আল্লাহ হযরত আদম (আ.) কে আগে সৃষ্টি করেছেন এবং তার নি:সঙ্গতা দূর করার জন্য তার বাম পাজরের বাঁকা হাড় দিয়ে বিবি হাওয়াকে পরে সৃষ্টি করেছেন-এজন্য পুরুষদের আত্মঅহমিকার কিছু নেই কিংবা নারীদের হীনমন্যতয় ভোগারও কোন কারন নেই। পুরুষ এবং নারী-উভয়কে সৃষ্টি করার মহৎ পরিকল্পনা আল্লাহর ছিলো। এবং পৃথিবীতে দীর্ঘায়ত কালের জন্য একটি মানব সমাজ কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে কৌশল খাটিয়ে আল্লাহ এদের উভয়কে এখানে পাঠিয়েছেন। অত:পর তাদের সেই স্বর্গচ্যুত জীবন বিচ্ছিন্নভাবে যে নিদারুন হতাশা কষ্ট ও ধারাবাহিক দু:খের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, তার কিভাবে অবসান ঘটল, হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া কিভাবে সংগ্রাম করে পৃথিবীর বুকে টিকে রইলেন, সে ইতিহাস প্রত্যেক ঐশী কিতারবধারী বিশ্বাসী ধার্মিকের জানা আছে। এখানে সে ইতিহাস সে ইতিহাস বর্ণনার চেয়ে বরং আমরা দেখব, পবিত্র কোরআন কোন দৃষ্টিকোন থেকে নারীকে দেখছে, পুরুষ কি দৃষ্টিকোন থেকে দেখছে তার সঙ্গিনীকে।
কারণ সভ্যতার ক্রনোন্নতির ফলে, মানুষের চিন্তা ভাবনার ব্যাপকতর পরিবর্তনের স্রোতে প্রথাবাদী অনেক মূল্যবোধ ভেসে গেছে খড়কুটোর মত। সবকিছু যাচাই করে নেয়ার এই যুগে, পরিবার ও সমাজ জীবনের বহু বিশ্বাস অধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আলগা হতে শুরু করে। ফলে, যৌথ পরিবারের ধারনা এখন বাস্তবে বিলুপ্তির পথে। স্বামীকে এখন আর পূজ্য দেবতা বলে মনে হয় না নারীর; নারীও এখন শিল্পীর তুলিতে আকা মোনালিসা ছবির মত নয় পুরুষের কাছে। কবিদের কব্যেও হৃদয়ের অতলান্ত আকুলতা দিয়ে চিত্রিত কোন মানব প্রতিমা পাওয়া যায় না।
ইউসুফ-জুলায়খা, শিরী-ফারহাদ এর যুগ এখন আর নেই। পুরুষ শাসিত সমাজে আজ নারীকে দেখা হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্যভাবে। মনে হয়, নারী আজ পুরুষের সংগ্রামী জীবনে সহায়ক সঙ্গী নয়, বরং প্রতিদ্বন্দী। যেহেতু উনিশ শতকে নারীর মূল্য মর্যাদা শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে যেটুকু বৃদ্ধি পাচ্ছিল, একবিংশ শতকে সেটুকুও নি:শেষ হতে চলছে। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশীল পদে নারীদের উত্থান ঘটেছে, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় নারীরা যথেষ্ট অবহেলিত ও অবমূল্যায়িত।
আর সে কারনে নারী মুক্তির আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠছে সমতা অর্জন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কিছুতে নারীরা পুরুষের সমান মূল্য চায়, সমান মর্যাদা চায়। সেটা কেবল পুরুষের অনুগ্রহধণ্য শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে।
কোরআনে বর্ণিত নারীদের মূল্য মহিমা সম্পর্কে আলোচনা করার আগে আমাদের জেনে নিতে হয়, প্রাচীন সভ্যতায় বিখ্যাত চিন্তাবিদগণ নারীকে কোন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন। গ্রীকদর্শনে নারী-জীবনের স্বতন্ত্র স্বভাব ও সামাজিক মূল্যের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে।
পিথাগোরাস, প্লেটো এবং এ্যারিষ্টোটল নারীদের ভুমিকা উল্লেখ করেছেন তাদের আলোচনায়। প্রকৃতিগতভাবে নারীদের চেয়ে সব ক্ষেত্রে পুরুষরা সামর্থবন হওয়ার কারনে ঐতিহাসিক বিবর্তনের পথ ধরে, পৃথিবীর সভ্যতাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়েছে পুরুষ প্রতিভাবানদের হাতে। তাজমহলের অভ্যন্তরে মমতাজ-এর মত নারীর মহিমা বারবার গোপন থেকে গেছে। আধুনিক জ্ঞান বিদ্যার অন্যতম অধ্যায় নারীবাদ। আর প্রাচীনকালে, বিশেষত গ্রীক নীতিশাস্ত্রের আলোচনায় নারীরাও স্থান পেয়েছিল।
কেবল মধ্যযুগীয় ইউরোপে নারীর উপেক্ষিত ইতিহাস মানবতাবাদীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে আছে। আর সে কারনে রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হয়ে উঠে নারীর মহিমা আবিষ্কার। নারীর মধ্যে কেবল কাম চরিতার্থ নয়, মানব মনের চিরন্তন সৌন্দর্য পিপাসা নিবৃত্তি ঘটে নারীর মনকে জেনে, ভালবেসে। আমরা কোন কব্য সমালোচনা করছি না, আমাদের লক্ষ্য নারীর ইতিহাস আলোচনা।
