আমি তখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হসপিটালে ইন্টার্নশীপ করি। আমার ছোট ভাই রাজশাহী নিউ গভঃ ডিগ্রী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সেই সুবাদে রাজশাহী শহরের লক্ষীপুরে বাসা নিয়ে আমি, আমার ছোট ভাই আর মা এই তিনজনের অস্থায়ী খুঁটি গাড়া। হসপিটালে ডিউটি, আড্ডা, মুভি দেখা, সংসারের টুকিটাকি কাজ করা এইভাবে সময়টা বেশ ভালই কাটছিল। এর মধ্যে আমার ছোট ভাই একদিন কোত্থেকে দুইটা খরগোশ কিনে আনল।
পশু-পাখি পোষা আমি ব্যাক্তিগত ভাবে পছন্দ করি না, কারন এদের উপর মায়া জন্মে যায়, আর মায়ার বন্ধন ছিন্ন হওয়া বড় কষ্টের। যাই হোক, খরগোশ দুইটা আমাদের সাথেই থাকতে শুরু করল। দুইটার মধ্যে একটা ছিল সাদা আর একটা খয়েরী রঙের। আমার ছোট ভাই আবার ওদের নামও দিয়ে ফেলল। সাদাটা স্যাম, আর খয়েরীটা সনি।
কিছুদিনের মধ্যে স্যাম আর সনি আমদের পরিবারের একটা অংশ হয়ে উঠল। ছোট ভাই ওদের খাওয়াত, গোসল করিয়ে দিত। মা প্রথমে বাসায় খরগোশ রাখার ব্যাপারে একটু আপত্তি জানালেও, একসময় দেখলাম মাও ওদেরকে আদরযত্ন করতে শুরু করল। বাইরে থেকে ঘাস লতাপাতা এনে আমরা ওদেরকে খাওয়াতাম। একদিন টেবিলে বসে কম্পিউটারে কাজ করছি আর বিস্কুট খাচ্ছি, দেখি স্যাম আর সনি আমার পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে।
আমি এক টুকরা বিস্কুট ওদের সামনে ফেললাম, লক্ষ্য করলাম ওরা বিস্কুটের টুকরাটা আস্তে আস্তে পুরাটাই খেয়ে ফেলল। আমি আরও একটুকরা বিস্কুট দিলাম, সেটাও খেয়ে ফেলল। এরপর থেকে আমাকে বিস্কুট খেতে দেখলেই কোথা থেকে স্যাম আর সনি হাজির হয়ে যেত, আমার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করত। আমি মাঝে মধ্যে বিস্কুট হাতে রেখেই ওদের মুখের সামনে ধরতাম, ওরা আস্তে আস্তে খেয়ে শেষ করত। সাধারনত আমরা ওদেরকে বিছানার উপর তুলতাম না, কারন বিছানায় পায়খানা করে দেওয়ার ভয় ছিল।
একদিন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছি, আমার ছোটভাই ওদেরকে ধরে আমার পিঠের উপর ছেড়ে দিল। ওরা আমার পিঠের উপর চুপ করে শুয়ে পড়ল। আমি যেই উঠে বসার চেষ্টা করি, অমনি ওরা হাঁচড়ে পাঁচড়ে আমার ঘাড়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে, ওদের কান্ড দেখে আমরা ভীষন মজা পাই। এভাবে আমাদের খেলার সঙ্গী হয়ে ওঠে স্যাম আর সনি। বাসায় যতক্ষন থাকতাম ওদেরকে নিয়ে আমরা মেতে থাকতাম, যেন আমাদের পরিবারে অন্য দুই সদস্য স্যাম আর সনি।
এর মধ্যে আমার বিসিএস প্রিলিমিনারী পরিক্ষার দিন চলে আসল। পরীক্ষার দিন সকাল বেলা আমি আমাদের বাইরের ঘরে টেবিলে বসে পড়ছিলাম, আমার বন্ধু মুকুল এসে দরজায় নক করল। আমি দরজা খুলে দিয়ে ওকে ভেতরে আনলাম। পরীক্ষার চিন্তায় কিংবা যে কোন কারনেই হোক আমি দরজা লাগাতে ভুলে গেলাম। আমি আর মুকুল টেবিলে বসে কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
