লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। এভাবেই দূরে সরে যাই
মোহাম্মদ ইসহাক খান
বাবুল আর জসিম। দুই বন্ধু।
ছোটবেলায় তারা একসাথে অনেক বাঁদরামো করেছে, স্কুলে গেছে, স্যারের কানমলা খেয়েছে, পুকুরে সাঁতার দিয়েছে, পাড়াপড়শির আমগাছে ঢিল মেরেছে, পাখির বাসা থেকে বাচ্চা পেড়েছে।
তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। কলেজে তারা একসাথে ছিল, ছিল ভার্সিটিতেও। তারপর কর্মজীবনের ডাকে দুজন দুদিকে চলে গেছে।
এখন তারা প্রৌঢ়।
তাদের আলাদা আলাদা সংসার হয়েছে। ছেলেমেয়ে হয়েছে, নিজেদের কাজ নিয়ে তারা নিজেরা যেমন ব্যস্ত, তেমনি ছেলেমেয়েরাও ব্যস্ত। কখন যে দুই প্রাণের দোস্ত আস্তে আস্তে দূরে সরে গেছে, টেরও পায় নি তারা। সম্পর্ক এমন জিনিস, খুব ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে সেটার বাঁধন আলগা হয়। আর একবার আলগা হয়ে গেলে পুরনো সুরটি আর ফিরে আসে না, কোথায় যেন তার কেটে যায়, চাইলেও ফিরে পাওয়া যায় না।
যদি বা ফিরে পাওয়াও যায়, সে বড় সহজ কাজ নয়।
জসিম ঢাকায় আছে। সে কাজের অবসরে মোবাইল ফোন টেপাটেপি করতে পছন্দ করে। আজও সে তাই করছে। দেখতে দেখতে সে নিজের কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে যায়, স্ক্রল করে নামতে থাকে, দেখতে থাকে কার কার নাম সেভ করা আছে ফোনে।
বাবা, বাবু, বাবুল ... ... থমকে যায় জসিম। এই বাবুল কোন বাবুল? মনে করার চেষ্টা করে সে। দু'চোখ কুঁচকে, খুব গভীরভাবে সে চিন্তা করে, এই বাবুলটা কে?
খানিকক্ষণ পর তার মনে পড়ে, আরে, এই বাবুল তো সেই বাবুল, যার সাথে আমি জীবনের অর্ধেকটাই একসাথে কাটিয়েছি, কত আনন্দমাখা ছিল সেই দিনগুলো। এখনো চোখ বুজলে খুব আবছা হলেও দিনগুলো দেখা যায়। ফুটবল নিয়ে কাদায় গড়াগড়ি করে খেলা, কাড়াকাড়ি করে টিফিন খাওয়া ... ...।
আশ্চর্য, ওকে মনে করতে আমার এত দেরী হল?
জসিমের আবেগ ছলকে ওঠে। সে বাবুলকে ফোন করতে সবুজ বোতামটা প্রায় টিপে দিয়েছিলো, কিন্তু সহসা সে চুপসে যায় আবার।
সে ভাবে, এই যে এতবছর গেলো, কই, বাবুল তো আমাকে কোনদিন একটা ফোন করেনি। হয়তো খুব ব্যস্ত। কী দরকার বাপু, ওকে ফোন করে বিরক্ত করার? আর আমারই বা কী ঠেকা পড়েছে যে সবার কাছে ফোন করে আমাকে খোঁজখবর নিতে হবে? আমি কেন প্রথমে আগে বাড়বো? অন্য কেউ তো আমার খোঁজ নেয় না, কাজেই আমিও নেবো না।
জসিম হাত থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখে।
***
বাবুল থাকে ঢাকারই আরেক প্রান্তে।
রাতের খাওয়া শেষ করে ফোনটা নিয়ে অ্যালার্ম দিতে গিয়ে হঠাৎ তার ইচ্ছে হয় একটু গুঁতোগুঁতি করতে। সে জসিমের মতোই ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে যায়। জসিম নামটা চোখে পড়ে তার।
আরে, এটা সেই জসিম না? একটা ফোন করে দেখলে কেমন হয়? তারও বুড়ো আঙুলটা সবুজ বোতামে পড়ে গিয়েছিলো প্রায়, কিন্তু কেউ যেন সেই হাতটা থামিয়ে দিলো।
বাবুল ভাবে, আমি কেন ফোন করতে যাবো? জসিম তো এত বছরে একটা ফোন করে আমার কোন খোঁজ নেয় নি? আমার তো কোন দায় পড়েনি? কেউ আমার খোঁজ নেয় না, আমি কেন সবার খোঁজ নেবো?
হাত থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখে বাবুল। ঘুমোনো যাক, সারাদিন অনেক ধকল গেছে। জসিম থাকুক জসিমের মতো, আমি থাকি আমার মতো। ওকে ছাড়াই তো আমার চলে যাচ্ছে, খারাপ তো নেই আমি।
একটা সময় বাবুল এটা ভাবতেও পারতো না।
***
একটি সবুজ বোতামে চাপ এই দুই বন্ধুকে আবার এক করে দিতে পারতো। কিন্তু নিয়তি অনেক মজার মজার কাজ করে। অতি ক্ষুদ্র, চোখের দেখার অগোচরে, কিন্তু খুব ভাবানোর মতো। বন্ধন আপনা থেকেই জোড়া লাগে না, নিজেকেই এক পা এগিয়ে যেতে হয়, হারানো বন্ধুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে নিজেকেই সবুজ বোতামটা টিপতে হয়।
অন্য কেউ আমার দিকে এগিয়ে আসবে, সেই আশায় বসে থাকলে আশা অপূর্ণই থেকে যায়। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া এই ইটকাঠের শহরে অনেকের অনেক বন্ধু আছে; যারা সবুজ বোতামটা টিপতে দ্বিধা করে, দেরী করে, যারা এভাবে দূরে সরে গিয়ে দূরেই রয়ে যায়; কাছে আর আসা হয় না।
(১ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।