আমার মনে হয় স্বাভাবিক মেয়েদের তুলনায় কালো মেয়েদের চোখে পানির পরিমাণ আক্তু বেশী’ই থাকে। সৃষ্টিকর্তাই ওদের এভাবেই তৈরি করেছেন। কারন অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় এই মেয়েদের অনেক কাঁদতে হয়। কারণে-অকারণে কাঁদতে হয়।
আমি আমার মতই কথা বলি।
আমার নাম রেখা। গায়ের রং ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। লোক জিজ্ঞেস করলে বলি যে আমার গায়ের রং নিয়ে আমার মনে কোন দুঃখ নেই। কিন্তু বাস্তবে উল্টো। আমার সবসময়ই অনেক কষ্ট হয় ,দুঃখ হয়।
আমার মনে অনেক ক্ষোভ তাদের প্রতি, যারা বর্ণ বৈষম্যর বিরুদ্ধে বড় বড় গলায় ভাষণ দেয় কিন্তু বাস্তবে বিয়ে করার সময় ফর্সা বউ খোঁজে,প্রেম করার সময় সুন্দরী মেয়েদের পেছনেই ঘোরে অথচ বক্তৃতা দেবার বেলায় বলে যে আসল সৌন্দর্য মানুষের মনে, জার মন যত সুন্দর সে ততো বেশি সুন্দর। বাইরের সৌন্দর্য দেখে কাউকে বিচার করা ঠিক নয়।
নেলসন মেন্দেলার নাম শুনলে হয়তবা অনেকের মনেই শ্রদ্ধা চলে আসে, তবে আমার ক্ষেত্রে তেমন কিছু আসে না। কারণ উনি হয়তোবা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্য দূর করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের? দক্ষিণ আফ্রিকার মেন্দেলা দিয়ে এই দেশে কিছু হবে না। এর জন্য আরেকজন মেন্দেলা প্রয়োজন।
তবে একতা দিক থেকে আমি অনেক এগিয়ে। কাল মেয়েরা অনেক গুণবতী হয়। হয়তবা স্রষ্টা তাদের রঙের দুঃখ গুন দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছেন। এদিক থেকে ভাবলে আমার গুণের শেষ নেই। পড়াশুনায় অসম্ভব মেধাবী।
যেকোনো ধরণের পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া অন্য কিছু হইনি কখনও। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে এম এস সি করছি। অনার্সের সব পরীক্ষায় প্রথম ছিলাম। এছাড়াও ভালো গাইতে পারতাম, আঁকতে পারতাম,... আরও অনেক কিছু।
এতেও অবশ্য খুব বেশি লাভ হয়নি।
কারণ স্কুল জীবনেই এইসব গুণাবলীর কবর দিতে হয়েছে। একদিন স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসরে গান গাওয়ার জন্য উঠলাম। নজরুলগীতি। গান শুরু করার আগেই দর্শকদের অনাগ্রহ, বিশেষ করে ছেলে ছাত্রদের অনাগ্রহ ছিল অসহ্য। অনেকে ‘ কাউয়া...কাউয়া...’ বলে চিৎকার করছিলো।
কাক বললেও হয়তো কিছুটা সহ্য হতো। তবে ঐ বয়সে কাউয়া শব্দটা অনেক বেশি অশ্লীল লেগেছিল।
সেদিন নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। গান গাওয়া বাদ দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গিয়েছিলাম আর বাসায় এসে কাঁদতে কাঁদতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, এইসব আর না।
স্কুলে আমি বরাবরই প্রথম হতাম।
তবে এতেও আমার কোন ভালো বন্ধু বা বান্ধবী ছিল না। ছেলেদের ক্ষেত্রে কোন ছেলে যদি প্রথম হয়, তাহলে তার সঙ্গে অনেকেই গায়ে পড়ে ভাব জমায়। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে উল্টোটা। কোন মেয়ে প্রথম হলে বাকি মেয়েরা সেতাকে সহজে মেনে নিতে পারে না। সম্ভবত হিংসার পরিমাণটা মেয়েদের অন্তরেই বেশি।
স্কুলে কতো ছেলেকে দেখেছি মেয়েদের পেছনে ঘুরতে, মেয়েদের বইয়ের ফাঁকে চিঠি রাখতে;কিন্তু আমার পেছনে ভুলেও কেউ ঘুরত না। বইয়ের ফাঁকে চিঠিও রাখতো না। প্রতিদিনই আশা করতাম যে আজ হয়তো বাসায় গিয়ে বই উলটে দেখবো কোনো বইয়ের ভেতর থেকে রঙ্গিন খাম বেরিয়ে আসবে, যে খামে কোন ছেলের প্রথম প্রেমের ছোঁয়া লেগে আছে!
বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি কখনও। আশাহত হয়ে কাঁদতাম শুধু। আর সান্তনা দিতাম যে- ‘এখন হয়তোবা হচ্ছে না, কলেজে বা ভার্সিটি তে নিশ্চয় ছেলেদের মন মানসিকতা এরকম থাকবে না ? হয়তো তখন কোনও রাজকুমার তার প্রেমের প্রথম গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা করবে আমার জন্য!’
কিন্তু বিধি বাম! স্কুলের পর কলেজ, তারপর প্রায় ভার্সিটির শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি।
শিক্ষা দীক্ষায় সবাই অনেক উঁচু স্থানে গেলেও কারও মন মানসিকতায় সামান্যতম পরিবর্তনও হয় নি। একদিক থেকে অবশ্য উন্নতি হয়েছে, স্কুলে আমাকে ‘কাউয়া’ বলে ডাকতো আর এখন কাউয়ার জায়গায় লোডশেডিং, অমাবস্যা... ইত্যাদি নাম যোগ হয়েছে। ‘কাউয়ার’ বদলে ‘লোডশেডিং’ শুনতে খুব বেশি খারাপ লাগে না; উচ্চ শিক্ষার ছোঁয়া পাওয়া যায়!
সেদিন নীলক্ষেত থেকে টি এস সি তে যাব। রিক্সা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেকক্ষণ পর একটা রিক্সা পেলাম, সে বলে যাবে না।
কিছুক্ষণ পর প্রচলিত অর্থে যাকে সুন্দরী বলি সেরকম আলট্রা মডার্ন এক মেয়ে এসে বলল - টি এস সি যাবেন? সঙ্গে সঙ্গে রিক্সাওয়ালা রাজী হয়ে গেলো। আমার সামনেই সে এমনটা করলো। কালো বলে একজন রিক্সাওয়ালাও আমাকে অবহেলা করলো!
এতে অবশ্য খুব বেশি মন খারাপ করিনি। ভার্সিটিতে পড়া একজন শিক্ষিত ছাত্রই যখন কালো’ কে অবহেলা করে; তখন রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে আর কি’ই বা আশা করতে পারি?
আমার জীবনটা অনেক একঘেয়ে। তেমন কোনও কাজ নেই।
সারাদিন ক্লাস আর বাসায় এসে পড়াশুনা। আমার বয়সের একটা মেয়ে ফোনে অনেক সময় পার করে, কিন্তু আমাকে কে ফোন করবে? কোনও কাজ থাকে না। সময় কাটানোর জন্য তাই পড়াশুনা’ই করি।
মাঝখানে অবশ্য একটা কাজ করেছি। ডায়েরি লিখেছি।
সময় কাটানোর জন্য আমার পরিচিত এক ছেলেকে নিয়ে ছোটখাটো একটা গবেষণা করছিলাম। পরিচিত বলতে ছেলেটাকে শুধু চিনি। আমার ক্লাসমেট, নাম শিহাব। ছেলেটা গত চার বছর ধরেই সেকেন্ড পজিশনে ছিল আর আমি প্রথম। ক্লাসের সবাই ও’র কাছ থেকে হ্যান্ড নোট নিতো, ও’র সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতো।
অথচ আমি প্রথম হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে কেউ আসতো না। এজন্য প্রথম প্রথম ছেলেটাকে একটু হিংসা লেগেছিল তবে ধীরে ধীরে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। পরে শিহাবের সম্পর্কে কিছুটা খোঁজ- খবর নিয়ে জেনেছি যে ছেলেটা অনেক গরীব পরিবারের ছেলে। একমাত্র বিধবা মা গ্রামে থাকে। ছেলেটা দু’টো টিউশনি করে নিজে চলে এবং গ্রামের বাড়িতে মা’কেও সাহায্য করে।
এসব জানার পর ছেলেটার প্রতি এক ধরণের মায়া জন্মেছিলো।
তাই তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে- শিহাব তো আসলে টিউশনি করে এজন্য হয়তোবা পড়ার যথেষ্ট সময় পায় না। সময় পেলে হয়তো ও প্রথম হতে পারবে। এতা ভেবে আমিও দিনে ২/৩ ঘণ্টা করে পড়াশুনা না করে ডায়েরি লিখতাম। আসলে আমার জীবনে তেমন কোনও বৈচিত্র্য ছিল না, তাই এক ধরনের মজা থেকেই এতা করেচিলাম।
তখন থেকেই ডায়েরি লেখা শুরু করি। তারিখ টারিখ দিতাম না। কারণ আমার কাছে শুধু সময় কাটানোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
যাহোক, সে সময় দিনে তিন চার ঘণ্টা পড়া কমিয়ে দিলাম। এই সময়টা অন্য কিছু করতাম।
