সূত্র হতে পড়তে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন
অনুবাদ : মুস্তাফা মাসুদ
বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সব সময়েই ভারতবিরোধী ভূমিকা পালন করে এসেছেন। তার মধ্যে এখন যে পরিবর্তন এসেছে সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার কিছু নেই।
এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হচ্ছে, ততক্ষণে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রী ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সপ্তাহব্যাপী ভারত সফর শেষ হয়ে যাবে। সফরের ফলাফলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার আধ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়েছে। যেখানে কূটনৈতিক পরিভাষায়, ‘পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের নেত্রীকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ভারত বাংলাদেশকে সঙ্গে নেবে এবং ঢাকার স্বার্থকে ছোট করে দেখা হবে না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সবকিছু সন্তোষজনকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বেগম জিয়া যখন উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীসমূহের ওপর বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে অধিকতর স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন, তখন মি. সিং তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তার সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বিরোধিতার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি এবং সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
জানা যায়, বেগম জিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে উদার নীতি, বিগত সময়ের চেয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের রফতানি বৃদ্ধি, বিদ্যুত সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামো শক্তিশালীকরণে ভারতের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর প্রশংসা করেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ এবং সীমান্ত-বিদ্রোহীদের ব্যাপারে তার মনোভাব ইতিবাচক, যে বিষয়টি নয়া দিল্লীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
এখন প্রশ্ন হলো বেগম জিয়ার এ সফর থেকে ভারত কি চায়? সম্ভবত মূল উদ্দেশ্য এই হতে পারে : ভারত এটি নিশ্চিত করতে চায় যে, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে যেমন ভারতের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে, সেটি সে পরবর্তী সরকারের সঙ্গেও অব্যাহত রাখতে চায় সেই সরকারের প্রধান যে-ই হোন না কেন, ঐ সরকার গঠিত হবে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান লে. জেনারেল এইচএম এরশাদ, যিনি সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন, তাকে জানানো আমন্ত্রণের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে বেগম জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়া তার প্রয়াত স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মতোই তীব্র ভারতবিরোধী এবং সহজাতভাবে পাকিস্তানপন্থী।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদফতরকে ১৯৭৭ সালে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরে রূপান্তরিত করেন, যা পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা পরিদফতরের প্রতিরূপ এবং এই পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থাটিকে তিনি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নাড়ির বন্ধনে সংযুক্ত করে দেন। আইএসআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক লে. জেনারেল গোলাম জিলানী খানের ঢাকা সফরের অল্প কয়েক দিন পরই বাংলাদেশের ডিজিএফআই গঠন করা হয়েছিল। এর অনেক কর্মকর্তাকে ইসলামাবাদে অবস্থিত আইএসআইয়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল। গোয়েন্দা ব্যুরোর একজন প্রাক্তন যুগ্মপরিচালক মলয় কৃষ্ণ ধর ক্ষুব্ধভাবে উল্লেখ করেন : আইএসআই-সিআইএ-আল কায়েদা একটি শয়তানী চক্র। আইএসআই ও ডিএফআই ১৯৭৬ সালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গী গ্রুপসমূহকে অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করেছিল।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রক্রিয়াটি কঠিন হয়ে যায়; কিন্তু বেগম জিয়া ২০০১ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তা আরও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত মি. ধরের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ‘গত কয়েক মাসে ৪০টি বেড়ে এখন ১৮০-২০০ ছুঁই-ছুঁই করছে। ’ বেগম জিয়ার নিজস্ব ভারতবিরোধী মনোভাবকে তার জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী আরও উস্কে দিয়েছিল, জাতীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্কে যে দলের নীতিতে ভারতকে বাংলাদেশের একমাত্র শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জেহাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার আহ্বান করা হয়েছিল। জামায়াত, পাকিস্তান এবং মৌলবাদী ইসলামী দল হরকাত-উল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ এবং হিজবুত তাওহীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে ২০০১-২০০৬ সালে বাংলাদেশ আইএসআইয়ের ভারতবিরোধী কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল, এতে বিস্মিত হওয়ার তেমন কিছু নেই।