প্রাচীন গ্রীক দর্শনের প্রয়োগিক ক্ষেত্রের মধ্যে নীতিবিদ্যা অন্যতম এবং নীতিবিদ্যার আলোচ্য সূচিতে নারীদের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ পুরুষ রচন করছে সামাজিক আইন সন্দেহ নেই, কিন্তু নারীকে সম্পূর্ণ বাদ দিলে কাজটা হয়ে যায় সম্পূর্ণ বেআইনী ও নীতিহীন। পিথাগোরীয় মরমীয়াবাদের তিনটি বিষয়ের মধ্যে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক একটি। অন্য দুটি হল, ক্রীতদাসের প্রতি ন্যায় আচরণ এবং সামাজিক জীবনে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করা এবং তার অনুশীলন করা। এ চিন্তাগুলো নি:সন্দেহে এখনো আধুনিক এবং এগুলোর মধ্যে মানবজীবনের চিরন্তন মূল্যবোধের অঙ্কুর নিহিত।
নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সমাজ ব্যবস্থার কূটিল দিকের যে ছবি প্রকট হয়ে উঠছে, তার ঐতিহাসিক ধারা ও প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন।
আমরা বলছিলাম গ্রীক দর্শনে বিশেষত, পিথাগোরীয়ান ফিলোসোফীতে নারী ও পুরুষের পার্থক্য গ্রাহ্য করা হয়েছে। তিনি মনে করেন যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য । সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পান, নারীর মধ্যে প্রকৃতি এমন কিছু 'পরম গুণের' সমন্বয় ঘটিয়েছে যা তাকে অন্তরালবর্তী কাজে, গৃহস্থ জীবনের অভ্যন্তরে স্বামী-সন্তানের সেবা ও লালন পালনে স্বতস্ফূর্ত করে রাখছে। এ গুণের জন্য সে তার স্বামীকে দিতে পারে সেবা ও সম্মান, সম্তানকে বড় কিছু হওয়ার জন্য যোগাতে পারে প্রেরণা। তার মতে গার্হস্থ্য কার্যাবলী মর্যাদাকর ও সম্মানীয়।
সমাজের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির জন্য সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নারীর গার্হস্থ্য কাজগুলোর গুরুত্ব মোটেও কম নয়। কিন্তু বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে আমরা চাক্ষুষ করি, নারীর গৃহাস্থলি কাজ নৈতিকভাবে মর্যাদা পাচ্ছে না বরং হীনভাবে দেখা হচ্ছে। নারীর জীবন অন্তর্মুখী, তাই বলে তাকে গ্রহ্য করা হয় না। সেবা ও পরিচর্যা প্রদানকারী আবেগ অনুভূতিপূর্ণ নারীকে আজ যতই হীনতর জীব হিসেবে গণ্য করা হোক, ব্যাক্তি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের কথা মনে রেখে পিথাগোরাস নারীর ভূমিকাকে ইতিবাচক, প্রয়োজনীয় এবং মর্যাদাকর বলে আখ্যায়িত করেন।
প্লেটোর নারী সম্পর্কিত মতবাদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই তার 'রিপাবলিক' গ্রন্থের মাধ্যমে। ঐ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য হল, আদর্শ নগররাষ্ট্র এবং আদর্শ নাগরিক। আদর্শ নাগরিকের উপর তিনি জোর দেয়ার কারনে নারীও পুরুষের স্বতন্ত্র ও স্বাভাবিক পার্থক্যকে মূল্যায়ন করা হয় নি বরং পুরুষের পাশে তিনি নারীকে সমানাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করেন। তার এই সমান অধিকারের বিষয়টা একটি কমিউনিটির প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের সূত্রে আলোচিত হয়েছে। কর্তব্যের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
নারীর অবেগময় আচরণ তিনি অপছন্দ করেছেন, তবে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে পুরুষের সহযোগী সঙ্গি হিসেবে নারীর মর্যাদাকে অস্বীকার করেন নি।
আমরা এখন যে সময়ের গন্ডীতে দাঁড়িয়ে নারীর জীবন নিয়ে কথা বলছি, সে সময়টির স্রষ্টা ইউরোপ, ইউরোপীয় চিন্তাদর্শন ও অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে খৃষ্টিয় সমাজে প্রচলিত নারীবাদের ধারণাগুলো সরাসরি নানা ভঙ্গিমায় আমাদের মুসলিম সমাজে এসেছে। ইসলামের শিক্ষায় নারী কখনোই অবহেলিত নয়। কিন্তু উপনিবেশিক শাসনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে মুসলিম সমাজে নারী আজ পণ্য হয়ে উঠছে এবং সে কারণে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর মূল্যায়ন নির্ধারনের চেষ্টা চলছে। তাই বর্তমানের নারীবাদীরা লিঙ্গ বৈষম্য মানতে চায় না।
