খোদ মদিনা মোনওয়ারায় বাদশা ফাহাদ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজের ফলাফল খুবই সুক্ষ্ণভাবে সমগ্র ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সৌদি সরকারের অর্থানুকূল্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক শ্রেণীর মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে। কওমী মাদ্রাসা নামে পরিচিত উক্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন দেশের সরকারেরই নিয়ন্ত্রন নেই। সরকারী শিক্ষানীতিকে তোয়াক্কা না করে ওহাবী ভাবধারায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের বিরুদ্ধে কোন দেশেই টু শব্দ নেই। কওমী মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার নামে শুধু বিশুদ্ধ আরবী শিখানো হয়।
ভাবখানা এ রকম যেন, মদ্দ মাখরাজ তাজবীদ শিক্ষাই ইসলাম। সকল কওমী মাদ্রাসাই ওহাবী ভাবধারায় পরিচালিত হয়। সৌদী শাহেনশাহগণ কর্তৃক পরিচালিত বা তাদের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত এনজিও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অধিকাংশ কওমী মাদ্রাসায়ই ওহাবী মতবাদ শিক্ষা দেওয়া হয়। এ’সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপ্রাপ্তদের জ্ঞানের বহর দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। পৃথিবী যে গোলাকৃতি এটাই অনেকে জানেনা।
জাগতিক জ্ঞানবর্জিত শিক্ষিতগণ পারলৌকিক কোন সমৃদ্ধি অর্জন করে কিনা তা’ ভাবনার বিষয় হলেও বর্তমান হাইটেকের যুগে তারা অচল।
বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাদপদ একটি ধর্মভীরু জনগোষ্ঠী সমৃদ্ধদেশে রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্রসহ সরকারী অনুগ্রহপ্রাপ্ত ওহাবীদের অনুগামীগণ সমাজের সকল পর্যায়ে তাদের আধিপত্যকে সুদৃঢ় করে মজবুত অবস্থানে সমাসীন। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ ওহাবী মতবাদকে নির্দ্বিধায় পাঠ্যক্রমভূক্ত করে আপামার ধর্মপ্রাণ মানুষের মগজ ধোলাই অব্যাহত রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের একজন শিক্ষক একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’ নামক একটি অনুষ্ঠানে প্রতিদিনই অবলীলায় একশত ভাগ নির্জলা মিথ্যা কথা এবং বিকৃত ইতিহাস এমন ভাবে প্রচার করে যাচ্ছিল, যেন সে স্বয়ং রাসুল সাঃ-এর যামানায় উপস্থিত থেকে সার্বিক বিষয়াদি প্রত্যক্ষ করেছে।
মানুষের আজন্ম লালিত শিক্ষা, অভ্যস্থ জীবনাচার, সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি অবকাঠামোর অভ্যন্তরে প্রবিষ্ঠ চেতনা, স্থুলদর্শী মনোবৃত্তি, মিথ্যাচারের গভীর সমুদ্রে নিমজ্জন, ঐশি গ্রন্থ আল কোরানের ব্যাখ্যা অনুধাবনে অক্ষমতা, বিকৃত ইতিহাসের আবর্জনায় উদরপূর্তি প্রভৃতি কারনে ওহাবীবাদের করাল থাবা হতে নিষ্কৃতি লাভ এক সুকঠিন দুর্লভ প্রাপ্তি।
আমরা যারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, আমাদের চেতনায় বস্তুবাদিতার শিকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। আমরা সাধারণতঃ কোনভাবে সামাজিক দায়িত্ববোধ হতে ধর্মকর্ম সমাপ্ত করে পার্থিব ভোগ বিলাসীতায় নিমজ্জিত হয়ে থাকতে অধিক পছন্দ করি। ধর্মের গভীর বিশ্লেষণে নিজেকে না জড়িয়ে প্রচলিত প্রথায় কোন রকম দায়সারা ভাবে ইবাদত শেষ করে সমাজের চোখে ধার্মিক সাজার মানসে প্রচলিত প্রথাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এর প্রকৃত অন্তর্গত কারন একাধিক। যেহেতু স্রষ্টার মনোরঞ্জন অপেক্ষা সামাজিক মনোরঞ্জন অধিক প্রাধান্য প্রাপ্ত, সেহেতু সমাজের প্রচলিত মূল স্রোতের বিপরীতে অবস্থানের ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে সার্বিক সচেতনতা অবলম্বনে আমরা দৃঢ়বদ্ধ থাকি।