জামায়াত বেগম জিয়ার সরকারের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে এবং জঘন্যভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায়।
আহমদীয়ারা নির্মমভাবে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসার পরও হিন্দুদের ওপর নারকীয় হামলা চালানো হয়েছিল। হত্যার মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি, ধর্ষণ, সম্পদ লুণ্ঠন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হয়; ১৫ হাজারেরও বেশি হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় পালিয়ে যায়। ১ লাখেরও বেশি নির্যাতিত মানুষ আইনের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছিল; কিন্তু পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর লোকদের কারণে তা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
বাংলাদেশ সরকার নৃশংসতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, ২৫ দিনে যথাক্রমে ২৬৬ ও ২১৩ পুরুষ ও নারী হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়। এই সংখ্যা যদিও যথেষ্ট বেশি, কিন্তু অপরাধের প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্ট অনুযায়ী, হিন্দুদের প্রতি তখন যে নৃশংসতা চালানো হয়েছিল, তা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের নৃশংসতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
ওই একই দৈনিকের ১৬ অক্টোবর সংখ্যায় বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান লেখেন : ‘এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিগত কয়েক দিনে সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলা বাংলাদেশের অনেক এলাকায় অব্যাহতভাবে বিস্তৃত হয়েছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকাসমূহে। সেখানে উপর্যুপরি হামলা হয়েছে; সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িগুলোকে বিরান করে দেয়া হয়েছে।
নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য তাদের অনেকেই অসহনীয় দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাদের ঘরবাড়ি ও দেশের মায়া ত্যাগ করে অশ্রুসিক্ত চোখে ভারতে আশ্রয়ের খোঁজে চলে যায়। ’ বেগম জিয়ার বিগত কার্যকলাপ ও সরকারী রেকর্ডপত্র ছাড়াও আমাদের সামনে ২০০১ সালের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যখন তার ছেলে তারেক জিয়াকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাকে তখন ভারতের শিল্পপতিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং স্বভাবতই তাকে লালগালিচা অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি (বেগম জিয়া) ক্ষমতায় ফিরে আসার পর চিরাচরিত অভ্যাস মতো ভারতের সঙ্গে ঘৃণা ও আক্রমণাত্মক আচরণ শুরু করেন, যা সকলেরই জানা।
তিনি যদি আবারও প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে ওই ঘটনার ব্যত্যয় হবে এটি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। এই অন্তর্বর্তী সময়ে বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর যে তার প্রতি ভারত সরকারের স্বীকৃতির বহির্প্রকাশ এবং এই স্বীকৃতি যে তার পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য অপরিহার্য, তা প্রমাণ করা থেকে কেউ তাকে নিবৃত্ত করতে পারবে না। তার সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় তিনি যে সূক্ষ্ম পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন তার কথা স্মরণ করুন। সে সময় তিনি তার চীন সফরের ফলপ্রসূতার কথা উল্লেখ করে চীনের দেয়া বেশ কিছু প্রতিশ্রুতির বিষয় এমনভাবে বর্ণনা করেছিলেন যেন এই আলোচনা ছিল একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
এই ঘটনা সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের একটি অংশকে তার সমর্থনে ঝুঁকে পড়তে ভালভাবে প্ররোচিত করতে পারে, যারা বিজয়ী পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে।
শেখ হাসিনা যদি আমাদের প্রিয় না হন, তাহলে তাঁর কিছুটা সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু ভারত যদি তার একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারায় তাহলে পুরো দায়ভারই তার ওপর বর্তাবে। তাঁর এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তখন কী ঘটবে যে কোনভাবেই হোক তাকে কী তখন অস্বীকার করা হবে? সূত্র দৈনিক জনকন্ঠ ৮-১১-২০১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।