টবের গাছগুলোর যত্ন নিতাম। নতুন নতুন ফুলের গাছ লাগাতাম। লাল গোলাপ আমার ভীষণ ভালো লাগে তাই গলাপের চারাই বেশি করে লাগাতাম। আর পাশাপাশি ডায়েরি লিখতাম।
কিন্তু এতো গবেষণা করেও লাভ কিছু হলো না।
মাস্টার্স ১ম সেমিস্টারের রেজাল্ট বের হলো। যথারীতি আমি প্রথম আর শিহাব দ্বিতীয়। তখন মনে হলো- আসলে কিছু মানুষের জন্মই হয় ২য় হওয়ার জন্য। শিহাব সম্ভবত সেই দলের।
শিহাবকে ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করলো।
কিন্তু কালো মেয়েদের ভালো লাগা না লাগায় কি আসে যায়? শিহাব কখনও আমার চোখের দিকে তাকায় নি, ভুল করে চোখে চোখ পরলেও ও তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিতো। কখনও ও’কে আমার চোখের ভাষা পড়াতেই পারিনি।
দেখতে দেখতে মাস্টার্সের রেজাল্টও বের হল। প্রথম হয়ে রেকর্ড করলাম। তবে আমার আর এসবে আগ্রহ নেই।
ভার্সিটির বন্ধুরা কে কোথায়, তেমন কিছুই জানি না। কারও প্রতি কোনও মায়া কিংবা তান কিছুই অনুভব করি না। শুধু শিহাবকে মিস করি ভীষণ। ও’র সঙ্গে আমার তেমন কোনও কথা হয়নি কখনও, অথচ তারপরেও ওকে কতো আপন মনে হয়। হলের জীবনের ইতি হয়েছে।
ভার্সিটির পাশেই এক ম্যাডামের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। ভার্সিটি থেকে টিচার হওয়ার অফার পেয়েছিলাম। রাজী হইনি। দু’টো কারণ ছিল।
আমরা যখন ভার্সিটিতে পড়তাম, রেহানা আপা আমাদের ‘আলো’র চ্যাপ্টার পড়াতেন।
উনি প্রায় বট গাছের মত মোটা ছিলেন। হাঁটতেনও থপ্ থপ্ করে। তবে ওনার মন ছিল অসম্ভব রকমের ভালো। মানুষ হিসাবে একদম খাঁটি। পড়াতেনও খুব যত্ন করে।
অথচ এতো ভালো একটা ম্যাডামকে ছাত্রছাত্রীর আড়ালে ‘মুটকি মাগী’ বলে ডাকতো। আমার ভীষণ খারাপ লাগতো। তাই আমি চাইনা আমাকেও ছাত্রছাত্রীরা আড়ালে ‘কালা মাগী’ বা অন্য কোনও অশ্লীল নামে ডাকুক।
আরেকটা কারণ ছিল শিহাব। খুব সম্ভবত ছেলেটাকে আমি ভালবাসতে শুরু করেছিলাম।
তা না হলে ওর প্রতি এতো দুর্বল হওয়ারতো কোনও কারণ দেখিনা। আমি জানতাম মেধাক্রম অনুসারে চয়েজ হিসাবে আমার পরেই ও ছিল। আমি যদি টিচার হিসাবে জয়েন না করি তাহলে শিহাব এই চাকুরীটা করতে পারবে। আর তাছাড়া মাস্টার্সের রেজাল্টের পর পত্রিকায় আমাদের দুজনের সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। ওটা পড়ে জেনেছিলাম যে ওর স্বপ্ন ছিল ভার্সিটির টিচার হওয়া।
দিন চলছিলো আগের মতই। শুধু ক্লাস করা লাগতো না, বেতিক্ক্রম বলতে এটুকুই। বাবা-মা গ্রামে ডাকতেন। আমার যেতে ইচ্ছে করতো না। একা একা থাক্তেই ভালো লাগতো।
প্রায় গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যেত। স্বপ্নে শিহাব থাকতো। সেসব স্বপ্নে আমরা দুজন খুব কাচের মানুষ হিসাবে থাকতাম। কখনও পাশাপাশি শুয়ে থাকতাম, ও আমার দিকে হাত বাড়াতো। এই সময় ঘুমটা ভেঙ্গে যেতো।
ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও ভীষণ লজ্জা লাগতো।
আজ চৈত্র সংক্রান্তি। আমার জীবনের সবচেয়ে...সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। আমার সবচাইতে আনন্দের দিন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে সব মেয়ে শাড়ি পড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছে।