এক্ষেত্রে নারীবাদীদের বক্তব্য বেশ জোরালো, যা বাস্তব অবস্থায় অস্বীকার করা যায় না। তাদের বক্তব্য: নারী পুরুষের মাধে শরীর তত্ত্বীয় পার্থক্য অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই পার্থক্যকে ভিত্তি করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অধস্থন করে রাখা হয়েছে এবং নারী পুরুষের বৈষম্য কর হচ্চে। নারীবাদ এই বৈষম্যনীতির বিরোধী। আগেই বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে নারীদের উত্থান ঘটলেও, সমাজের সর্বত্র সমান অধিকার পাচ্ছে না তারা।
শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটলেও সেখানে বিশ শতকের আগ পর্যন্ত নারীর ভোটাধিকার ছিল না। বিয়ের মাধ্যমে নারী স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত হয়; এবং বিয়ের পূর্বে সে থাকে পিতার অধীনে। আবার নিজ সম্তানের উপরও তার নিয়ন্ত্রন থাকে না। আইনের অনুশাসন উপেক্ষা করে স্বামীরা যথেচ্ছা স্ত্রীকে ব্যবহার করে। কেবল শিল্প বিপ্লব এসে নারীর শ্রমকে কিছু মজুরীর বিনিময় যোগ্য জিনিস হিসেবে ধরিয়ে দিয়েছে।
নারীবাদ সম্পর্কে পাশ্চাত্যভাবধারায় যারা আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে মেরী উল স্টোন ক্রাফট, জুলিয়েট মিশেল, জে. এস. মিল, পিটার সিঙ্গার, সি. গিলিগান, ভার্জিনিয়া হেল্ড, ভি প্লামউড প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে নারীবাদ বিবেচনায় যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও, এদের মূল বক্তব্য, দার্শনিক পরিভাষায় Feminism এর আওতাভূক্ত এবং বর্তমান বিশ্বের নারী জাগৃতির দাহ্যশক্তি। মেরী উল স্টোন ক্রাফট তার A Vindication of the right of women (1792) গ্রন্থে বলেন, সংক্ষেপে বলতে গেলে, নারী সঠিকভাবে সভ্যতার দুর্বল ক্রটিগুলো অর্জন করেছে। এবং উপযোগী সুফলগুলো হারিয়েছে, এবং সেই সঙ্গে তাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে সক্রিয় করা হয়েছে। অথচ দারুনভাবে তাদের বুদ্ধিকে অবহেলা করা হয়েছে।
ফলে তারা তাদের ইন্দ্রিয়ের শিকার হয়েছে, মার্জিত ভাষায় তাদেরকে বলা হয় আবেগ প্রবণ। সেই সঙ্গে মিথ্যা সংস্কৃতি দিয়ে সভ্য নারীকে এতই দূর্বল করা হয়েছে যে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলেও তাদের নৈতিক বোধ যে অবস্থায় থাকতো সে তুলনায় তা অনেক নীচে।
জুলিয়েট মিশেল বলেন, সমাজ নারীকে পুরুষ থেকে স্বভাবগত কারনে ভিন্ন দল বলে দাবী করে এবং এ দাবী নারীকে সমাজে পৃথক সামাজিক দলে পরিণত করেছে। এবং সে কারনে পুরুষও সমাজে আরেকটি সংঘব্ধ দল। মিশেল দেখাতে চান যে নারীবাদ পুরুষের প্রিভিলেজ প্রাপ্ত জগতে যেমন প্রবেশাধিকার চায় তেমনি একজন পুরুষও নারী জগতে প্রবেশ করুক, তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করুক।
অর্থাৎ তার ভাষায়, নারীবাদ চায় সমতা। অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক-সর্বক্ষেত্রে কেবল পুরুষ নয়, নারীও নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশী লেখিকা মালেকা বেগম-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ' উনিশ শতকে বাংলার নব জাগরণের ইতিহাসে নারীজাগরণের অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল সংগত কারণেই। আর সে কারনেই অবলা ও পরনির্ভশীল বঙ্গ লালনাদের নির্যতিত অত্যাচারিত জীবন ইতিহাস বিদ্রোহ ও লড়াই-সংগ্রামের রক্তে আপ্লু হয়েছে।
এক নদীতে দুই স্রোতধারা বহমান। এবং তা বইছে দুই শতাব্দি ধরেই। ' উপনিবেশিক শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তি অর্জনে বঙনারীর ভূমিক নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়।
নারী-পুরীষের দৈহিক গঠন ও গড়নকে সামনে রেখে J. S. Mill বলেন, যে নীতি দিয়ে উভয় লিঙ্গের মাধে বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ককে বিদিবদ্ধ করা হয়েছে- এক লিঙ্গ দিয়ে অপর লিঙ্গকে অধস্তন করার বৈধতা তা স্বয়ং ভ্র্ন্ত এবং বর্তমানে মানব উন্নতি বিধানে একটি বাধা।
পিটার সিঙ্গার বলেন, জীবতাত্ত্বিক পার্থক্য নারী পুরুষের বুদ্ধি বা সামর্থ বা শক্তি সম্বন্ধে কোন পার্থক্যের ভিত্তি নয়।
