আসুন ভালো থাকি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র বিমোচনের অন্যতম একটি প্রয়োজনীয় উপকরণ বা শক্তি হলো বিদ্যুৎ। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি প্রধানত নির্ভরশীল কৃষি, শিল্প আরও কিছু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ের উপর, যেগুলোর সবগুলোই আবার বিদ্যুতের উপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। আর একারণেই বিভিন্ন গবেষণায় বিদ্যুতের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের সরাসরি সম্পর্কের বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ তাদের একটি গষেণায় দেখিয়েছে যে, শুধুমাত্র বিদ্যুতের স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশ তার মোট জিডিপি’র ৩.৫% হারাচ্ছে। উন্নয়ন অন্বেষণ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান তাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে, প্রতি ১% জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির জন্য ৬০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন।
তারা বিভিন্ন বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ এবং দেশজ উৎপাদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে, বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়লে জিডিপি বাড়ে।
সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদন বাড়াতে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে সরকারে উদ্যোগও আছে, কিন্তু মুশকিল হলো সমস্যা সমাধানের তাৎক্ষণিক উপায় (কুইক রেন্টাল) বা বিশাল আকারের বিপজ্জনক আয়োজন (নিউক্লিয়ার পাওয়ার) পুরোপুরি সন্দেহ, দ্বন্দ্ব বা বিতর্কমুক্ত হতে পারছে না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এসব আয়োজন বা উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক আছে সারা বিশ্বেই। বিদ্যুত উৎপাদনের প্রধান উপকরণ তেল, গ্যাস, কয়লা খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে, ফলে এগুলোর উপর নির্ভরশীল বিদ্যুতের জন্যও রয়েছে শংকা।
উন্নত বিশ্ব তাই হন্যে হয়ে খুঁজছে নানা বিকল্প। নবায়নযোগ্য জ্বালানী, বিশেষ করে সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছে অনেকেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সৌরবিদ্যুতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা, কিছু সমস্যাও আছে বৈকি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সৌরবিদ্যুতের গুরুত্ব কতটা সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌরবিদ্যুতকে কিভাবে দেখা হচ্ছে, এটিকে নিয়ে কী ধরনের তোড়জোড় চলছে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা যাক। বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা তথ্য-উপাত্ত, প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বের বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আর মাত্র ৩০-৩৫ বছর তেল পাওয়া যেতে পারে।
অন্যদিকে ২১৫৯ সালের পরে এর জন্য কয়লাও আর হয়ত পাওয়া যাবে না! এই সীমিত শক্তি বা সম্পদগুলো ক্রমশই ফুরিয়ে আসছে। অন্যদিকে সূর্য প্রতিদিন বিলিয়ে যাচ্ছে অপরিসীম বিদ্যুৎ শক্তি। আর এখানেই বিজ্ঞানীরা আশার আলো দেখছেন। তারা হিসাব করে দেখাচ্ছেন যে, কেবল এক সূর্য থেকেই বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য সকল উৎসের প্রায় সমান পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। জার্মানির হামবুর্গ ভিত্তিক ডেজার্টটেক ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা দাবি করছে, মাত্র ৬ ঘন্টায় বিশ্বের মরুভূমিগুলোতে যে পরিমাণ সৌরবিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, তা পুরো এক বছর বিশ্বের সকল মানুষের মোট ভোগকৃত বিদ্যুতের সমান! বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের এই নেটওয়ার্ক দাবি করে যে, পৃথিবীর সব মরুভূমিতে সারাবছর যে পরিমাণ সৌরশক্তি থাকে, তার এক শতাংশও যদি সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলে বসানো যায়, তাহলে পুরো পৃথিবীর বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সূর্যের আলো দুইভাবে ব্যবহার করা যায়- সরাসরি সুর্যের আলো বা তাপটিকে ব্যাবহার করা (সোলার থারমাল) অথবা এর আলোকে বিদ্যুতে পরিণত করে ব্যবহার করা (ফটোভোলটেইক বা পিভি)।
