। জুইঃ এবার আর ভুল কোর না, তাহলে কিন্তু অঘটন ঘটাবে। সুমিতঃ ঠিক আছে।

ফোন রেখে ভাবতে লাগল সুমিত, ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে, তার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিয়ের দিন ফোন বন্ধ রাখল সুমিত। অনেক ভেবে দেখল এভাবে চললে তমা অনেক সমস্যায় পড়বে, শ্বশুরবাড়িতে টিকতে পারবে না। আর ও যেমন পাগল দেখা গেল কি না কি বলে পরিচয় করিয়ে দিল, পুরো অনুষ্ঠান মাটি হয়ে গেল। কমপ্লেইন চলে গেল বাড়িতে।

নাহ! এরকম হতে দেয়া যাবে না। বহু কষ্টে এ পজিশনে এসেছে সে। তার দুর্দিনে তমা কোথায় ছিল? দুই বছর আগেও তো নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিতে পারত, কিন্তু তা তো করে নি, তবে আজ কেন? সুমিত এখন রিয়েলিস্টিক, আবেগের সময় তার নেই। ফোন বন্ধ রাখার ডিসিশনটা কনফার্ম করল সুমিত। এদিকে তমা বেশ কিছুবার ট্রাই করে হাল ছেড়ে দিল।

বুঝতে পারল সুমিতের মনের কথা। তার বুক ভেঙ্গে কান্না আসতে লাগল। কেউ বোঝে না তাকে, মা না, বাবা না, শেষ পর্যন্ত সুমিতও তাকে ভুল বুঝল! তার মতামতের কোন মূল্য নেই। টাকা-পয়সা বাড়ি-গাড়িই কি জীবনের সব! আবার জুঁই কে ফোন দিল তমা। জুইঃ বেচারিকে এবার ক্ষমা কর।

তমাঃ তোদের দুজনকে আর কষ্ট দিব না, সুমিতকে আমার জানাজায় আসতে বলিস অন্তত, আর হ্যাঁ অবশ্যই পাঞ্জাবিটা পড়ে। জুইঃ এসব ভাবনা বাদ দে, নতুন জুটি কেমন চলছে তাই বল। তমা! এই তমা! ফোন রেখে দিয়েছে তমা। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না জুঁই। আন্টি কে ফোন দেবে, নাহ আন্টি কান্নাকাটি করে হুলস্থূল কান্ড ঘটাবে।

তার চেয়ে অপেক্ষা করা ভাল, কিছুদিন পর সব ভুলে যাবে। তারও তো বিয়ের পর হাজবেন্ড কে ভাল লাগত না প্রথম প্রথম। এখন এক-মুহুরত না দেখলে অস্থির লাগে। ভাবতেই লজ্জা লাগে। নিজেকে সান্তনা দিল সে এই ভেবে যে ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। দুজনের যোগাযোগ বন্ধ। সুমিত তার ভার্সিটি লাইফ নিয়ে ভালই আছে। অন্তত গতকাল পর্যন্ত ভালই ছিল।

কিন্তু আজ! এ কি বলছে মেহেদি! ফান করছে না তো? নাহ মেহেদি এরকম ছেলেই না, আর এরকম স্পর্শকাতর একটা বিষয় নিয়ে ...... তমার শ্বশুরবাড়ির ছাদটা আন্ডারকন্সট্রাকশন, চারদিকে এলোমেলো রড দেয়া ঠিক আছে, কিন্তু পড়ে যাওয়ার জন্য কি যথেষ্ট? সাধারণত এসব বাড়িতে কাজের বুয়া, সেই সাথে কাজের মেয়ে থাকে, তমা কেন যাবে শাড়ি নেড়ে দিতে? এটা কি অপমৃত্যু, নাকি খুন? সুমিত নিজ হাতে কি খুন করল না তমাকে? সুমিত কি আজ থেকে স্বাধীন, নাকি সারাজীবন বয়ে বেড়াবে এর শিহরণ? সুমিত থরথর করে কাঁপতে লাগল যেন পৌষের শীত পড়েছে কিন্তু বাইরে গ্রীস্মের খাঁ খাঁ রোদ, সে গ্রীস্মের ছুটি কাটাতেই বাড়ি এসেছে। একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ। ইসলামপুর নিবাসি মিনহাজ-উদ্দিন ও রেহেনা আফরোজ এর একমাত্র কন্যা তমা আজ সকাল ৯ ঘটিকার সময় ছাদ হইতে পড়িয়া ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন......তার নামাজে জানাজা......মরহুমার সকল আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের............ সুমিতের চোখে অশ্রধারা। তার কি দোষ, প্রকৃতি কেন তাকে বরফ-শীতল অভ্যর্থনা জানাবে? তমা তাকে ডাস্টারড বলুক আর কাউয়ারড ই বলুক, তার তো হাত পা বাঁধা।

( সমাপ্ত ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।