তিনি বরং মনে করেন, আমাদের যদি মানুষের আসল প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে হয়, তাহলে তাদের বিচ্ছিন্নভাবে স্ত্রী বা পুরুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করে ব্যাক্তি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি সংসার ও সমাজ বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে বলেন, মানুষ যে কাজের জন্য সবচেয়ে বেশী উপযোগী সেই কাজটি যদি তাদের করতে হয়, তাহলে স্ত্রী ও পুরুষের জন্য নির্ধারিত কাজের ক্ষেত্রগুলোকে উন্মুক্ত রাখতে হবে। ' এখানে ষোল বছরের একটি মেয়ের দাবীগুলো শোনা যাক, "বেচে থাকার বিষয়টি মানুষের জন্যে অগ্রাধিকার পাবে এবং এর জন্যে মানুষ সংগ্রাম করে। চুরি করার চাইতে অস্তিত্ব রক্ষা করা অধিক গুরুত্ব পাবে। চুরি করা নিন্দনীয় কিন্তু অস্তিত্বের জন্যে চুরি করা এমনকি হত্যা করতে হলেও আপনার করা উচিত।
জীবন রক্ষা করা আমার মনে হয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে এটাই সর্বগ্রে বিবেচ্য। " এই অস্তিত্ববাদী বক্তব্যের সঙ্গে তাল রেখে আমরা আমাদের সমাজে বহমান একটি সামাজিক সমস্যার উল্লেখ করতে পারি। আমাদের সমাজটা মুসলিম সমাজ, কিন্তু পতিতাবৃত্তিটা ধর্মীয়ভাবে পাপের কাজ হলেও, সরকার এই ঘণ্য পাপের কাজে লাইসেন্স দিতে বাধ্য কেন ? অস্তিত্ব রক্ষার সমস্যায় জর্জরিত একটি নারীর দেহ দান যখন তার বেচে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে উঠে তখন এই গরীব মুসলিম সরকার বাহাদুরের কিছুই করার থাকে না। আইন মানুষের বাস্তব প্রয়োজনের মুখে নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য।
বুভোয়ার তার 'সেকেন্ড সেক্স' গ্রন্থে নারীর জৈবিক, মানবিক ও নান্দনিক জীবনকে সামাজিক পটভূমিতে রেখে যাচাই করেছেন।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ সেই বইয়ের আলোকে বাংলা ভাষায় রচনা করেন তার উল্যেখযোগ্য গ্রন্থ 'নারী'। বাংলাদেশে নারীবাদের প্রবাহ রচনায় এই বইটি যে বিশেষ অবদান রেখেছে তার প্রমাণ, এটি সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। কারাগার থেকে বইটি আবার বাজারে ঘোরার, পাঠকের নাগালে আসার, জিজ্ঞাসু তাত্ত্বিকের টেবিলে অবস্থান করার অনুমতি পেয়েছে। নারী বইটি নারীজীবনের একটি মানচিত্র যা বয়ষ্ক পাঠক পাঠিকার মনে কেবল যৌনাবেগের শিহরণ জাগাবে না, নারীর জীবনাবেগের অনেক অকথিত মর্মবেদনার পরিচয়ও পাওয়া যাবে। নারীর জীবন, যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে শিল্পে গত দুশ বছরে চিত্রিত, তাই নারী গন্থে বেশ খোলামেলা ভাষায় বিশ্লেষিত হওয়ার জন্য রক্ষণশীল মানসিকতার কাছে লেখক সমালোচিত হয়েছেন।
বাংলাভাষায় নারীদের উপর অনেকের লেখা বেরিয়েছে যা বেশ উৎসাহ ব্যঞ্জক। সেসব গ্রন্থ ও বিবেচণাগুলোর মধ্যে প্রবেশ করার আগে, পাশ্চাত্য দর্শনের বিবেচনায় নারীর আর্থসামাজিক অস্তিত্ব ও বিকাশের প্রক্রিয়াগুলো আলিাচিত হওয়া দরকার।
তাত্ত্বিকভাবে নারীর সমস্যাগুলো বিবেচনায় রাখলে বাস্তব সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ হবে। মানুষ স্বাভাবিকভাবে যখন স্বাধীন থাকে তখন তার মধ্যে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠার সুযোগ থাকে। তাই স্বাধীন চেতনা দ্বারা নৈতিক সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হওয়ার সুযোগ থাকলে আইনের প্রয়োগ বৈধতা পাবে।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে স্বাধীনতা ভোগের কিছুটা সুযোগ যদি না দিতেন, মানুষের অপরাধ বিবেচনায় নেয়াটা হত অনৈতিক।
নৈতিকভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ে একটি মূল্য বহন করে এবং সেকারণে তারা আত্মসম্মানের অধিকারীও বটে। আর আত্ম সম্মান হচ্ছে এমন বৈশিষ্ট্য বা গুণ যা মানুষকে মূল্যবান করে তোলে। আত্মসম্মানের ঘাটতি হলে ব্যাক্তির মধ্যে হীনমন্যতার মনোভাব বৃদ্ধি পাবেই। এবং বিশেষভাবে নারীর ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক।
শতশত বছর অসম্মান ও অমর্যাদার মধ্যে বেচে থাকা নারী সমাজ ভুলেই গেছে সাহস কী জিনিস, ব্যক্তিত্ব কী বস্তু। সৃষ্টিগত দূর্বলতার জন্য হোক কিংবা সামাজিক ট্র্যাডিশনের জন্য হোক, আমাদের নারী সমাজ দারুনভাবে হীনমন্যতায় ভোগে। সমাজে চলতে চলতে, আত্মোপলব্ধি গড়ে উঠার বদলে তার মধ্যে জন্ম নেয় হীনমন্যতার। এই আত্মসম্মান অর্জনের উপায় শিক্ষা যা এ সমাজের ৮০% নারীর কাছে পৌছানো যায়নি। নারীর মধ্যে ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্য যে উপায় ও উপকরণ প্রয়োজন সে বিষয়ে আমরা পরে আসছি।