শুধু গবেষণাতেই থেমে নেই অনেক উন্নত দেশ, তারা বিকল্প নানা জ্বালানীর জন্য বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সালে সারা বিশ্বে বিকল্প জ্বালানীর জন্য মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা এর আগের বছরের তুলনায় শতকরা ১৭ ভাগ বেশি। একই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে সৌরবিদ্যুত খাতে বিশ্বজুড়ে ২০১১ সালের তুলনায় ৫২% বিনিয়োগ বেড়েছে। বিভিন্ন সুত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জার্মানি ৩২.৩ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সৌরবিদ্যুৎ থেকে (ডিসেম্বর ২০১২)।
এটি ২০১১ সালের তুলনায় প্রায় ৮ গিগাওয়াট বেশি। দেশটি আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ২৫ ভাগ সৌরবিদ্যুত থেকে মেটানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। পিছিয়ে নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। দেশটির ক্যালিফোর্নিয়াতে রয়েছে পৃথিবির সবচাইতে বড় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র্, যা থেকে ৩৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উপন্ন হয়। চীন একাই বিশ্বের মোট পিভি উৎপাদনের ২৩% করে থাকে।
আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত ২০২০ সালের মধ্যে ২০ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ২০০৯ সালেই ১৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালে জাপান প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সৌরশক্তি ব্যবহার করে। এরকম আরও অনেক উদাহরণই দেওয়া যায়। আমরা বরং খুব সংক্ষেপে পুরো বিশ্বের চিত্রটা এক নজরে দেখার চেষ্টা করি।
বৃটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি তাদের এক পরিসংখ্যানে জানাচ্ছে যে, সারা বিশ্বে ২০১০ সালে পিভি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩৯৭৭৮ মেগাওয়াট, ২০১২ সালে এসে সেই ক্ষমতা দাঁড়ায় ১০২০২৪ মেগাওয়াটে। অর্থাৎ ২ বছরের মধ্যে এই খাতে উৎপাদন বেড়েছে ৬২২৪৬ মেগাওয়াট। বিশ্ব জুড়ে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন কিভাবে বেড়েছে নিচের রেখাচিত্রটা তার একটা প্রমাণ হতে পারে। দেখুন, কী বিস্ময়করভাবে বাড়ছে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন!
বলে রাখা যেতে পারে যে, মানুষের প্রয়োজনে সৌরশক্তির ব্যবহার নতুন কিছু নয়। হাজার হাজার বছর আগেও মানুষ নানা প্রয়োজনে সূর্যের প্রখর আলোক ব্যবহার করে আসছে।
পিভি’র উদ্ভাবন করা হয় ১৮৩৯ সালে। ঐ বছর ফরাসী পদার্থবিদ এডমন্ড ব্যাকুরেল প্রথম পিভি’র কিছু কার্যক্রম প্রদর্শন করেন। তিনি দেখান যে, কিছু বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এলে তাদের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়। এর ৬৬ বছর পর, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন এই ফটোভোলটেইকের মূল ভিত্তি ফটো ইলেকট্রিক ধারাণাটিকে আরও স্পষ্ট করে তোলেন। এই ফটো ইলেকট্রিক সংক্রান্ত গবেষণার জন্যই তিনি ১৯২১ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৫০ সালের দিকে সোলার প্যানেল বা সৌর কোষের ব্যবহার শুরু হয়, ১৯৬০ সালে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অগ্রগতিটি সাধিত হয় ১৯৭০ সালে, ঐ বছর প্রতি ওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ প্রায় ৮০ ভাগ কমানো সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের উন্নূয়নের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এটা খুবই সহজভাবেই বোধগম্য। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের যোগানটা নিশ্চিত করা সন্দেহাতীতভাবেই কঠিন।
অনেকে মনে করেন, গ্যাস, তেল বা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুতের পুরো চাহিদা কখনই মেটানো সম্ভব নয়, সাময়িকভাবে চাহিদা পূরণ কোনভাবে করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। বাংলাদেশের জন্য এখনই কেন বিকল্প বিদ্যুতের প্রয়োজন বিদ্যুৎ পরিস্থিতির বিদ্যমান কিছু চিত্র বিশ্লেষণ করলে নিশ্চয়ই তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেশের মাত্র ৩০-৪০% মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, যেখানে মাথাপিছু বিদ্যুত ভোগের পরিমাণ মাত্র ২৫. ৬৪ ওয়াট। সারা পৃথিবির সকল মানুষ গড়ে ব্যবহার করে ৩১৩ ওয়াট। আমাদের প্রতিবেশি ভারতে এই পরিমাণটি ৮৫, পাকিস্তানে ৪৭, শ্রীলংকা ৫২, ভুটান ৩০ আর নেপাল ২১ ওয়াট।
