জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় যেকোনো দিন ঘোষণা করা হবে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আজ বুধবার যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন।
আজ রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজ আসামিপক্ষের দেওয়া যুক্তি খণ্ডন শেষ করেন। এ সময় মুজাহিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
এ সময় আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন মুজাহিদ।
এটি হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চতুর্থ রায়। এর আগে জামায়াতের সাবেক নেতা আবুল কালাম আযাদ, জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দেন এই ট্রাইব্যুনাল।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মুজাহিদের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ট্রাইব্যুনাল তা ফেরত দিয়ে সুবিন্যস্ত করে পুনর্দাখিলের আদেশ দিলে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি অভিযোগ পুনর্দাখিল করা হয়।
২৬ জানুয়ারি অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২৫ এপ্রিল এই মামলা ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালে নতুন করে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়।
গণহত্যা, অপহরণ করে বন্দী রাখা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন ও এসব অপরাধে সহযোগিতা, প্ররোচনা, উসকানি দেওয়ার সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে।
প্রথম অভিযোগ
ইত্তেফাক-এর তত্কালীন নির্বাহী সম্পাদক সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধে পাকিস্তানি সেনাদের এদেশীয় সহযোগীদের হাতে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের নিগ্রহের বিবরণ তুলে ধরেন।
এই প্রবন্ধের বিরোধিতা করে একাত্তরের ১৬ সেপ্টেম্বর জামায়াতের মুখপত্র ‘সংগ্রাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তাঁকে ‘ভারতের দালাল’ উল্লেখ করে সমালোচনা করা হয়। তিনি জামায়াত ও আলবদরের লক্ষ্যে পরিণত হন। এর জের ধরে ১০ ডিসেম্বর রাত তিনটার দিকে মুখ ঢাকা সাত-আটজন যুবক চামেলীবাগের ভাড়া বাসা থেকে সিরাজুদ্দীনকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফেরেননি, তাঁর মরদেহও পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় অভিযোগ
একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি মুজাহিদ, জনৈক হাম্মাদ মাওলানা, ৮-১০ জন অবাঙালি ও পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুরের তিনটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রাম বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গিতে হামলা চালায়।
ওই হামলায় ৫০-৬০ জন হিন্দু নিহত হন। তাঁদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগ
জুনের প্রথম সপ্তাহে রাজাকাররা ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিত্ নাথ ওরফে বাবু নাথকে খাবাসপুর মসজিদের কাছ থেকে ধরে পুরাতন সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত মুজাহিদের ইঙ্গিতে রাজাকার ও অবাঙালিরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের পূর্ব দিকে জনৈক আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে আটকে নির্যাতন করে। রাতে রণজিত্ পালিয়ে যান।
চতুর্থ অভিযোগ
২৬ জুলাই সকালে গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর গ্রামের জনৈক মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে রাজাকাররা অপহরণ করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বেলা ১১টার দিকে মুজাহিদ সেখানে গিয়ে এক পাকিস্তানি মেজরকে কিছু বললে ইউসুফের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু হয়। তিনি সেখানে এক মাস তিন দিন আটক থেকে নির্যাতনের শিকার হন। একপর্যায়ে তাঁকে যশোর সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগ
৩০ আগস্ট রাত আটটার দিকে মতিউর রহমান নিজামীকে সঙ্গে নিয়ে মুজাহিদ নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যান।
সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদকে দেখে তাঁরা গালিগালাজ করেন। মুজাহিদ একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে এঁদের মেরে ফেলতে হবে। ওই সিদ্ধান্ত অনুসারে মুজাহিদ তাঁর সঙ্গীদের সহযোগিতায় তাঁদের অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করেন। তাঁদের কারও মরদেহও পাওয়া যায়নি।
ষষ্ঠ অভিযোগ
মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে মুজাহিদ দলীয় নেতাদের নিয়ে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন।
ওই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। এ ঘটনায় মুজাহিদের বিরুদ্ধে হত্যা বা গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়।
সপ্তম অভিযোগ
১৩ মে বেলা দুইটা থেকে আড়াইটার মধ্যে রাজাকার কালু বিহারি, ওহাব, জালাল ও অন্যদের সঙ্গে মুজাহিদ গাড়ি (জিপ) করে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার খলিলপুর বাজারে শান্তি কমিটির কার্যালয়ে যান। সেখানে সভার পর মুজাহিদ সঙ্গীদের নিয়ে হিন্দু-অধ্যুষিত বাকচর গ্রামে হামলা চালান। বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেণ সিকদার, সানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলধর মিত্র, সত্য রঞ্জন দাস, নরদ বন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহা প্রমুখকে বাঁধা হয়।
মুজাহিদের নির্দেশে তাঁদের হত্যা করা হয়। রাজাকাররা এক হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করে। মুজাহিদ ও তাঁর সঙ্গীরা অনিল সাহার বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে ওই পরিবারের মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।
সুত্র: ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।