আমরা পাশ্চাত্য নারীবাদীদের কাছ থেকে নারী কেন্দ্রিক সমস্যাগুলোর আরো কিছু পাঠ গ্রহণ করব। ভার্জিনিয়া হোল্ড তার Feminist Morality গ্রন্থে বলেন, একজন পুরুষ পিতা হিসেবে নীতিগতভাবে 'মায়ের ভুমিকা' পালন করতে পারেন। লেখিকার এ ধারণা সার্বজনীন নয়, বিশেষ একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে বাবা মায়ের স্নেহ দিতে চেষ্টা করতে পারেন, এমনটা আমরা সিনেমায় দেখি। কিন্তু আসলে পরিচর্যা বিষয়ক যে মূল্যবোধ আমাদের সমাজে চালু আছে, তার কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। নারীর কোমল হতের সেবা ছাড়া পুরুষের কোন রোগই তো ভাল হয় না।
তাই বিশ্বের হাসপাতালগুলোতে পরিচর্যার দায়িত্বটা পালন করে নারীরা এবং এটা তাদের যত না প্রশিক্ষণ দ্বারা অর্জিত, তার চেয়ে বেশি স্বভাবগতভাবে প্রাপ্ত। ফলে এটাকেই পিথাগোরীয়ান ভাষায় বলা হয়েছে নারীর 'পরমগুণ'। এ গুণ থেকে নারীকে বিচ্ছিন্ন করা হলে, যে ছবিটা ভেসে উঠে, পুরুষতো নয়ই, নারী নিজেও নিজের সেই সেবাপরায়নতাশূন্য ছবিটা দেখবে না, দেখতে তারও ভাল লাগবে না। পাশ্চাত্যে যখন পরিচর্যা নীতিকে নারী ও পুরুষের মধ্যে আধাআধি ভাগাভাগি করার প্রবণতা চলছে এবং গ্রাহর্স্থ্য কর্মে পুরুষের অধিক মাত্রায় সময় দেয়ার ব্যাপারে নারীবাদীরা চাপাচাপি অব্যাহত রাখছে, তখন দাম্পত্য জীবনটা কিন্তু জমিদার বাড়ীর ক্ষেত খামার হয়ে উঠছে। সেটা আর দাম্পত্য জীবন থাকছে না।
একথার অর্থ এই নয়, সে পুরুষ কখনো স্ত্রীকে সন্তানের সেবাযত্নে, রান্না-বান্না কিংবা অতিথি সেবায় সাহায্য করতে যেতে পারে না, অবশ্যই যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টি যদি নারীবাদীরা রাস্তায় মিছিল করে পুরুষের দ্বারা গাহর্স্থ্যকর্ম আদায় করে নিতে চায় তাহলে সম্ভবত পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি বিপদগ্রস্থ হবে। যেমনটা পাশ্চাত্য নারীরা হচ্ছে। আজ আমাদের দেশের পুরুষরা যে দৃষ্টিতে নারীর দিকে তাকায় তার মধ্যে শোষণের চেয়ে ভালবাসার দৃষ্টিপাতই বেশি। নারী পাচার, যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি, ফতোয়া প্রভৃতি ঘটনায় দেশের কতভাগ পুরুষ জড়িত ? নিশ্চয়ই তা ৫% ভাগের বেশি হবে না।
বাকীরা কি নারীদেরকে সঙ্গে নিয়ে সংসার করছে না ?
পাশ্চাত্যে সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে নারীরা যখন সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে, তখন তাদের মধ্যে পুরুষ বিদ্বেষ বেড়েছে, সর্বত্র সমানাধিকারের জন্য সোচ্চার হচ্ছে তারা। সহজ যোগাযোগের পথ ধরে সেই ঢেউ প্রাচ্য সমাজেও উত্তাল আলোড়ন সৃষ্টি করছে। নারী যে কিছুই না এ ধারণা খৃষ্টীয় চার্চের এবং চার্চ- এর ধারণা এমন যে, 'শয়তান সম্ভবত নারীর রুপ ধরে আসে। " হিন্দু সমাজে নারীর জীবন মূল্য তুচ্ছ, কিন্তু হিন্দু ধর্মে নারীরা দেবী হিসেবে পূজ্য, সেখানে বড় উৎসবটাও দেখা যায় দূর্গাকে নিয়ে, মহাদেব বা ইন্দ্রিকে নিয়ে নয়। অন্যদিকে মুসলিম সমাজে নারীর বর্তমান হাল যত খারাপ হোক পরিবেশের প্রভাবে; ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান অতীব উচ্চে এবং মহিমান্বিত রুপেই মুসলিম নারীরা ধর্মের কাছে সম্মানিত।
কোরআনিক বিধি বিধান পূর্ণাঙ্গরুপে অবাস্তবায়িত থাকার কারনে এ সমাজে নারীর সঠিক মূল্য কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং ভারতীয় সামন্তবাদী সনাতন মূল্যবোধ লালিত বঙ্গ সমাজে নারীর অবস্থান বরাবরই পশ্চাতে রয়ে গেছে, হোক সেটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর জন্য বা অশিক্ষার ফলে, তা কিন্তু বদলানো যায়নি। শেষ দুই দশক বাংলাদেশের সমাজে চাকুরী, চিকিৎসা, আইন, ব্যাবসা, শিক্ষা, শিল্পোদ্যোগ তথা রাজনীতির মত পুরুষনিয়ন্ত্রিত এলাকায় নারীর উল্লেখযোগ্য উত্থান ঘটেছে এবং সেই সঙ্গে গ্রাম সমাজে দারিদ্র্য ও অশিক্ষার জন্য নারীদের প্রতি অবিচারের মাত্রাও বেড়ে