অর্থাৎ মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়াতেই আমরা আছি অনেক নিচে। দেশের প্রায় ৮৭ হাজার গ্রামের অধিকাংশ এলাকাতেই বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালের একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৮২ ভাগই আসে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে, যার পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। জ্বালানী খাতের ২০১০ সালের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ৩৪০০০ মেগাওয়াট। আর এসব কারণেই কুইক রেন্টাল, গ্যাস বা তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ দিয়ে এত বিপুল চাহিদা পূরণ করা হবে প্রায় অসম্ভব।
প্রয়োজন তাই বিকল্প অনুসন্ধান। আমি বলছি না যে, সৌরবিদ্যুতই সেই মহৌষধ। তবে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুলো সৌরবিদ্যুত বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতে যথেষ্ট কার্যকর স্বস্তির কারণ হতেই পারে।
সৌরবিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশ। ভৌগলিক কারণে দেশে এখানে বছরে প্রায় ৩০০ দিনেরও বেশি রোদ থাকে।
এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি সংস্থা ‘ইডকল’ এ ক্ষেত্রে সহজশর্তে ঋণ এবং বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ছোট আকারের ‘সোলার হোম সিস্টেমস’ বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। সাধারণত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থালি ব্যবহারকারীদের সোলার হোম সিস্টেমের প্রধান গ্রাহক হিসেবে টার্গেট করা হয়েছিল। ইডকল ২০১৪ সাল নাগাদ দেশে আড়াই কোটি সোলার হোম সিস্টেম বিপণনের টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে। সূর্যের আলো থেকে সর্বোচ্চ ৫০ ওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদনের সোলার সিস্টেমই ইডকল প্রধানতত সরবরাহ করে আসছে।
৫০ ওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে চারটি ছয় ওয়াট ক্ষমতার অ্যানার্জি বাল্ব জ্বালানো, ১৭-১৮ ইঞ্চি পর্দার একটি সাদা-কালো টেলিভিশন চালানো এবং একটি মোবাইল ফোন চার্জার ব্যবহার করা যায় বলে ৫০ ওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম সহজে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ৫০ ওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেমের মূল্য প্রায় ৩০ হাজার টাকা। ইডকলের সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে গ্রাহক মাসিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিস্তিতে ধীরে ধীরে মূল্য পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছে।
সরকারি বেশ কিছু নীতিমালাও সৌরবিদ্যুতের প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি শহরাঞ্চলে গ্রিডলাইন থেকে বিদ্যুৎ-সংযোগ পেতে আবশ্যিক শর্ত হিসেবে চাহিদার ৩ শতাংশ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য ছাদে সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম স্থাপন করার বিধি চালু হয়েছে।
২০১০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ছাদে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮ কিলোওয়াট/ঘণ্টা উৎপাদন ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম স্থাপন করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ছাদেও সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম বসানো হয়েছে।
সৌরবিদ্যুতের বিস্তার বাংলাদেশকে কিভাবে লাভবান করতে পারে? এর প্রথম ও প্রধান উত্তর হলো- প্রথাগত বিদ্যুতের উপর ঝুঁকিপূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। আর ব্যাপক প্রত্যন্ত অঞ্চলকে বিদ্যুতের আওতায় এনে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ তো থাকছেই।
সৌরবিদ্যুতের প্রসারের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা সম্ভব।
সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানো, তার রক্ষাবেক্ষণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকের প্রয়োজন হবে। তাছাড়া এটি যদি সম্প্রসারিত হয়, এর যদি চাহিদা বাড়ে তাহলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগরি ও সেব সংক্রান্ত নানা শিল্প ও কাজের সুযোগ তৈরি হতে পারে। ব্যাটারি তৈরি, তার তৈরি, বিভিন্ন সুইচ তৈরির উপ শিল্প খাতও গড়ে উঠা অসম্ভব কিছু না।
বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য জাতীয় যে গ্রিড আছে সেটা রক্ষণাবেক্ষণ বেশ জটিল ও দুরূহ। নানা কারণে এই কেন্দ্রীয় বা জাতীয় গ্রিডের কোথাও কোনও সমস্যা হলে সারা দেশকেই এর জন্য ভোগতে হয়।