হঠাৎ আমার চোখ গেল ঘরের বাইরের দেয়ালের উপর। দেখলাম একটা বিড়াল দেয়ালের উপর বসে আছে, বিড়ালটা স্যামের ঘাড় কামড়ে ধরে আছে। স্যামের ঘাড়ের কাছটা রক্তে লাল হয়ে আছে, পেছনের পা দুইটা ছুড়াছুড়ি করছে। আমি এক দৌড়ে ঘরের বাইরে গিয়ে বিড়ালটাকে তাড়া করলাম, বিড়ালটাও স্যামকে মুখে নিয়ে দৌড় দিল। বাড়ি আর দেয়ালের মাঝখান দিয়ে ড্রেন চলে গেছে।
বিড়ালটা লাফ দিয়ে ড্রেনের মাঝখানে পড়ল, তারপর দৌড় শুরু করল। আমিও ড্রেনের মাঝ দিয়ে দৌড় শুরু করলাম। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, যেভাবেই হোক স্যামকে বাঁচাতে হবে। দেয়ালটা যেখানে শেষ হয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে বিড়ালটা স্যামকে ছেড়ে দিল, তারপর দেয়াল টপকে বাইরে চলে গেল। দেখলাম স্যামের নিথর দেহ পড়ে আছে, পুরা শরীরটাই রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
বুঝতে পারলাম স্যাম আর নেই, তারপরও আমি ওকে নিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতর গেলাম। কিছুক্ষন সিপিআর দিয়ে ওর বুকে কান লাগিয়ে হার্টবিট শোনার চেষ্টা করলাম, যদি একটা আওয়াজ শোনা যায়। আমার ছোট ভাই পানি দিয়ে ওর শরীরের রক্ত মুছে দিচ্ছিল, আর চোখের পানি ফেলছিল। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না, বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বন্ধু মুকুলকে নিয়ে পরীক্ষার হলের দিকে রওনা দিলাম।
একঘন্টার পরীক্ষা, আমার কাছে মনে হল এক বছর।
পুরা পরীক্ষার সময়টাই আমার চিন্তা জুড়ে থাকল স্যাম। একটাই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসছিল, স্যামের রক্তাক্ত দেহটা মেঝেতে পড়ে আছে, আর আমার ছোট ভাই ওর ছোট্ট শরীরটা থেকে রক্ত মুছে দিচ্ছে। মনে ক্ষীণ আসা, বাসায় ফিরে হয়ত দেখব, স্যাম বেঁচে আছে, সনিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরীক্ষা শেষ করে বাসায় ফিরলাম। দেখলাম ছোট ভাই বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, মা চুপ করে বসে আছে।
তারপরও ক্ষীণ আশা নিয়ে মাকে বললাম, মা, স্যাম কোথায়। মা বলল, বকুল(আমার ছোট ভাই) স্যামকে ডীপ ফ্রীজে ঢুকিয়ে রেখেছে। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, কেঁদে ফেললাম। মা আর বকুল উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, দেখলাম মাও কাঁদছে। বকুল বলল, ভাই স্যামকে আমি বাড়ি নিয়ে গিয়ে কবর দিতে চাই।
আমাদের বাড়ি রাজশাহী থেকে ট্রেনে দুই ঘন্টার পথ। বেলা দুইটায় একটা ট্রেন আছে। স্যামের দেহটাকে ফ্রীজ থেকে বের করে একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে, তারপর কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে ব্যাগে ভরে আমরা রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।
স্যাম এখন শুয়ে আছে আমাদের বাড়ির সামনের বাগানের মাটির নিচে। এতদিনে হয়ত ওর দেহটা মিশে গেছে মাটির সাথে।
স্যামের কথা এখনও আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আর একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে, সেদিন যদি দরজাটা লাগাতে ভুলে না যেতাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।