সন্ধ্যায় আড্ডা হতো, অনেকেই এই সময় আবার হাটত। এমনি এক দিন পাশ থকে আসা কিছু অস্পষ্ট ক্ষীণ শব্দে ঘুরে তাকাই, দেখি এক ছোট্ট মেয়ে মায়ের হাত ধরে হাঁটছে। খুব কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ওর মুখ ফুটে বের হচ্ছে কিছু অস্পষ্ট আওয়াজ। বুঝতে অশুবিধা হলো না বাচ্চা এই মেয়েটি বাক প্রতিবন্ধি বা আমাদের প্রচলিত ভাষায় বোবা। ওর কথা বলার চেষ্টা বাড়তে থাকে, আওয়াজ গুলো আরও উচ্চ মাত্রায় বাতাসে আঘাত হানতে থাকে।
আশেপাশের সবাই অবাক ভীত চোখে তাকায়। অনেকে গুণী মন্তব্য ছুরতে থাকে কী দরকার এমন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বাইরে বের হবার। কেও আবার বলে অমুক পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে, কেও বলে অমুক ডাক্তারের কাছে নেয় নাই কেন? কেও বলে অমুক হোমিওপ্যাথির ডাক্তার এই রকম রোগী ঠিক করেছেন আরও অনেক মন্তব্ব। কিন্তু কাওকে স্বাভাবিক ভাবে ছোট্ট এই বাচ্চাটির দিকে তাকাতে দেখিনি, কাও কে দেখিনি ওর মাথায় হাট বুলাতে। সবাই তাঁদের ধারনা, চেতনা, সচেতনতার বুলি ঝেড়েছেন।
আর যা গণভোটে পাশ হয়েছে তা হচ্ছে বিরক্তি ভরা দৃষ্টি, বিরক্তির প্রকাশ।
এই বাচ্চাটাকে অনেক দিন দেখেছি, কখনো ফুটপাতের ধারের রাস্তায় ও আমার পাশে বসেছে, কখনো বা চত্বরে। করুন চোখে ওর দিকে তাকানো ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। খুব খারাপ লাগে আরও খারাপ লাগে যখন মানুষ এই শিশুটিকে নিয়ে তাঁদের অত্তাধিক চিন্তার কথা নিজেদের মধ্যে বলা বলি করে। অনেকেই বলে এই সব শিশু কি করবে? তাঁদের ভবিষ্যৎ কি? বিয়ে হবে কীভাবে? পড়ালেখা করবে কীভাবে? কোন কাজ কি করতে পারবে?
হায়রে সমাজ হায়রে সামাজিক বাংলাদেশী নাগরিক কত সচেতনতা।
পাশের বাসার বসির মিয়া না খেয়ে থাকলে কেও তো খাওয়া পাঠায়, কত পথ শিশু রুটি চুরি করে গণধোলাই খায়, কত গরীব শিশু ফেরি করে অর্থ কামায় তবুও কথা থামেনা। এইটা হলে কি হতো? ওইটা হলে ভালো হতো। অমুক কিছু করে না কেন তমুক তো ভাদ্দাইম্মা ইত্যাদি।
আর সবচাইতে ভালো কথা শুনি কেও অসুখে পড়লে, মারা গেলে, চিকিৎসা নিলে। এদের জন্য মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
চিন্তার অন্ত থাকে না। আর কানা, বোবা, খোঁড়া, বয়রা হলে তো টাকে নিয়ে কথা থামার কোন কারণ নাই। এইটা তো মহান আলোচনার বিষয়। আর এই কানা, বয়রা, খোঁড়া, বোবা যদি হয় কোন শিশু তাহলে তো মহা আনন্দের সংবাদ। এইমাত্র মহান সমাজ একটি বোবা শিশু পাইয়াছে, কানা, বয়রা শিশু পাইয়াছে।
এটাতো মহাগবেষণা করার খনি। একে পীরের কাছে নিয়ে পীরের ক্ষমতা দেখতে হবে, হুজুরের পানি পড়ার কুদরতি খমতা কতটুকু এইবার তার প্রমান হবে। আমুক ডাক্তার, হাকিম, কবিরাজের দক্ষতা কেমন এইবার তা জানা যাবে। একটি প্রতিবন্ধী শিশু আমাদের সমাজে আজ গবেষণা করার ইঁদুর।
একটি প্রতিবন্ধী শিশু এই সমাজে বোঝা, কিন্তু এই শিশুটি যখন কিছু করে যেমন ভালো ছবি একে পুরস্কার পায়, জ্ঞান গেয়ে পরিচিতি পায়, খেলাধুলায় তাক লাগায়, বা কোন সৃষ্টিশীল দৃষ্টি কাড়া আসবাব বানায় তখন মারহাবা সুবাহানাল্লাহ গর্বিত নাগরিকের গর্ব প্রকাশের বন্যা শুরু হয়।
অথছ বাড়ির পাশের এই শিশুটি যখন কিছু করার চেষ্টা করতো তখন কে টাকে উৎসাহ দিতো?? কে তার দিকে ভালো ভাবে তাকাতো?? কে তার প্রসংশা করতো??এই দেশে আজকে যাকে জুতা পেটা করা হয় গালিগালাজ করা হয় কাল সে তার নিজ চেষ্টায় কিছু করে নাম করলে গর্বে পরিনত হয়।
করুন চোখে ছোট্ট পরীর দিকে তাকিয়েছি, ওর দিকে যখন মানুষ বিরক্তি ভরা চোখে তাকিয়েছে তখন মনে মনে ওর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। তুমি ক্ষমা করো, তুমি সবাইকে ক্ষমা করে দাও, এই সমাজ শিক্ষার কথা বলে এই সমাজ শিক্ষিতর কথা বলে যার অধিকাংশ সুশিক্ষিত হতে পারেনি, এই সমাজ কু-শিক্ষিতদের। ক্ষমা করে দাও ক্ষমা করে দাও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।