লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই,তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। (http://www.ishakkhan.blogspot.com)
কী ব্যাপার, দরজা খোলা কেন? আমি তো খেয়ালই করি নি। ওঘর থেকে শব্দ আসছে যে।
আসুক, আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। আমি জবাব দিই।
এটা একটা কথা হল? দরজা লাগিয়ে দিচ্ছি। ওঘরেই আছি, কিছু লাগলে বোলো। মন দিয়ে পড়, সামনে পরীক্ষা।
বাবুকে কোলে করে মানুষটা অন্য ঘরে চলে যায়, আমাকে নিরিবিলিতে পড়ার সুযোগ করে দিতে।
যে মানুষটার কথা বলছি, সে আমার স্বামী। বিয়ের পর থেকে সবকিছুতে খবরদারী করছে, আগে আমার বাবা-মা যেগুলো করতেন!
হ্যাঁ, বিয়ের পরপরই অনেক মেয়ের মত আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় নি। আমার স্বামীটি উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। দরজা লাগিয়ে পড়, অন্য কোন দিকে মন দিও না – সবসময় নানা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে।
বোধহয় এতদিন মনে মনে ওর ইচ্ছে ছিল কাউকে প্রাণ ভরে উপদেশ দেবে, আমাকে পেয়ে সব একবারে ঝেড়ে দিচ্ছে।
মানুষটা অদ্ভুত। অদ্ভুত এবং ভালো, অন্তত আমার কাছে। বিয়ের পর পড়াশুনা চালিয়ে যাবো শুনে একটুও মুখব্যাদান করে নি, বরং খুশিই হয়েছে। মনে হয়, আমি ভালো কিছু একটা করে ফেললে আমার চেয়ে সে-ই বেশী খুশি হবে।
অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার পর সে যেভাবে সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছে, অনেক পিতামাতা তাদের একমাত্র সন্তানের স্ট্যান্ড করার খবরেও এত মিষ্টি বিতরণ করেন না।
আমি প্রথমদিকে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। সন্তান পেটে আসার পর ভেবেছিলাম, সবদিক ঠিক রেখে পড়া চালিয়ে যেতে পারবো তো? ভয়টা কেটে গেছে বাবু হবার পরপরই। এই মানুষটা আমাকে বুঝতেই দেয় নি যে মা হয়েছি, বাবুর খাওয়াদাওয়া, গোসল করানো, ন্যাপি বদলে দেয়া থেকে তাবৎ কাজের দায়িত্ব সে নিয়েছে। অফিস থেকে ফিরেই বাবুকে কোলে নিয়ে নেয়, আমাকে আর কাছে ঘেঁষতে দেয় না, বলে পড়তে যাও।
রাতবিরেতে ঘুম ভেঙে বাবু জেগে উঠলে সে-ই নানা কায়দা করে ওকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
সৌভাগ্যবান কিছু নারী এদেশে আছে, যারা নিজের স্বামীর কাছ থেকে সবকিছুতে দারুণ সাপোর্ট পায়। আমি সেই নারীদের একজন। এই মানুষটার ওপর ভর করেই এখন বড় বড় স্বপ্ন দেখছি, অনেক দূর যাবার আশা করছি। ওর যে ব্যাপারটা আমাকে খুব আনন্দ দেয় তা হল, আমার কথা সে মনোযোগ দিয়ে শোনে।
এমনিতে মানুষটা খুব সাদাসিধে। কিন্তু ছোটখাটো কিছু ব্যাপার, নানাক্ষেত্রে মানুষটার আন্তরিক সাহায্য আমাকে সত্যিই স্বস্তি দেয়; মনে হয়, ওর ওপর নিশ্চিন্তে ভরসা করা চলে।
মাঝে মাঝে অবশ্য ওর কাণ্ডকারখানা হাস্যকর রূপ নেয়। সেদিন বড় মাছ রান্না হয়েছিল। সবাই একসাথে খেতে বসেছি।
সে গম্ভীর মুখে চামচ দিয়ে আমার পাতে মাছের মাথাটা তুলে দিলো। বলল, ভালোমন্দ না খেলে মাথা “খুলবে” না।
আমার খুব হাসি পেয়েছিল, কিন্তু মানুষটার মুখ দেখে মনে হল সে বেশ সিরিয়াস, কাজেই ওকে খুশি করার জন্য মাছের বিচ্ছিরি মাথাটা খুব আয়েশ করে চিবোতে হল। আমার মানুষটা এখনো আগেকার যুগের লোকদের মত, তার মতে, মাছের মাথাটা হল সবচেয়ে ভালো টুকরো। নিজে কখনো খায় নি, তাই জানে না যে মাছের মাথায় কিছুই থাকে না!
