আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভালো থাকুন রবি শংকর, অমর হোক ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

গানতো গানই! গানে আবার শোক-দুঃখের আবহ কেন? এমন প্রশ্ন যাদের মনে ছিল, ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট তারা বর্ণে-শব্দে উত্তর পেয়ে যান সে প্রশ্নের! আর ঐ প্রশ্নের উত্তর দেন বিশ্বের দু’জন সঙ্গীতগুরু সদ্য প্রয়াত সেতার বাদক ওস্তাদ রবি শংকর ও মানবতাবাদী গায়ক জর্জ হ্যারিসন। সে প্রশ্নের উত্তর ছিল একটি কনসার্টের মাধ্যমে, ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গানের মাধ্যমে! কনসার্টের অর্থ যেখানে আনন্দ-উন্মাদনায় ভেসে যাওয়া, সেখানে সেই সঙ্গীত কনসার্ট বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয়ের দুয়ারে পৌঁছে দিল অন্য এক অর্থ; মানবতার আর্তি। পৌঁছে দিল ভিন্ন প্রান্তে কাঁদতে থাকা বিশ্ব ভাইয়ের ভালোবাসা! সেই কনসার্ট! সেই সঙ্গীত! সেই শোক! সেই সুখ! সেই ভালোবাসা! সেই শ্রদ্ধার নাম- ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’! মানবতার জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে যেটা ছিল বিশ্বের প্রথম কনসার্ট! একদিন ফ্রায়ার পার্কে রাতের খাবার গ্রহণকালে বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের কাছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভোলা উপকূলে ঘূর্ণিঝড় দুর্গত ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা নির্যাতিত বাঙালিদের আর্থিক সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের জন্য ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর প্রাথমিক পরিকল্পনা উত্থাপন করেন ভারতীয় বাঙালি সংগীতজ্ঞ রবি শংকর। তার পরিকল্পনায় কোনো ধরনের ‘না’ উচ্চারণ না করেই ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর আয়োজনে কাজ শুরু করেন জর্জ হ্যারিসন ও তাঁর সতীর্থরা। কাজে হাত দিয়েই বন্ধুবর্গ ও অন্যান্য সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন হ্যারিসন ও রবি শংকর।

কনসার্টে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের নানাভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন এ দু’জন। একজন জ্যাতিষীর পরামর্শে কনসার্টের তারিখ চূড়ান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে কনসার্ট নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান হ্যারিসন ও রবি শংকর। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে কনসার্টের আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেন হ্যারিসন ও রবি শংকর বন্ধুদ্বয়। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ইউনিসেফের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শুরু হয় কনসার্ট। কনসার্টের দিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর মাধ্যমে যেন নতুন এক ইতিহাস উন্মোচন করা হল উপস্থিত ৪০ হাজার দর্শক তথা বিশ্বের মানুষের কাছে।

পৃথিবীর মানুষ নতুন করে জানতে পারল গান মানে শুধু উন্মাদনা নয়, গান মানেই শুধু সুখের কথা নয়! গানের শোক অর্থও রয়েছে; মানবতার পাশে দাঁড়ানো, নির্যাতিত ভাইয়ের পক্ষে প্রতিবাদের গর্জন তোলা! কনসার্ট মানে অধিকার আদায়ের মিছিলও! এই কনসার্টের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) বাংলাভাষী জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারদের সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়নের কথা জানতে পারে সারা বিশ্ব! এই কনসার্টের হাত ধরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ দাঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে! এ কনসার্টের মাধ্যমে পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন স্বাধীনচেতা বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে। এই কনসার্টের কারণে বিশ্বের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও দুর্বল হতে খাকে চেঙ্গিসীয় পাকিস্তানিরা। মানবতার পাশে দাঁড়াতে হ্যারিসন-রবি জুটির এই আয়োজনে আরও অংশগ্রহণ করেন বিখ্যাত তবলা বাদক ওস্তাদ আল্লা রাখা, সরোদ বাদক আলি আকবর খান, লিজেন্ড ব্যান্ড বিটলস এর ড্রামার রিঙ্গো স্টার, ‘ব্লেয়িন ইন দ্যা উইন্ড’ খ্যাত বব ডিলান, ‘টিয়ার্স অব হ্যাভন’ খ্যাত এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, লিও রাসেল, হ্যারিসনের ব্যান্ড দল ব্যাডফিঙ্গারসহ তৎকালীন সময়ের স্বনামধন্য সংগীত শিল্পীরা। অপরাহ্ন ও সান্ধ্য দু’পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয় সেতারবাদক রবি শংকর ও সরোদবাদক ওস্তাদ আলি আকবর খানের যন্ত্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। তারপর প্রায় ১৮ টি গান পরিবেশন করেন উপস্থিত সঙ্গীতশিল্পীরা! হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি উপস্থিত দর্শকদের আলোড়িত করে তোলে।

কমপক্ষে পঁচিশ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করলেও সেই কনসার্ট থেকে অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার তহবিল সংগৃহীত হয়। এই কনসার্টের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা ইউনিসেফ অর্জিত অর্থ বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করে। কনসার্টের কিছুদিন পর অনুষ্ঠানের অডিও সংকলন বের হয় ১৯৭১ সালে। ১৯৭২ সালে এই কনসার্টকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও বানানো হয়। ২০০৫ সালে চলচ্চিত্রটিকে একটি তথ্যচিত্রসহ নতুনভাবে ডিভিডি আকারে প্রকাশ করা হয়।

তবে কনসার্টের প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশের শরণার্থী তহবিলে জমা দেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিলো। অ্যাপল কর্পোরেশনের একজন নির্বাহী কর্মকর্তা এ্যালেন ক্লেইন জোর দিয়ে বলেন, তাঁর কোম্পানী বিজ্ঞাপন, উৎপাদন ও বিপনন খরচবাদে অ্যালবাম বা চলচ্চিত্র হতে কোনো অতিরিক্ত লভ্যাংশ নেয়নি। কিন্তু ১৯৭২ সালে নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে, কনসার্ট সংশ্লিষ্ট অনেক আয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি। সব ভালো কাজেই তর্ক-বিতর্ক থাকে! যেমনটি আছে `দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ` নিয়েও। তবে ওস্তাদ রবি শংকর মানবতার জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য বন্ধুবর হ্যারিসনের সাথে যা করে গেলেন তা চিরদিন মনে রাখবে মানবতা তথা বাংলাদেশ! ভালো থাকুন ওস্তাদ রবি শংকর! ভালো থাকুন জর্জ হ্যারিসন! ভালো থাকুক বাংলাদেশ! পৃথিবী তথা মানবতার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকুক `দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ`!  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.