আমাদের দেশে বিদ্যমান আলিয়া মাদ্রাসা সমূহে যারা পড়াশোনা করে, তারা অধিকাংশই দাখিল বা আলিম পাশ করার পরই কলেজে ভর্তি হয়ে পাজামা জোববা টুপী পরিত্যাগ পূর্বক শার্ট প্যান্ট পরিধান করে আধুনিক সমাজে একাকার হয়ে যায়। আলিয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি দ্বান্দ্বিক চেতনা বিরাজমান। কারন, মাদ্রাসার আধুনিক সিলেবাসে ধর্মের পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার অবকাশ রয়েছে বিধায় ধর্ম ও বিজ্ঞানের সাংঘর্ষিক বিষয় সমূহ কোমলমতি ছাত্রদের মনোজগতে এক বিরুপ অনুভূতির উন্মেষ ঘটায়। অবচেতন মনেই তারা ধর্মের গন্ডির বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকে। পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার নিরিখে জাগতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা চলমান কালচারের সংগে একাত্ম হয়ে যায়।
তবে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিদ্যায়তনেই ওহাবীবাদ শিক্ষাকে ইসলাম শিক্ষার সমার্থক বিবেচনা করে অবলীলায় ওহাবী মতবাদ বিস্তার করা হচ্ছে।
খারিজী বা কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষিত আলেমগণ শিক্ষার্জনের প্রথম দিন হতেই নিজেদেরকে একমাত্র হক সিলেবাসের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ইহ ও পারলৌকিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্ত একমাত্র দ্বীনি এলেমদার বিবেচনা করে তাদের সামগ্রিক কর্মকান্ডকে পরিচালিত করে থাকে। এমন কী তারা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকেও বাতিল ও কুফরী আকিদা সম্পন্ন মনে করে থাকে। ধর্মীয় ভ্যালুজের ভিতর এত ফাঁক ফোকর সাধারণ মানুষের বিবেচনা বহির্ভূত। তারা শুধু দেখে আলেম সমাজ শতধা বিভক্ত।
আলিয়া মাদ্রাসার আধুনিক সিলেবাস বহুলাংশে জাগতিক বিষয়াদির সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় ফাজিল বা কামিল পাশ করার পর অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চতর ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়ে প্রতিযোগিতা মূলক চাকুরীর বাজারে নিজেদের ঠাঁই দখল করে নিচ্ছে।
অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলাম ধর্মেও বহু মত ও পথের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু মুসলিম জাতি আজ দিশেহারা। ধর্ম নিয়ে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, আত্মহনন, নির্বিচার হত্যা, রক্তপাত, জবরদস্তি, জুলুম ইত্যাদি বর্তমানের চালচিত্র। এই যে মিথ্যাচার, বিবেক বর্জিত সীমাহীন কুৎসা, বস্তুবাদ এবং নাস্তিক্যবাদের সমপর্যায়ের ধর্মাচার, এর পরিণতিতে আল্লাহ সোবহানা তা’লা অবশ্যই পরকালে প্রতিদান প্রদান করবেন।
একমাত্র আল্লাহ রাববুল আলামিনের কৃপা ছাড়া এই অন্ধকূপ হতে উদ্ধারের কোন উপায় নেই।
ওহাবীদের প্ররোচনায়, সমর্থনে এবং অর্থায়নে ভারতের দেওবন্দে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম মাদ্রাসার আলোকে সারা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত খারিজী/কওমী মাদ্রাসা সমূহ অবিরাম ওহাবীবাদ প্রচারনায় লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদের ইমাম এখন দেওবন্দী ঘরাণার। ফলে, মুসল্লিদের মগজ ধোলাই সহজতর হয়েছে। বাংলাদেশের অসংখ্য মসজিদ হতে এখন মীলাদ কিয়াম বিদূরিত হওয়ার পিছনে ওহাবী দেওবন্দী ইমাম সাহেবদের ভূমিকা অপরিসীম।
