আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শব-ই মি’রাজ

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর দীর্ঘ ১২টি বছর কুরাইশদের বাঁধা বিপত্তির মোকাবেলায় মহান আল্লাহর বিধান প্রচার প্রসার ও স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছলেন, যখন চারিদিকে অসত্যের ধারক বাহকগণ হিংস্রতার চরম আঘাত হানতে প্রস্তুত, সাহায্যকারী মানুষের মধ্য হতে প্রাণপ্রিয় সঙ্গীনী হযরত খাদীজা (রা.) ও চাচা আবূ তালিব লোকান্তরিত, অসত্যের কোপানলে মক্কাভূমি উত্তপ্ত, মা হালিমার (রা.) স্নেহ ভূমি তায়িফ হতে নিদারুন আশাহত হয়ে ফিরে এসে মানসিক দিক দিয়ে চরম বিপর্যস্ত-এমনি এক সংকটকালে অনতিবিলম্বে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বের বুকে আগত সকল মানুষের উপর মহান আল্লাহর বিধানাবলী কার্যকর করার বাস্তবধর্মী ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে সর্বোপরি সময় ও কালের উর্ধে উঠে সকল সৃষ্ট বস্তু ও তার প্রতিক্রিয়াকে উপলব্ধি, সৃষ্টি জগতের গোপন রহস্য অবলোকন ও মনোবল দৃঢ় করার নিমিত্ত মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় মহানবী (সা.) মদীনায় হিজরতের ১ বছর পূর্বে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে সশরীরে মি’রাজে র মাধ্যমে জাগতিক ২৭ বছর সমপরিমাণ সময় ব্যয় করেছিলেন। প্রত্যেক নবী রাসূলের জীবনেই কিছু না কিছু মু’জিযা বা অলৌকিক ঘটনা থাকে। মহানবীর (সা.) মু’জিযা সমূহের মধ্যে মি’রাজ অন্যতম। এটি এমনই একটি ঘটনা যার সাথে রয়েছে ঈমানের গভীরতম সম্পর্ক। কাজেই মি’রাজের বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজতে যাওয়া একটি অবান্তর চিন্তা।

বলা বাহুল্য, যুক্তি কোন দিনই ঈমানের ভিত্তি নয়, ঈমানই হচ্ছে যুক্তির ভিত্তি। বরং যুক্তির ক্ষমতা যেখানে শেষ ঈমানের যাত্রা সেখান থেকেই শুরু। তারপরও কোন কোন মহৎ ব্যক্তির এ ব্যাপারে যুক্তির অবতারণা সেটা শুধু ঈমানের স্বাদ অনুভব করার জন্যই। বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতার যুগে আমরাও তাই মি’রাজকে বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে স্ব-শরীরে মি’রাজের সত্যতা যাচাই করতে যেয়ে আমরা নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর সমাধান দেয়ার চেষ্টা করব।

 পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বেড়াজাল কিভাবে ছিন্ন্ করা সম্ভব?  জড় দেহ নিয়ে কিভাবে মি’রাজ সম্ভব হয়েছিল?  সময় সংক্রান্ত অসামঞ্জস্যতা এর ব্যাখ্যা কী?  পূর্ববর্তী নবীগণের সাথে সাক্ষাৎ কী করে হল? পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ঃ মহানবীর (সা.) স্ব-শরীরে মি’রাজের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধবাদীদের প্রধান যুক্তি হল জড় জগতের নিগঢ়ে আবদ্ধ স্থূল দেহী মানুষ কিভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করে আকাশলোকে বিচরণ করে? তাছাড়া পৃথিবীর আকর্ষণীয় শক্তি যেখানে শূণ্যে অবস্থিত স্থূল বস্তুকে মাটির দিকে টেনে নামায় সেখানে কী করে মহানবী (সা.) স্ব-শরীরে মি’রাজে গমন করেন? গতি বিজ্ঞান ((Dynamics)) মাধ্যাকর্ষণ তত্ব (Law of Gravity) এবং আপেক্ষিক তত্বের (Law of Relativity) সর্বশেষ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার আলোকে মি’রাজের ঘটনাকে বিচার করলে এর সম্ভাব্যতা সহজেই আমাদের কাছে বোধগম্য হয়ে উঠে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীগণ বিশ্বাস করতে পারেনি যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ভেদ করা সম্ভব। যেমন স্যার আইজাক নিউটনের সূত্র অনুসারে- "law of motion and the idea of universal gravitation" বা মাধ্যাকর্ষণ নীতি যা ডিংগানো অসম্ভব। কিন্তু সত্তর এর দশকের বিজ্ঞানীগণ চাঁদে পৌঁছার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ডিংগানো সম্ভব। এ সম্পর্কে আধুনিক বৈজ্ঞানিক Arther G Clark তাঁর `The exploration of space’ গ্রন্থে বলেছেন, "As the distance from the earth lengthens in to the thousand of miles the reduction (of Gravity) becomes substantial twelve thousand miles up, an one–pound weight would weight only an one ounce. It follows, therefore, that further away one goes from the Earth. The easier it is to go onwards’’. তিনি অন্যত্র বলেছেন, "Gravity y steadily weakens as we go up words away from Earth, until at very great distances it becomes completely negligible’’. এভাবে আকর্ষণ ক্ষমতা যখন মোটেই বোঝা যায় না সে অবস্থাকে Zero Gravity বলা হয়।

গতি বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, ঘন্টায় ২৫,০০০ মাইল বেগে ঊর্ধালোকে ছুটতে পারলে পৃথিবীর আকর্ষণ হতে মুক্তি লাভ সম্ভব। এ গতি মাত্রাকে তারা মুক্তি গতি (Escape velocity) নামে আখ্যায়িত করেন। আমরা জানি মহানবী (সা.) ‘বুরাক’ নামক এক অলৌকিক বাহনের উপর বসে ঊর্ধালোকে গমন করেছিলেন। আরবী শব্দ ‘বারকুন’ অর্থ বিদ্যুত। বুরাক বলতে মূলত বিদ্যুত থেকে অধিক গতি সম্পন্ন বাহনকে বুঝায়।

অতএব দেখা যাচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ যুক্তি দ্বারা মি’রাজের সম্ভাবনাকে নিবারিত করা যাচ্ছে না। জড় দেহ নিয়ে মি’রাজে গমন ঃ মহানবীকে (সা.) এ ধরাপৃষ্টে রক্ত মাংসের মানুষ হিসাবে দেখা গেলেও তিনি ছিলেন ভিন্নধর্মী। যেমন গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “বাহির হতে হযরতকে জড় দেহী মানবরূপে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি জড় ধর্মী ছিলেন না; পদার্থের যা সার-সে জ্যোতি বা নূর দ্বারাই তাঁর দেহ গঠিত ছিল। ” সুতরাং যার দেহ নূর বা আলোক তাঁর পক্ষে দ্রুততম গতিতে কোথাও ভ্রমন করা অসম্ভব নয়। দ্রুততম গতির জন্য ঊর্ধলোকে তাঁর ওযন কমে যাওয়ার ফলে আরও গতিশীল হওয়া এবং সকল প্রকার আকর্ষণের (Gravity) বাইরে চলে যাবার বিষয়টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং সর্বদিক বিচারে যুক্তিযুক্ত।

 সময় সংক্রান্ত অসামঞ্জস্যতা এর ব্যখ্যা ঃ আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রবক্তারা বলছেন, সময়ের স্থিরতা বলতে কিছুই নেই, ওটা আমাদের মনের খেয়াল মাত্র। বস্তুত সময় সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান ও ধারণা আপেক্ষিক। সময়ের প্রভাব সকলের উপর সমান নয় বলেই আইনষ্টাইন বলেছেন, "There is no standard time, all time is local. দর্শকের গতির তারতম্যে বস্তু বা ঘটনার স্থান নির্ণয়ে তারতম্য ঘটে। আবার একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত দু’টি ঘটনা দর্শকের গতির তারতম্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হচ্ছে বলে মনে হয়। গতির মধ্যে সময় অস্বাভাবিকভাবে খাটো হয়ে যায়।