গেছে। ফলে সমাজে শিক্ষিত নারীরা নির্যাতিত ও অসহায় নারীর মুক্তির জন্য সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছে এবং সেটাই বর্তমান সমাজে উদার নারীবাদী চেতনা প্রবাহের সৃষ্টি করেছে। আমাদেরকে এ বিষয়ে তাত্বিক আলোচনায় প্রবেশ করার আগে একথা সর্বোতভাবে মনে রাখতে হবে, এখানে ইসলামের প্রতি যত অনুরাগ বা আবেগ থাকুক, সমাজ কিন্তু ইসলামী নয়। বিয়ে, তালাক, সম্পত্তিবন্টন কিংবা অভিভাকত্ব আইনের কাঠামো প্রণয়নে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার অর্খ এই নয় যে এটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ।
কারণ এখানে মানুষের কিছু কিছু জরুরী কাজে ধর্মের চর্চা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু পুরোমানসিকতাই ইসলাম বিরোধী। এখানে ইসলামী সমাজ ব্যাবস্থা কায়েম হত, যদি হযরত মুহাম্মদ (স.) যেমন মক্কা ও মদিনায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাহলে আজ এখানে নারী ও পুরুষের লিঙ্গনির্ভর বৈষম্য নিয়ে নারীদের প্রতিবাদী হয়ে উঠার প্রয়োজন পড়ত না। সততার সঙ্গে একটি নারী যদি বলতে পারে সে ইসলামী সমাজে নির্যাতিত, তাহলে বলতে হবে সেটা আদৌ ইসলামী সমাজ নয়। আমরা আর একটু পরে কোরআনের আলোকে নারী ও পুরুষের সমস্যগুলো আলোচনা করব, তার আগে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির তাত্ত্বিক আলোচনা সেরে নেব। বাংলার প্রকৃতির মত বাংলার নারীরাও সর্বংসহা; তাই অভাবী সংসারে স্বামীর সঙ্গে বাইরে সে মজুরের কাজ করে, ঘরে এসে সেবা করে স্বামীর, লালন পালন করে ছেলে সন্তান, তার পরও পরিবারের অধিকর্তা পুরুষ তার উপর খুশী হয় না, নানা রকম হয়রানির শিকার হন শ্রমজীবি এইসব নারীরা সেটাই এখন নারীবাদী সংগঠনগুলোর বক্তব্যবিষয়; এভাবে নারীকে নির্যাতিত হতে দেয়া যায় না, এ অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন।
এবং সেটা সম্ভব, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীকে দেখা, নারীর জীবনকে সমাজের সব রকম সুবিধার মধ্যে বিকশিত করা, কেবল মা, বোন, স্ত্রী হিসেবে দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনের গন্ডীতে তাকে আটকে রাখা নয়। মৌলিকভাবে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য আজকের নারীবাদ, নারী আন্দোলন।
নারীকে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরী। আধুনিকতা এই জরুরী পরিবর্তনের পক্ষে তাগিদ করছে। আধুনিকতার নামে পাশ্চাত্য থেকে আমদানী হচ্ছে এমন কিছু ধারণা যা প্রাচ্যের মুসলিম সমাজে সম্পূর্ণ নতুন এবং নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্কের প্রতি যথেষ্ট হুমকি স্বরুপ।
নারীবাদী লেখকদের বক্তব্য একটাই যে, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা শোষিত হচ্ছে। সে শোষণের জায়গাগুলোও তারা চিহিৃত করেছেন। তাহলে বিবাহ আইন যা নারীকে পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত করে, সম্পত্তি বন্টনের উত্তরাধিকার আইন, যেখানে তারা বঞ্চিত বলে মনে করে, তালাক, যা স্বামীর ইচ্ছাধীন রাখা হয়েছে, যদিও স্বামীর মারাত্মক ত্রুটির জন্য স্ত্রী স্বেচ্ছায় স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারে, তবুও প্রচলিত তালাক বিধানে তারা খুশি নয়, সন্তানের মালিকানা প্রশ্নে, নারীর শরীর থেকে যে সন্তান বের হয়, নারী সেই সন্তানের দাবী করতে পারে না, এটা তাদের বিবেচনায় অমানবিক। সর্বোপরি তারা জরায়ুর স্বাধীনতা চাওয়ারও পক্ষ্যে। তাদের বক্তব্যে এটাও স্পষ্ট যে, বিবাহের বাইরে নারী যতই অর্থনৈতিকভাবে সফল হোক না কেন, বাংলাদেশের সমাজে এটি কোন স্বীকৃত পরিচয় নয়।