সৌরবিদ্যুতে উৎপাদনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় যদি ছোট ছোট গ্রিড লাইন তৈরি করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়, তাহলে জাতীয় গ্রিডের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
শহরের বাইরে সৌরবিদ্যুতের আলো পৌঁছানো গেলে সেখানেও নানা ধরনের কলকারখানা, বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে সেবা ও কর্মসংস্থানেরও সুযোগ বেড়ে যাবে।
সোলার পাম্প ব্যবহার করে কৃষক তার কৃষি উৎপাদন খরচ কমাতে পারেন। সেচ, ফসল মাড়াই ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার উৎপাদনশীলতাও বাড়িয়ে দিতে পারে।
শুধুমাত্র সেচের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ কতটুকু আর্থিক সুবিধা আনা যেতে পারে তার একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশের একটি ইংরেজি দৈনিক এবং ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কম্পিউটার এপ্লিকেশন্স’ জানুয়ারি ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত বাংলাদেশী দুই গবেষকের একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, বুরো সিজনে দেশে বিভিন্ন ধরনের মোট ১.৩৩ মিলিয়ন পানির পাম্প ব্যবহৃত হয়। এগুলোর প্রায় ৮৭% ডিজেল চালিত, যার জন্য প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন লিটার ডিজেল লাগে। ০.১৮ মিলিয়ন পাম্প বিদ্যুৎ চালিত। সৌরবিদ্যুতের পাম্প ব্যবহার করা গেলে দেশে প্রতিবছর ৮০০ মিলিয়ন লিটার ডিজেল ও প্রায় ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাঁচানো সম্ভব।
২০ একরের জমিতে সেচ করার জন্য ৩০ লাখ টাকা দিয়ে একটি পাম্প বসানো হলে, এর পরবর্তী ২০ বছর প্রায় কোন রকম রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ছাড়াই এটি চালানো যাবে। সেই হিসেবে ২০ একর জমির জন্য প্রতি বছর সেচ বাবদ খরচ পড়ছে ১.৫ লাখ টাকা। কমপক্ষে ৫০ জন কৃষক এই সুবিধার আওতায় আসতে পারে।
সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে দেশের মৎস্যখাতও ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দেশের মোট জিডিপি’র শতকরা প্রায় ৫% আসে মৎস্য খাত থেকে।
আর মৎস্য শ্রমিক আছে প্রায় ১ কোটি। অনেক মৎস্য শ্রমিক ও আহরণকারী তাদের সংগৃহীত মাছ সংরক্ষণ করতে না পেরে কম দামে বাজারে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। উপকূলীয় কিছু এলাকা এবং চর এলাকার মৎস্য আহরণ ক্ষেত্রগুলোর অধিকাংশকেই সাধারণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব নয়, ফলে সৌরবিদ্যুৎ হতে পারে সেখানে উত্তম ও কার্যকর বিকল্প।
তথ্য প্রযুক্তি বর্তমান সময়ের উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি হিসেব পরিগণিত হয়। তথ্য প্রযুক্তির সুফল গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে চাইলেও প্রয়োজন বিদ্যুৎ।
সৌরবিদ্যুৎ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈকিক কর্মকা-ে ব্যাপক নারী গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করণ, শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এই বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশের মতো দেশে সৌরবিদ্যুতের সুবিধা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায় হলো এর জন্য প্রয়োজনীয় এককালীন বিনিয়োগ। অনেকের পক্ষেই এককালীন এই বিনিয়োগ করাটা কষ্টকর হয়ে পড়ে। অবশ্য মাসিক কিস্তি ভিত্তিক পদ্ধতিটি এক্ষেত্রে সমাধানের একটি উপায় হতে পারে।
অন্য আরেকটি সমস্যা হলো, সৌরবিদ্যুতের জন্য প্রযোজনীয় উপকরণের মাত্র ১৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। আমদানিনির্ভরতার কারণে সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেমের মূল্য এখনো বেশি। তাছাড়া সোলার সিস্টেম স্থাপন পরবর্তী সেবার মান নিছের অনেক প্রশ্ন আছে। সৌরবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের কাজকর্ম সমন্বয়, তদারকি ও মান নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান এখনও গড়ে ওঠেনি।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের মহৌষধ হিসেবে সৌরবিদ্যুৎকে হাজির করা বা প্রমাণ করার সময় এখনও হয়নি।
তবে সাময়িক বিনিয়োগ, বা সাময়িক কিছু সমস্যার কথা বিবেচনায় না এনে, দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার কথা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ঠ মহলে বিষযটি নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এখন জরুরি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।