আমার নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে।
রোজ সে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসে, আর ক্লাস শেষে বাইরে বেরিয়ে দেখি সে বাবুকে কোলে নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝে লজ্জায় পড়ে যাই, যখন দেখি ওর কোলে বাবু, আর এক হাতে একটা ডাব, তাতে স্ট্র ডোবানো, আমার জন্য!
মানুষটার আচরণ ঠিক আমার বাবার মত। যেন আমি ওর বউ না, মেয়ে। বাবু আস্তে আস্তে বড় হবে, যখন স্কুলে ভর্তি হবে, তখন ওর সাথে কেমন করতে হবে তাই বোধহয় মানুষটা আমার ওপর প্র্যাকটিস করে নিচ্ছে।
বাবা-মা তো রোজই ফোন করেন।
বলেন, তোর কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? যে গোমড়ামুখো জামাই।
শুনে আমার বেশ রাগ লাগে। হ্যাঁ, আমার মানুষটা নিজের মধ্যে বেশ গুটিয়ে থাকে, একজন পুরুষ নিজের স্ত্রীর সাথে অন্তত বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকে যেসব আদিখ্যেতা করে সেসবের কিছুই তার মধ্যে নেই। কথাবার্তা খুবই কম বলে। তবে সে মোটেই সেন্স অব হিউমার ছাড়া নয়।
আমার এক্সাম হয় কিছুদিন বাদে বাদেই। তখন দেখি, মানুষটার টেনশন আমার চেয়ে বেশী। ড্রয়িংরুমের টিভির আওয়াজ আমার পড়ার ঘর পর্যন্ত আসে না। তবুও মানুষটা একেবারে শব্দ ছাড়া টিভি দেখে, ফিসফিস করে কথা বলে, পা টিপে টিপে হাঁটে। পুরো বাসায় একটা ভূতুড়ে নীরবতা নামিয়ে আনে, শুধু আমার সুবিধের জন্য।
কেউ চেঁচিয়ে কথা বললে বেশ করে ধমকে দেয়। সত্যি বলতে, ব্যাপারটা আমি বেশ কৌতুকের সাথে উপভোগ করি। আহা, মানুষটা আমার জন্য এত ভাবছে, যা করলে শান্তি পায় তাই করুক। পরীক্ষা শেষ হলে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, যেন ভারী একটা দায়িত্ব আমার ঘাড় থেকে নয়, ওর ঘাড় থেকে নেমে গেছে।
পরীক্ষার দিনগুলোতে যখন সে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায়, তখন তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর মুখে বলে, মাথা ঠাণ্ডা, মাথা ঠাণ্ডা।
মাথা গরম করলেই কিন্তু সব শেষ। যেটা সহজ, সেটা আগে অ্যান্সার করবে। আর রোল নম্বর যেন ভুল কোরো না।
সব গৎবাঁধা উপদেশ। কোত্থেকে মানুষটা এসব মুখস্ত করেছে কে জানে।
আজ পর্যন্ত দাঁড়িকমা ওলটপালট করে নি। শুনে হাসি, তারপর পরীক্ষার হলের দিকে রওনা দিই। পেছনে তাকালেই দেখি, মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর কোলে বসে বাবুও মুখে আঙুল পুরে তাকিয়ে আছে। আমার দু’জন সঙ্গী।
আমি জানি, শেষ পরীক্ষাটিতেও খুব ভালো করবো আর অনেকদূর যেতে পারবো।
সেজন্য অনেকটাই কৃতিত্ব পাবে আমার এই মানুষটা। বন্ধুকে কি প্রিয়জনকে ধন্যবাদ দেয়ার দরকার হয় না। তবে আমি মনে মনে মানুষটাকে অনেকবার করেই ধন্যবাদ দিই।
কোনকালেই নাকি পুরুষ একা জয়ী হয় নি। নারীর প্রেরণা আর শক্তি পেছনে থাকলে তবেই নাকি জয়ী হয়েছে।
আমি মনে করি, একই কথা নারীদের ক্ষেত্রেও সত্য। যখন একজন পুরুষ একজন নারীর সাথে খুব আন্তরিকতা নিয়ে দাঁড়ায়, সাহায্য করে, সেই নারীটির শক্তি অনেক অনেকগুণে বেড়ে যায়।
আমার বান্ধবীরা মানুষটাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে ছাড়ে না। বলে, তোর বডিগার্ড, অষ্টপ্রহর লেগে আছে তোর সাথে। এই বয়সেও এত দেখাশোনা করতে হয়? তুই কি বাচ্চা মেয়ে?