তাদের আলোচনায় এটাও এসেছে যে, বাংলাদেশের সমাজে বিয়ের মাধ্যমে পুরুষের আধিপত্য ও নারীর যৌন পবিত্রতা নিশ্চিত হয়, ফলে নারী স্বাভাবিকভাবে পুরুষের নীতি আদর্শের খাচায় বান্দী হয়ে পড়ে। তারা এটাও বুঝতে পারছে যে মুনাফা কেন্দ্রিক বাজার অর্থনীতিতে নারী উৎপাদন সহযোগী হিসেবে সবচেয়ে সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে। এ কারণে তাদের বক্তব্য হল, নারীর শ্রমকে অবমূল্যায়ন করার ফলে নারীরা পুরুষের অধীনে নিষ্পেষিত, মর্যাদাহীন। তারা উদাহরণ পেশ করে বলে, নারী কিভাবে পুরুষের পর্যায়ে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবে ? যেহেতু বেতন বৃদ্ধি, কাজের অবস্থান বদল, বাচ্চা রাখার স্থান, ছুটি, ওভার টাইম, সুবিধাজনক রোষ্টার, কর্মস্থালে নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে অফিসের আলোচনা সভার আলোচ্যসূচীতে নারীরা অন্তর্ভূক্ত করতে পারে না। তাদের দাবী রাষ্ট্র যদি নারীর জীবন ব্যাবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করে তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক অঙ্গণে নারীর অবাধ বিচরণের অধিকার দিতে হবে, যদি তা না হয়, সেটা কি রাষ্ট্রীয় ভাবে নারীকে নিগৃহীত করা নয় ? এদেশীয় নারীবাদীদের উগ্র মেজাজটা এসেছে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যানটনের বক্তব্যের রেশ ধরে, তার মতে, নৈতিকতার পশ্নে নারীরা পুরুষের উপরে।
ব্যক্তিক ক্ষেত্রের মূল্যবোধ লালন করায় নারী আধ্যাত্মিক ভাবে শক্তিশালী, উন্নত নৈতিকতার অধিকারী ও সত্য-ন্যায়ের পক্ষপতি। আন্যদিকে পুরুষ বাইরের জগতে কর্মময় থাকায় অন্যায়, অবিচার ও অসত্যের পথে চলে গেছে। অধিকমাত্রায় স্বার্থপরতা ও চাতুরতা চর্চা করায় রাজনীতিকেও পুরুষ কলুষিত করেছে। শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভাঙ্গির দরুণ পুরুষের কারণেই দ্বন্দ্ব বিরোধ সংঘর্ষ ও যুদ্ধ বিগ্রহ বৃদ্ধি পায় বলে উদার নারীবাদীগণ মত প্রকাশ করে পুরুষের একচ্ছত্র রাজনৈতিক অধিকারের বিরোধীতা করছে। " পাশ্চাত্যে উচ্ছৃংখল ও মোহগ্রস্থ পুরুষের দ্বারা উপেক্ষিত নারীদের মানসিক সংকট থেকে উচ্চারিত মন্তব্যের ভিত্তিতে এলিজাবেথ কেডির মত অনেকে পুরুষের জীবন চরিত্রচিন্তাকে প্রত্যক্ষভাবে ঘৃণা করতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
সিমন দ্য বুভোয়ার তার 'সেকেন্ড সেক্স' এ প্রশ্ন তোলেন, কেন নারীর স্থান সব সময় পুরুষের তুলনা করে অধস্তন হিসেবে ধরা হয় ? রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সার্বিক সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী কেন অদৃশ্য কিংবা প্রান্তিক অথবা সেকেন্ড সেক্স ? পাশ্চাত্য লেখকদের এসব খোলামেলা বক্তব্যের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে এদেশের অনেক লেখক, নারীর জীবন গাথাঁ এমনভাবে রচনা করতে উদ্যোগী যে, তারা বুভোয়ার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলেন, "কেউ নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না, নারী হিসেবে তৈরী হয়। " পাশ্চাত্যের লাগামহীন বক্তব্যের উৎসাহিত এদেশীয় লেখকদের কারো কারো কলমে এমন বাক্য লেখা হয়, বিষে বেশ্যাবৃত্তির লাইসেন্স (নাউযুবিল্লাহ)। আবার বলা হয়, নারীরা ঐতিহাসিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেনীর পশু। এসব চিন্তাধারা ব্যপকভাবে সমাজের শিথিল, উচ্চ শিক্ষিত অনিয়ন্ত্রিত স্তরে নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরণের নৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। বুভোয়ার প্রশ্ন করেন, নারী কেন সেকেন্ড সেক্স বা অধস্তন শ্রেনী ? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা কি বলব ? যারা গোটা মানবজীবনকে একটা সুন্দর পরিণামের দিকে চালিত করার উদ্যেশ্য নিয়ে প্রতিদিনকার দায়ত্ব ও কর্তব্যকে কোন রুপ আধ্যাত্মিক অঙ্গীকারের প্রকাশ হিসেবে দেখেন না, বরং নারীর শ্রমকে বস্তুগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের কাছে নারী তো নিশ্চয়ই সেকেন্ড সেক্স।
কিন্তু আমাদের কাছে নারী সেকেন্ড সেক্স বা অধস্তন শ্রেনী না, কারণ আমরা নারীকে পুরুষের পরিপুরক সহযোগী সঙ্গি হিসেবে দেখি যা একটি কল্যাণকর সমাজের জন্য অতীব জরুরী। অথচ শুলামিথ ফায়ার স্টোনের-ডায়ালেকটিক অব সেক্স' এ নারীর যৌন নির্যাতনকে রাজনৈতিক নির্যাতন হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। কারণ তার ধারণা, লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে নারীকে নিম্ন শ্রেনী হিসেবে গণ্য কার হয়। তার মতে, পুরুষের ক্ষমতা চর্চা ও যৌন নিপীড়নের কারণে নারী শ্রেণী বৈষম্য ও শ্রেণী শোষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে।
