ছোট্ট সময় যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন রচনা লিখতে বলা হত তখন মুখস্থ কথাগুলো লিখে ফেলতাম- 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে তরুণী বঁধুর সিঁথির সিঁদুর মুছিয়ে দিয়ে বাংলা এনেছে স্বাধীনতার রক্তলাল গোলাপ। ' যখন একটু একটু করে অন্যদের সাথে মানুষ হচ্ছি তখন পড়ার গন্ডিটা প্রসারিত হয়েছে। যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক লোমহর্ষক কাহিনী শুনেছি। যুদ্ধভিত্তিক ছবি দেখেছি। ভেতরে ভেতরে শিহরিত হয়েছি।
সব বয়সের মানুষ একযোগে নেমেছিল একাত্তরে। সবার মন-প্রাণ যেন একাকার। অন্য কোন দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যখন পড়ি তখন সেখানে দেখতে পাই অস্রসজ্জিত প্রশিক্ষিত বিশাল সামরিক বাহিনীর প্রভাব। সেদিক দিয়ে ভাবলে আমাদের তেমন প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী ছিলনা। সম্পূর্ণ নিরস্র মানুষ সংগঠিত হয়ে যুদ্ধ করেছে।
সেসময় গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে,নাটক করে জনমত তৈরী করে যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।
মু্ক্তিযু্দ্ধে আমাদের সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ অপরিসীম। তাদের ঋণ কোনদিন পরিশোধ হবার নয়। একাত্তরে দেশের এবং দেশের বাহিরের যারা আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছিলেন, তাদের কথা যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে সেটা হবে ক্ষমাহীন অকৃতজ্ঞতা। আমরা এখন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে বসবাস করছি।
চরম উৎকন্ঠায় কাটছে আমাদের প্রতিটা ক্ষণ। নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ দাস খুন হলেন চরম নৃশংসভাবে। এই বিজয়ের মাসে বিশ্বজিৎ দাস কী (!) বিজয় দেখে গেলেন? কী অপরাধ ছিলো তার? এমন দৃশ্য দেখবো বলেই কি এতগুলো বছর অপেক্ষার প্রহর গুনেছি! আমাদের আর কত প্রাণ দিতে হবে? আর কত মায়ের বুক খালি হবে! আর কত স্বজনের কান্নায় ভারী হয়ে উঠবে আকাশ বাতাস!!?
আমি একজন মু্ক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে জানি। যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেতে অস্বস্তিবোধ করেন। একাত্তরের যুদ্ধে উনার বয়স ছিল ছাব্বিশ।
বয়স একটু হয়েছে। দুচোখের একটাতে ছানি পড়া। কানেও কম শোনেন। কথাপ্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন - 'মরনের সময়ই মরি নাই। আর অহন বাইচ্চা মইরা আছি।
যু্দ্ধ করছিলাম এই দ্যাশ দ্যাহনের লাইগ্যা না। কবে যে মরুম!!' উনার মত আরো অনেক যোদ্ধা নিশ্চয়ই আছেন যা আমাদের হিসেবের বাহিরে। চোখে ভাসে তার সেই হতাশ মুখ আর করুণ আর্তনাদ।
কয়েকদিন ধরে পত্রিকায় যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে হরেকরকম লেখা হচ্ছে। একদিন সকালে পড়লাম- একাত্তরের একুশে নভেম্বর গভীর রাতে বিবাড়িয়া কারাগারের ৩৮ জনকে শহরের পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা।
আর এই গণহত্যা হয়েছে জামায়াত ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের নির্দেশে।
এমন যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা অনেক। অনেক লোমহর্ষক কাহিনী আছে তাদের। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি জাতীয় কর্তব্য। অতি দ্রুত এই কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে।
কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমি আশাবাদী, আমাদের স্বপ্ন সার্থক হবে। আমি 'একাত্তরের চিঠি' পড়েছি। চিঠিগুলো পড়ে ভীষণ কান্না আসে। আমাদের এক সাংবাদিক ভাই বলেছিলেন- 'অশ্রুও কখনো কখনো ক্ষারের মত কাজ করে।
আমাদের জাতীয় আত্মার ময়লা ধুতে এমন ক্ষার এখন অনেক প্রয়োজন। ' উনার কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই সত্যিই প্রয়োজন এমন ক্ষারের।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছর শেষ হচ্ছে। যেকোন জাতির জীবনে এই দীর্ঘ বছর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মাঝে আমরা কতটা বিকশিত হতে পেরেছি? কতটা সু্স্থিত হতে পেরেছি? কতটা পরিপক্কতা এসেছে আমাদের নেতৃত্বে? আমরা কি হৃদয় দিয়ে দেশটাকে ধারণ করতে পেরেছি? এরকম হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত ভেতরটা তবুও প্রশান্তি খোঁজে।
স্বপ্ন দেখে সুন্দর দেশের। আমাদের যুদ্ধ এখনও যেন শেষ হয়নি। প্রতিনিয়ত সবকিছুর সাথেই চলছে বিরামহীন যুদ্ধ। এর মাঝেই খুব সাধ হয়, একটু ফুরফুরে মেজাজে বেঁচে থাকতে। শকুনহীন স্বর্ণালী দেশে, আমার স্বপ্নের দেশে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।