দেওবন্দ হতে মৌলভী ইলিয়াছ কর্তৃক উদ্ভাবিত মসজিদ পরিভ্রমনের তাবলীগ সারা বিশ্বে সুপরিকল্পিতভাবে ওহাবী মতবাদ প্রচারে লিপ্ত রয়েছে। এ’ছাড়া, পাকিস্তানের একজন ওহাবীপন্থী বিতর্কিত মাওলানা মওদুদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামাতই ইসলাম নামক একটি কুফরী আকিদার রাজনৈতিক দল কর্তৃক সুন্নী আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের জোটবদ্ধ করে তাদের কোমল মস্তিষ্কে ওহাবী মতবাদ প্রবিষ্ঠ করিয়েও প্রচার চালানো অব্যাহত আছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ওহাবীবাদ বিস্তারে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অন্যতম হলেনঃ নওয়াব সিদ্দিক হাসান (মৃত্যু-১৮৯০ খ্রিঃ), জামাল উদ্দিন আফগানী (১৮৩৩-১৮৯৮), মিশরীয় স্কলার জামাল উদ্দিনের সাগরীদ মোহাম্মদ আব্দুহ (১৮৪৯-১৯০৫), রশিদ রেজা (১৮৬৫-১৯৩৫), মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (মস্কোতে মৃত্যু-১৯২৭), মাহমুদুল হাসান (১৮৫১-১৯২০), ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি (১৮৭২-১৯৪৪), সৈয়দ আহম্মদ, ইসমাইল দেহলভী, আব্দুর রশিদ গাঙ্গুহী, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা ইলিয়াছ কান্দলভী, আবুল আলা মওদুদী প্রমুখ। বর্তমানে পীস টিভির কর্ণধার এবং খুনি ইয়াজিদের উকিল ডা. জাকির নায়েক এবং বাংলাদেশের বিতর্কিত মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মোহাম্মদ নজদীর প্রেতাত্মার প্রভাবে ওহাবীবাদ প্রচারে মুখে ফেনা তুলে যাচ্ছে।
প্রখ্যাত ওহাবীদের মধ্যে বৃটিশ ভারতে মোহাম্মদ ইসমাইল দেহলভী উর্দ্দু ভাষায় ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’’ শীর্ষক একটি পুস্তক লিপিবদ্ধ করেন, যা’ প্রকৃতপক্ষে মোহাম্মদ নজদীর লেখা ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এর হুবুহু উর্দ্দু অনুবাদ।
উক্ত পুস্তকের মাধ্যমে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের ওহাবী মতবাদে দীক্ষিত করার প্রয়াস চালান। ইসমাইল দেহলভী ছিলেন সৈয়দ আহম্মদের ছাত্র। সৈয়দ আহম্মদ ১৭৮৬ খ্রিঃ জন্ম গ্রহন করেন। তার আরেক ছাত্র মোহাম্মদ জাফর থানেশ্বরী কর্তৃক লিখিত গ্রন্থ ‘সাওয়ানেহ আহম্মদী’-তে তার পুরো জীবনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ইসমাইল দেহলভী কর্তৃক রচিত আরেকটি পুস্তক হল-‘সিরাত-ই-মুস্তাকিত’।
হাকিমুল উম্মাহ খেতাব প্রাপ্ত দেওবন্দী প্রজন্ম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী কর্তৃক লিখিত ‘বেহেশতী জেওর’, ‘কামালাত-ই-আশরাফিয়া’ প্রভৃতি পুস্তকের মাধ্যমে ওহাবীবাদ প্রচারিত ও প্রসারিত হচ্ছে। ইলিয়াছ কান্দলভী কর্তৃক লিখিত গ্রন্থ ‘দ্বীনি দাওয়া’ ও ‘মুলফুজাত’ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একটি সম্পূর্ণ নতুন সেক্ট তাবলীগ জামাত কর্তৃক ওহাবী মতবাদ প্রচার অব্যাহত রয়েছে।
তাবলীগ জামাত এবং আহলে হাদীস মতবাদটিও সম্পূর্ণ ওহাবী চেতনাপ্রসূত। ১৮৩৫ খ্রিঃ আহলে হাদীস, ১৮৬৬ খ্রিঃ দেওবন্দী শিক্ষা, ১৮৬৮ খ্রিঃ আলীয়া মাদ্রাসা, ১৮৮৫ খ্রিঃ কাদিয়ানী ইসলাম, ১৯২০ খ্রিঃ তাবলীগ জামাত, ১৯৪১ খ্রিঃ জামাতই ইসলাম ও ছাত্রশিবির সবই বৃটিশ পিরিয়ডের আবিষ্কার। সুচতুর বৃটিশগণ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতকে ধ্বংস করার জন্য সুকৌশলে ভারতবর্ষে ওহাবীবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছে।
এখন মুসলমান কর্তৃকই মুসলমানগণ ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।