আমি একটা সংসার চালাই, পরিবারের সদস্যদের অকৃত্রিম ভালবাসি বলেই তাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়াতে আমার হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। মাঝে মধ্যে ভাবি, যদি কর্তার দায়িত্ব কেহ নিয়ে আমাকে কেবল সদস্য হিসেবে থাকবার সুযোগ দিতো, তাহলে কতই না সুখে থাকতাম! দেশ নামক বিশাল একটি পরিবারকে চালানোর দায়িত্ব পেতে গিয়ে আমাদের নেতাদের দৌঁড়ঝাপ দেখে ভাবি, দেশ চালানো কি তাহলে এতই সহজ! একটি জানা উত্তর, পরিবারের সদস্যদের আন্তরিকভাবে ভাল না বাসলে একটি পরিবার চালানো মামুলী ব্যাপার! দেশের মানুষকে পরিবারের সন্তানের মতো ভাল না বাসলে দেশ চালানোও কোন ব্যাপারই না! তাই ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে আমরা অনেক সময় নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি, শাস্তি বিধানের দীর্ঘসূত্রিতা প্রকারান্তরে অর্থলোভী অমানুষদের প্রশ্রয় দিয়ে চলে। কথাগুলো একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কিছুটা পরিবর্তিত রূপ।
এদেশের রপ্তানী আয়ের প্রধান খাতটিতে শরীরের ঘাম জলে পরিনত করে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আমাদের সন্তানেরা। গভীর আফসোসের সংগে আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি, এদেশের কিছু রক্তচোষা হায়েনা শ্রমিক জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে বারবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে দেশ অস্ত্র কেনার সামর্থ্য রাখে, উদ্ধার কাজ পরিচালনার আধুনিক ইকুইপমেন্ট সে দেশে নেই - এটিও আমাদের জন্য লজ্জার, চরম ক্ষোভের। তাজরিনের ক্ষত না শুকাতেই ‘রানা ট্রাজেডি’ আমাদেরকে শোকে বিহবল করে তুলেছে। ইতোমধ্যে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিন শতাধিক অসহায় মানুষ। কিছুদিন পর পর ‘মৃত্যুর টেন্ডারবাজি’ আমাদের অনুভূতিতে কিছুদিন নাড়া দেয়। তদন্ত কমিটি, নানাবিধ হৈ চৈ এর মাঝে আমরা সঠিক বিচারের আশ্বাস পাই।
উদ্ধার কাজ শেষ হয়, নতুন কোন ইস্যুতে আমাদের দৃষ্টি ঘুরে, এক সময় তা হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। অন্যদিকে দোষীদের বেশিরভাগই থাকে দুধে ভাতে! হয়তোবা তারই অভিশাপে আবার দূর্ঘটনা ঘটে। যে দেশের মানুষ দুনিয়ার সেরা মেধাবী বলে দাবী উঠে, সে জাতি এত নির্লজ্জ কেন!