আমার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। টিভিতে বসে এসব দেখছিলাম আর এইসব মেয়েদের কথা ভাবছিলাম। কতোই না সুখী এরা!চৈত্র সংক্রান্তিতে হলুদ রঙের শাড়ি পড়ে তাদের ছেলে বন্ধুদের সাথে ঘুরছে। আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। কাল’ও এই মেয়েগুলিই তাদের প্রিয় মানুষদের সাথে ঘুরে বেড়াবে, পরনে থাকবে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি।
এসব ভাবতে অনেক খারাপ লাগছিলো। শিহাবের কথা মনে পড়ছিল। ইস্, ও আর আমি যদি কাল পহেলা বৈশাখে ঘুরে বেড়াতে পারতাম! আমার পরনে থাকতো লাল পাড়ের সাদা শাড়ি আর ও পড়ে থাকতো সাদা পাঞ্জাবী। ও আমাকে মেলা থেকে চুড়ি কিনে দিতো!তারপর সন্ধ্যাবেলা একসঙ্গে ফুচকা খেতাম, তারপর...... তারপর আর শেষ হয় না। চোখে আবারও পানি চলে আসে।
খারাপ লাগে, ভীষণ খারাপ।
কিন্তু এইবার মনে হয় স্রষ্টার একটু দয়া হলো। আমার ইচ্ছে পূরণের জন্নই হয়তোবা কলিং বেল বেজে উঠলো। চোখ মুছে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। দরজায় এক পিচ্চি ছেলে একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম-‘ কাকে চাই?’
পিচ্চি বললো-‘আপনি রেখা আপা?’ আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। তখন পিচ্চিটা বললো-‘প্যাকেট টা শিহাব ভাই আপনাকে দিতে বলেছে। ’ বলেই প্যাকেট টা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে ভোঁ-দৌড়। আমি কিছু বলারই সুযোগ পেলাম না। যাহোক,প্যাকেট খুলে দেখি ভেতরে একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি আর একটা চিঠি।
চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম-
প্রিয় রেখা,
প্রথমেই তোমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এই চাকুরীর বাজারে আমাকে একটা চাকুরী পেতে সাহায্য করার জন্য। তুমি সাহায্য না করলে হয়তোবা আজও বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতে হতো। ধন্যবাদস্বরূপ তোমাকে একটা শাড়ি পাঠালাম। আশা করি আমার এই ছোট্ট উপহার নিতে তোমার কোনও আপত্তি নেই।
আরেকটা কথা তোমাকে বলতে চাই।
বলতে লজ্জা লাগছে, তারপরেও বলছি। ভার্সিটিতে আমি সব সময় তোমাকে দেখে মুগ্ধ হতাম। ভাবতাম তোমার প্রতিভার কথা। একটা মেয়ে হয়েও তুমি আমাদের সবার উপরে থাকতে। ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা তোমার সাথে ভালো ব্যাবহার না করলেও তুমি সবাইকে বন্ধুর চোখে দেখতে।
আমার চলার পথে আমি তোমাকে প্রেরণা হিসাবে নিতাম। শত বাঁধাতে হাল ছাড়তাম না। তোমার প্রেরণা আমাকে সাহস যোগাতো।
কিন্তু কখন কি যে হয়ে গেলো। প্রেরণা থেকে তুমি দ্রুতই ভালবাসায় রূপ নিলে।
দিন দিন আমি তোমার প্রতি দুর্বল হতে থাকলাম। কিন্তু এসব বলার মত সাহস আমার ছিল না। আজ অনেক আশা নিয়ে তোমাকে আমার ভালবাসার কথা জানালাম।
আর তুমি যদি ভেবে থাকো,তুমি আমার প্রতি করুনা দেখিয়েছো বলে আমি ঋণ শোধ করার জন্য তোমাকে এসব বলছি, তাহলে সেটা ভুল হবে। কারণ টা তোমাকে বলি।
গ্রামে আমার একটা বোন ছিল। ও দেখতে ছিল অনেক কালো। ও আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল। আমি যখন কলেজে পড়তাম তারও আগে থেকে মা ওর বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করতেন। কিন্তু বর জুটতো না।
যারা রাজী হতো,তারা অনেক বেশি পরিমাণে যৌতুক চাইতো। কিন্তু ওসব আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিলো না। মা অনেক কাঁদতেন। মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বড় আপাকে অনেক গালি-গালাজও করতেন। আমার খুব খারাপ লাগতো।