না, আমি বাচ্চা মেয়ে নই।
পূর্ণবয়স্ক এক নারী। তারপরও চাই, মানুষটা আমাকে এভাবে অষ্টপ্রহর দেখে রাখুক।
পড়াশোনার ব্যস্ততার মধ্যেও খবরের কাগজটা নিয়মিত পড়ি। তাতে মাঝে মাঝে খবর আসে, স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে স্বামী। কারণ? তেমন বড় কিছু নয়, কয়েক হাজার টাকা।
সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রে আসে কাউন্সেলিং সাইকোলজির আপার কাছে কত চিঠি, তাতে কত দুঃখ করে লেখা থাকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারীদের কথা। আপা, আমার স্বামী আমার ঠিকমতো দেখাশোনা করে না, সন্তানকে অবহেলা করে, আমায় নানারকম শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন করে। কেউ বা চিঠি পাঠায়, আপা, আমার স্বামী আরেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। কেউ চিঠি দেয়, আমার স্বামী আমার অনুমতি ছাড়া আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে। আমাকে বের করে দিয়েছে।
এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? কখনো কখনো আর্টিকেল আসে, ব্যক্তিত্বের সংঘাতে ভেঙে গেছে আধুনিক এবং শিক্ষিত পরিবার, যে পরিবার গড়ে উঠেছিল দুটো তরুণ প্রাণের ভালোবাসায়। কোথাও লেখালেখি হয়, পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারাচ্ছে কত নারী। পুরুষদের গালিগালাজ করে একেবারে ধুয়ে দেয়া হয়, পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা হয়। পুরুষকে বলা হয় পশু। অবশ্য ঐ বলা পর্যন্তই, লেখালেখি পর্যন্তই।
তখন আমার ইচ্ছে করে, সবার সামনে আমার এই মানুষটিকে নিয়ে দেখাই। বলি, এই দ্যাখো, সব পুরুষ এমন নয় কিন্তু।
মুখ ফুটে সে আজ পর্যন্ত বলে নি, ভালোবাসি। তারপরও আমি জানি, সে নারী হিসেবে আমাকে শ্রদ্ধা করে এবং ভালোবাসে, ছোট করে দেখে না মোটেই।
আগেই বলেছি, মানুষটি নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে।
আমি ভালো করে পড়াশোনা করি, মাথা উঁচু করে দাঁড়াই, এ ছাড়া আমার কাছে তার কোন দাবী আছে বলে মনে হয় না। সর্বক্ষণ আমার সুবিধে-অসুবিধে দেখছে। কখনো কখনো ওর দেখাশোনা হয়তো একটু মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, খবরদারী মনে হয়। তবুও এই মানুষটিকে নিয়ে আমি গর্ব বোধ করি। যখন দেখি, হাতে করে ডাব নিয়ে সে পরীক্ষার হলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তখন লজ্জা পাই একটু, কিন্তু বুকের কাছটায় জমাট বেঁধে ওঠে একটা অন্যরকম আনন্দ।
বেশীরভাগ মেয়েরই জোটে এমন স্বামী, যে স্ত্রীকে দেখে ভোগের উপকরণ হিসেবে। অনেক স্বামী নিজের স্ত্রীকে দেখে সমস্ত ক্রোধ-ক্ষোভ উগড়ে দেয়ার জায়গা হিসেবে। অনেকে দেখে কর্তৃত্ব ফলানোর একটা উপায় হিসেবে। কেউ স্ত্রীকে দেখে বাচ্চা পয়দা করার আর সন্তান লালন করার একটা যন্ত্র হিসেবে। খুব অল্প স্বামী হয়ে উঠতে পারে ভালো বন্ধু।
আমি মনেপ্রাণে চাই, আমার মানুষটির মত স্বামী যেন প্রতিটি মেয়ে পায়।
(২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।