উপরের বক্তব্যের আলোকে এটা বোঝা কষ্টকর নয় যে, পরাজিত ও উপেক্ষিত সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ সামনে রেখে নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিশ্লেষণের বিষয় কার হয়েছে।
সমাজতন্ত্র কবির কাব্যচর্চাকে যেমন উৎপাদন সামগ্রী মনে করে তেমনি নারীর গৃর্হস্থালির কাজকর্মকেও। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে নারীর গার্হস্থ্যকর্ম, যা স্বামীর সহযোগিতা ছাড়াই করতে হয়, তা একটি উৎপাদনশীল শ্রম, এবং সেটা আর্থিক মূল্যে বিক্রয় যোগ্য, অথচ এদেশে গণতান্ত্রিক পুজিঁবাদরে বিকাশ ঘটায় নারী প্রত্যক্ষভাবে তার গ্রহকর্মের মজুরী থেকে বঞ্চিত। পাবলিক কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ে চাকুরিবিধি মেনে কাজ করে কিন্তু প্রাইভেট কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে কেবল নারীই সনাতন পদ্ধতিতে গৃহকাজে লিপ্ত হয়, পুরুষ ঘরের কাজ করে না। এভাবে দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, সামন্তবাদ, পুজিবাদ বিংবা সমাজতন্ত্র সর্বত্রই নারীর অবস্থান পুরুষের নীচে।
প্রকৃতির বিধান নারীকে পুরুষের অধীন করে দিয়েছে- হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এই প্রথা, আধুনিক কালে যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন।
পুজিবাদে নারীর গার্হস্থ্যকর্মের নগদ বিনিময় না দিলেও, নারীকে পুরুষের অধীন থাকার রীতিটা বাজায় রাখার পক্ষে, কিন্তু সমাজতন্ত্রে নারী পুরুষের সম্পর্কেল সম্পূর্ণ উল্টে দেয়। কারন মার্ক্স ও এঙ্গেলস সমাজসত্তার বিকাশে পরিবারের ধারণাই স্বীকার করতে চান না। সমাজের মূল বুনিয়াদ যে পরিবার ব্যবস্থা সেটাই যখন মার্ক্সীয় ফিলোসফীতে অস্বীকৃত, তখন প্রথাবদ্ধ নারী পুরুষের সম্পর্ককে বস্তুগত শ্রম-সেবার ভিত্তিতে বিচার্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। যেহেতু সমাজের দিনমজুর, শ্রমজীবি ও শেষিত শ্রেনীর কাছে সমাজতন্ত্র কেবল একটি অর্থব্যবস্থাই ছিল না, তা ছিল একটি বিশ্বাস। Communism to them is not scientific Marxism Leninism but a Religion ! সমাজতন্ত্রে পরিবার না ভেঙ্গে সমাজতন্ত্র সার্থকভাবে বিকশিত হতে পারে না, সেহেতু সেখানে নারী-পুরুষের পারিবারিক সম্পর্ক যা ধর্ম কর্তৃক আরোপিত, তা উপেক্ষিত হয়েছিল এবং সেক্ষেত্রে নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে নিপীড়িত নারীর জন্যও মার্কসের একটি সমাধান ছিল।
বস্তুত, মার্ক্সীয় নারীবাদের মধ্যে প্লেটোর নারীবাদের উত্তরাধিকার বহনের চিহৃ দেখা যায়। প্লেটো সার্বভৌম নগর রাষ্ট্রের স্বার্থে পরিবার কাঠামোকে ভাঙতে চেয়েছিলেন। সমাজতন্ত্র সতাদশক কষ্টকর লড়াইয়ের পর পুজিবাদের কাছে হেরে গেলেও, জীবন সমাজ ও পরিবারকে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোন থেকে দেখবার প্রবণতা শেষ হয়ে যায় নি। বরং আধুনিক নারীবাদী চিন্তায় সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের বস্তুকেন্দ্রিক ধারণাগুলো প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। ফলে নারীর সন্তানের জন্মদান, তার শিশুকে প্রতিপালন ও স্তণ্যদান যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা তা একেবারেই তুচ্ছ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
যদিও প্রাচীন গ্রীস ও বিশশতকের মাঝে আড়াই হাজার বছরে পাশ্চাত্যে নারীর চিরন্তন রুপ ইসলাম আবির্ভাবে আরো বেশি সুন্দর ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে প্রাচ্যের মুসলিম সমাজে। কিন্তু যদি নারীর ক্রমবর্ধমান শিক্ষায় ব্যাক্তিত্বের বিকাশ না ঘটে এবং পুরুষের পাশাপাশি দাড়িয়ে জীবন ও জগততের সমস্যা মোকাবেলায় যথার্থ ভূমিকা পালনে উৎসাহী না হয় তাহলে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব কর্তব্য ও একই সমাজে বসবাস করার কারণগুলো নতুনভাবে খুজে দেখার প্রয়োজন হবে।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত হবে ইনশাআল্লাহ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।