জানতাম বড় আপারও অনেক কষ্ট হতো। তবে খুব শীঘ্রই ও মা’কে আর আমাকে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত করে দেয়।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বড় আপাকে দেখি ঝুলন্ত অবস্থায়। ঘরের ছাদের সঙ্গে শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে ও...। রেখা, আমার কষ্টের কথা আমি কোনও বন্ধু বান্ধবের সাথে শেয়ার করতে পারিনি।
দিন দিন আমার চলার পথ অনেক বন্ধুর হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে ভীষণ মিস করছি।
আমার ভালবাসা যদি তোমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় তাহলে আগামীকাল বিকাল পাঁচটায় তৈরি থেকো। যে শাড়িটা পাঠালাম,এটা পড়ে থাকবে। আমি বিকাল পাঁচ টায় তোমার গেটে হাজির হবো।
যদি দেখি আমার দেওয়া শাড়ি পড়ে আছো তাহলে বুঝবো, আমার সাথে পথ চলতে তোমার আপত্তি নেই। জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। আশা করি তোমার ভালবাসায় সব কষ্টকে জয় করতে পারবো।
ইতি—
সুখ স্বপ্নে বিভোর
শিহাব...
চিঠিটা পড়ে কয়েকবার চুমু খেলাম। জীবনে প্রথম কেউ আমাকে চিঠি লিখলো।
আমি এতদিন যাকে স্বপ্নে দেখতাম সেই স্বপ্নপুরুষ বাস্তবে ধরা দিতে যাচ্ছে, এটা ভেবেই কান্না পেতে লাগলো। এই কান্না অবশ্য সুখের কান্না। সেই সুখ,যে সুখের জন্য প্রত্যেকটা মেয়েই লালায়িত থাকে। আমি গভীর আনন্দ নিয়ে আগামীকাল বিকাল পাঁচটার অপেক্ষায় থাকলাম। আর এটা হলো আমার ডায়েরির শেষ পাতা।
কষ্টের ডায়েরি লেখার এখানেই সমাপ্তি।
আজ পহেলা বৈশাখ। বিকাল পাঁচটা বাজে। শিহাবের দেওয়া শাড়ি পড়ে রেখা অপেক্ষা করছে। কলিং বেল বাজার অপেক্ষা।
যেকোনো মুহূর্তে শিহাব আসবে। আজ ওরা একসঙ্গে ঘুরবে-ফিরবে,ফুচকা খাবে... আরও কতো কী করবে। শেষ বারের মতো রেখা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদা শাড়িতে ওর নিজেকে পরীর মতো মনে হয়!হোক না কালো পরী, তাতে কি? ভালবাসার কোনও রং থাকে না। ভালবাসার রাজ্যে সব পরী’ই সমান।
গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে একসময় রেখা বুজতে পারে বাইরে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অথচ শিহাব আসেনি। ক্রমেই গত রাতের ভালো লাগা গুলো দু’চোখ বেয়ে কষ্ট হয়ে ঝড়তে থাকে। রাত আটটা বেজে যাওয়ার পরেও যখন শিহাবের আসার কোনও সম্ভাবনাই থাকলো না,ততক্ষণে রেখা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
টিভিটা ছেড়ে ভাবতে লাগলো-ওর জীবনটা এমন কেন? কষ্টের শেষ বেলায় এসে একজন ভালবাসার প্রদীপ জ্বাললো,অথচ সেও কথা রাখলো না।
ভাবতে ভাবতে আবারও রেখার চোখ ভিজে আসে । ভেজা চোখে টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে ও। হঠাৎ চোখ আটকে যায় পর্দায়।
ব্রেকিং নিউজঃ বৈশাখের আনন্দ মেলায় ভার্সিটির ক্যাম্পাসে মেলার দখল নিয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। গুলি ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে।
অনেকে গুলিবিদ্ধও হয়েছে। সবাই ছোটাছুটি করছে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য। সবার ছোটাছুটির ভিড়ে গুলিবিদ্ধ কয়েকটা দেহ নিথর পড়ে আছে। পড়ে থাকা নিথর দেহগুলোর মধ্যে একটা মুখ রেখার খুব পরিচিত মনে হয়। ঝাপসা চোখে রেখা চেয়ে থাকে সেই মুখটার দিকে।
।
মিকসেতু মিঠু
ওসমানী হল,
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।