সময় সম্বন্ধে আমাদের ধারণার এই আপেক্ষিকতা গতি সম্বন্ধীয় স্বত:সিদ্ধের ওপর আপতিত হলে যে ফলাফল দাড়ায় তা হল স্থান ও কাল সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিটা একটা গোলক ধাঁধার মধ্যে আপতিত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা নয়। আলোক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে এটা আজ সবার জানা যে, আলোকরশ্মি সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল অতিক্রম করে। আলোর গতিই সর্বোচ্চ-এ ধারণাও ইদানিং আবার ধ্র“ব সত্য হিসাবে স্বীকৃত নয়। Herold Leland Goodwin তার Space Travel গ্রন্থে বলেছেন, “আলোর গতি অপেক্ষা মনের গতি ঢের বেশী।

” যাই হোক, আলোর গতির সাথে কোন বস্তুর গতির সামঞ্জস্যের তারতম্যই (Degree of Dispersion) সময়ের তারতম্য ঘটার অন্যতম কারণ। উপরের বৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহের আলোকে মি’রাজের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বোরাক আরোহী মহানবী (সা.)-এর গতির মাত্রা এত বেশী ছিল যে, সকল ঘটনাই পৃথিবীর দর্শকের কাছে কয়েক মুহূর্তের ঘটনা বলে মনে হলেও কালের প্রবাহে তা ছিল দীর্ঘ সময়। পূর্ববর্তী নবীগণের সাথে সাক্ষাৎ ঃ মহান আল্লাহর সৃষ্টি এই মহাবিশ্ব মূলত: আলোর সমুদ্র ও আলোর মেলা। গোটা সৃষ্টিলোক আলো আর আলোতে তরঙ্গায়িত। আলোর গতি ও প্রকৃতি হল বক্রাকার এবং থেকে থেকে আসা।

আর বৃত্তাকার বা থেমে থেমে আসার কারণে এর মধ্যে ধরা পড়ে সম্মুখের ঘটমান দৃশ্যপটের চিত্র। এভাবে সৃষ্টির মাঝে যাবতীয় ক্রিয়া কর্মের রেকর্ড স্ব-চিত্রাকারে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। আলোর গতির সম পরিমাণ গতিতেই মহাবিশ্বের অতীত দিনের সকল ঘটনা ও ক্রিয়াকান্ড সংরক্ষিত হয়ে আছে। যদি কোন ব্যক্তি বা সত্ত্বা আলোর গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে মহা বিশ্বের প্রান্তরের দিকে ছুটে যায় তাহলে সে ঘটনা প্রবাহের বিভিন্ন স্তর অতিক্রমকালে অতীতের সকল ঘটনাই সে ঘটমান অবস্থায় জীবন্ত দেখতে পাবে। এভাবেই তিনি যখন তিনি আলোর সর্বোচ্চ গতিতে চলতে ছিলেন তখন হযরত ঈসা, মূসা, ইব্রাহীম, আদম (আ.) ও অন্যান্য অতীত ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

তাই নবী ও রাসূলদের সাথে বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ মোটেই অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক নয়। মূলত তা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। মি’রাজের ঘটনাবলী আমাদের চিন্তা ও কল্পনাকে উর্ধমুখী করে। বিজ্ঞানের নভোচারিতায় অভূতপূর্ব সাফল্য তার বাস্তব প্রমাণ। বস্তুত যে দিক দিয়েই দেখি না কেন; মি’রাজ সত্যিই এক অপূর্ব ঘটনা।

এ সম্বন্ধে চিন্তা করলেও হৃদয় পবিত্র হয়, মনের দিকচক্রবাল সম্প্রসারিত হয়ে যায়। মূলত মিরাজ মানব জাতির জন্য সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক এক কথায় ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল সাধন করেছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.