আমরা জানি, রক্ত গরম থাকা অবস্থায় এবং সবার নৈতিক অনুভূতি জাগ্রত থাকাকালে কিছু কিছু শাস্তি দেওয়া সুশাসনের ভিত মজবুত করে। তাজরিন ফ্যাশনস, নিমতলী কিংবা স্পেকট্রাম দূর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি জাতিকে দেখিয়ে প্রকাশ্যে দিলে হয়তোবা সাভার ট্রাজেডি আমাদের দেখতে হতো না। একটি অপরাধ বিভিন্ন কুটকৌশলের প্রশ্রয় পেলে তা হাজারো অমানবিকতার জন্ম দেয়।
তাই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা মানুষ হিসেবে আমরা চাই, উদ্ধার কর্মে মানবতার পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান একসাথে চলুক।
ট্রাজেডি অবলোকনে মানবিক চাওয়া-পাওয়াঃ
১। দূর্ঘটনার আগের দিনই বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনে পরীক্ষার সুপারিশ করা হলো। অথচ হৃদয়হীন সোহেল রানা এবং গার্মেন্টস মালিকের আড়ালে কিছু নরপিশাচ শ্রমিকদেরকে মেরে মেরে, ভয় দেখিয়ে কাজে যোগদান করিয়েছেন। এরা এখন কোথায়? এদের শাস্তি কি সত্যি হবে? বিশ্বাস করবো? কোটি কোটি টাকা আছে বলেই যারা বহুতল ভবন, গার্মেন্টস ইত্যাদির মালিক হন, তাদের বেশিরভাগ বহুতল ভবন কেন বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা অনুমোদিত হয়না।
ইতোমধ্যে দেশের ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনগুলো পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য কি কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
২। পরিবারের কর্তা যখন কোন বিষয়ে না জেনেই মিথ্যে কথা বলেন, তখন পুরো পরিবার স্তম্ভিত হয়। উদ্ধারকর্মী, প্রত্যক্ষদর্শী ও বিজিএমইএ বলছে, ভেতরে হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়া। ‘দূর্ঘটনার পূর্বেই সব মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে’ মিথ্যের বেসাতিতে এমন নিরাশকারী মন্তব্য আমাদের হৃদয়ে ক্ষোভের সঞ্চার করে। আমরা লজ্জিত!
৩।
সারাদেশ শোকে বিহবল। স্বঅবস্থান থেকে সম্ভাব্য সব সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন হাজারো মানবিক হৃদয়। শোকের দিনই যখন শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয় তখন তারা বলতেই পারেন, ‘আমাদের কি কষ্ট নাই! আমরা কি মানুষ না!’ যারা এই কাজটি করলেন সেই গার্মেন্টস মালিকরা কি মানুষ নাকি মানুষরূপী শঠ?
৪। সন্তান সম্ভবা নারীদের যেখানে ছুটিতে থাকার কথা, সেখানে ধ্বস্তুপের নিচে আটকা পড়া অবস্থায় যখন সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার খবর পাই, তখন রক্তচোষা হায়েনাদের লজ্জা হয়না কেন! মৃত্যুকূপ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ যখন বলেন, ‘আমাদেরকে হরতাল বিরোধীতার স্বার্থে কাজে যেতে বাধ্য করা হয়েছে’ তখন ক্ষমতার মোহে অন্ধ কিছু সাক্ষাত শয়তানের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। ক্ষমতার নিকট শ্রমিকদের জীবনের মায়া অলংকৃত না হলে সে ক্ষমতাকে নিকুচি করার হিম্মত কেন আমাদের হয় না!
৫।
‘আপনার নিকট কেহ আসে নাই? আসছে ভাই, অনেকে আসে আবার চলে যায়। কেউ বাঁচায় না ভাই। আমাদের বাঁচান ভাই! আমরা বাঁচতে চাই ভাই! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ভাই’ বাঁচার এ নিখাদ আকুতি হৃদয় ভেঙ্গে দিলেও করার কিছু নেই সামনে থাকা মানুষগুলোর। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুদক্ষ জনবলের অপ্রতুলতার ক্ষোভ, লজ্জা বুকে নিয়ে ফেরার কালে ভেতর থেকে ডাক পড়ে, ‘কখন আসবেন ভাই, আমরা মরে গেলে আসবেন ভাই!’ এ ফরিয়াদ যাদের চাপা কষ্ট দেয়, সে জাতির ‘দুর্যোগে মানবতার পাশে দাঁড়ানোর আলাদা বাহিনী’ নেই কেন!
৬। শ্রমিকদের দেখভাল’র দায়িত্বে থাকা বিজিএমইএ’র অবৈধ ভবনে যখন দু’দলের মহাসচিব এক সংগে কেক কাটেন, তখন কি আমরা প্রকারান্তরে অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিলাম না? বলা হচ্ছে, এক প্রধানমন্ত্রী এই অবৈধ ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন, আরেক প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন! দেশের প্রধানরা যদি অনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ রেখে চলেন, তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আমজনতার কি আছে বলেন!
৭।
দূর্ঘটনায় একটি আঙ্গুল কেটে গেছে। এই আঙ্গুল থাকলে সারাজীবন যে সুবিধা হতো, এখন কি কি প্রতিবন্ধকতা সব হিসাব করে ইংল্যান্ডে শ্রমিকদের ক্ষতি পূরণ দেওয়া হয়। বিজিএমইএ কিংবা সরকার আমাদের জীবনের মূল্য ২০ হাজার দিয়ে শেষ করবে তা মানতে আমরা রাজী নই। যারা স্বজন হারালেন, বিভিন্ন অংগ হারালেন, হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহ্য ব্যথায় কাতরাচ্ছেন তাদের পরিবারের অন্তত ৫ বছরের খোরপোষ মালিক ও সরকার চালাবেন - এ আমাদের মানবিক দাবী।
৮।
মানুষ ৩ জন মরলেন না ৩০০ মরলেন সেটি বড় কথা নয়। যে কোন জাতীয় দূর্যোগ হলেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সব প্রোগ্রাম ক্যানসেল হয় আমরা শুনেছি। হাজার হাজার মানুষের আর্তনাদ বুঝে শপথ অনুষ্ঠান ১ঘন্টা পিছিয়ে যদি আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী সাভারে গিয়ে স্বজনহারাদের বুকে টানতেন আমরা খুশি হতাম।
৯। খাল খননের উপর পিএইচডি করা প্রাজ্ঞ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আবোল তাবোল কথাবার্তা আমাদের কষ্ট দেয়।
যারা এত বড় দূর্ঘটনা নিয়ে ভয়ংকর মিথ্যে বলে সাধারণের আস্থা হারান তাদের শাস্তি দেওয়ার কোন আইন কি আমাদের সংবিধানে আছে? আমরা বুঝিনা মানুষ কত বেকুব,বেহিসেবী আর নির্লজ্জ হলে তোলপাড় হবার পরেও নিজের অজ্ঞতায় অনড় থাকেন!
১০। স্বাধীনতার পর থেকে যত দূর্ঘটনা ঘটেছে তার চুলচেরা প্রতিবেদন জাতিকে জানানো হোক। কাকে কাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে আমরা জানতে চাই। কার কার স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে এবং মামার জোরে কে কে শাস্তি পাওয়া থেকে দুরে তা আমরা জানতে চাই। সাভার ট্রাজেডির উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার মধ্যেই তদন্ত প্রক্রিয়াসহ শাস্তি বিধানের স্লথগতি বেগবান হোক - এ আমাদের প্রত্যাশা।
দেরীতে হলেও বিরোধীদল হরতাল প্রত্যাহার করেছে; হেফাজত, গণজাগরণ ও শিবির সব বাদ দিয়ে রক্তদান প্রক্রিয়ায় জড়িয়েছেন; এনাম মেডিকেল ও ইবনে সিনার হিরোরা আপ্রাণ সেবা দিচ্ছেন; ওয়ালটনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন স্ব অবস্থান থেকে মানবতার পাশে দাঁড়িছেন; সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশের সাথে উদ্ধারকর্মে ঝুঁকি নিয়ে প্রাণশক্তিতে কাজ করছেন খেটে খাওয়া হাজারো মানুষ; ব্লগ, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় সাহায্যসহায়ক কর্মের মানবিক প্রচারণা চলছেই - এই সুন্দর এবং মানবিক বাংলাদেশকে আমাদের স্বশ্রদ্ধ সালাম। ‘আগামী ১৫ দিন রাজনৈতিক কর্মসূচী বাদ দিয়ে আর্ত মানবতার পাশে দাঁড়ান’, মাহবুব উল আলম হানিফের এ শাশ্বত আহবানে সাড়া দিয়ে কিংবা স্বপ্রণোদিত হয়ে কারা কাজ করছেন, জাতি তা স্বচক্ষে অবলোকন করছে। না ফেরার দেশে যাওয়া মানুষদের আত্মার শান্তি কামনা করছি, এখনো জীবিত আটকে থাকা মানুষদের বাঁচার করুণ আকুতি, আহতদের ব্যথার যন্ত্রণা এবং স্বজনহারাদের আহাজারি হৃদয়ে ধারণ করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।