আমি শিক্ষানবীশ এবং কর্মী । সবার কাছ থেকেই শিখছি । সারা জীবনই হয়ত শিখে যাব। বাংলা সিনেমার বর্তমান অবস্থা জানেনা এমন বাংলাদেশী খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে । এবং এটাও সবাই জানে যে বাংলা সিনেমা এখন শুধুমাত্র নিম্নবিত্তদের খোরাক হয়েই স্রোতে ভেসে আছে।
যাদের শিক্ষা কম বা নেই, তাদের মুল্যবোধ-রুচি-সংস্কৃতি সচেতনতা এইসব ব্যাপারেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাই সিনেমার কর্ণধাররা অশ্লীলতা, নগ্নতা,স্থূলতা,অদক্ষতা,সর্বোপরি তাদের মাত্রাতিরিক্ত মূর্খতার পরিচয় দিয়ে জগাখিচুড়ি কিছু বানিয়ে নিয়ে এসে তীর্থের কাকের মতন অপেক্ষমান কিছু রুচিহীন মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। আর সেই গোষ্ঠী তা গোগ্রাসে গিলছেও। সিনেমা শিল্পের যতই দুর্দশা ঘটুক, অদ্ভুত এবং নোংরা সিনেমাগুলো যারা বানাচ্ছে তাদের কিন্তু খুব বেশি ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ একটা বিরাট গোষ্ঠী তাদের কনজিউমার এবং এটাই তাদের জন্য যথেষ্ঠ।
এজন্যই সিনেমাগুলো বানানোর কাজ চলছে।
যাই হোক, দূরবস্থা যখন থাকে তখন কোনো না কোনো সময় কেউ একজন কিংবা কিছু সংঘবদ্ধ মানুষ এগিয়ে আসবেনই দূর্দশা থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দেয়ার জন্য। কিন্তু কোনো সমাজকে কিংবা সমাজের কোনো অংশকে খুব সহজে পরিবর্তন করা যায় না। পরিবর্তনটা খুব ধীরে আসে বলে চোখে পড়ে না অনেকেরই। বিশেষ করে যারা খুব তিরষ্কার করতে ভালবাসেন।
সমাজের পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসার সাহস ও সাধ্য যাদের নেই। যারা আত্মকেন্দ্রিকতায় বুঁদ হয়ে শুধু নিজের জগত নিয়েই ভাবেন, আর আরাম কেদারায় বসে "দেশ গেল,মানুষ গেল" বলে মায়াকান্না কাদতে থাকেন।
এম এ অনন্ত জলিল এই কাজটি করেননি। সিনেমার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল। খুব ছোট অবস্থান থেকে নিজেকে একজন বিরাট ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এরপর তিনি তার নিজের স্বপ্নপূরণ এবং দেশের সিনেমার জগতে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নিজের টাকা লগ্নী করেছেন। অর্থব্যয় কমানোর জন্য তার সিনেমাতে তিনি ও তার স্ত্রী অভিনয় করেছেন।
পরিবর্তনের কথা বললে মানুষ শুধু আউটপুট কি হল তাই খোঁজে। কিন্তু কেউ ভাবেনা আউটপুটে পরিবর্তন দেখতে চাইলে ইনপুটেই সর্বপ্রথম পরিবর্তনটা ঘটাতে হয়। সেটাই ঘটাচ্ছেন অনন্ত।
যারা খুব কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে বড় পর্যায়ে যান, তারা সাধারণত অর্থের খুব কদর করে থাকেন। মনের কথা শুনে কিংবা সাংষ্কৃতিক উন্নয়নের জন্য অর্থব্যয় তারা কখনই করেননা। কিন্তু অনন্ত করছেন। কারণ তিনি চান তার হাত ধরেই পরিবর্তনটা আসুক। অনেক তো কোটিপতি আছে দেশে, কই কেউই তো এগিয়ে আসেননি রুগ্নদশা-ভগ্নপ্রায় সিনেমা শিল্পটাকে একটু মাথা তুলে দাঁড় করাতে??
খোঁজ(দ্যা সার্চ), গতি(দ্যা স্পীড), হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ, মোস্ট ওয়েলকাম চারটি ছবিরই কাহিনীতেই ছিল পরিবর্তনের ডাক।
সব ছবিতেই তিনি দেখাতে চেয়েছেন তিনি সিনেমা শিল্পেরও পরিবর্তনের সারথী হয়ে কাজ করতে চান। সাধারণত, সিনেমায় তিনটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এমন একটা কাহিনী ও চিত্রনাট্য যা আমাদের সংষ্কৃতির সাথে যায়, যার মাঝে কোনো স্থূলতা নেই। দ্বিতীয়ত, কারিগরী নির্দেশনা, সম্পাদনা এবং তৃতীয়ত, কলাকূশলীদের অভিনয়দক্ষতা। অনন্তের সিনেমায় প্রথম দুইটি বিষয়ের অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে এটা খুব কম মানুষই অমত পোষণ করবেন।
যারা শুধু ব্যক্তিগত তিরষ্কার থেকে বেরিয়ে এসে দেখতে চাইবেন, তারা অবশ্যই চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে গত দুই দশকের চেয়ে বেশি আশাবাদী হবেন নিঃসন্দেহে। কোনো দেশের সিনেমাই শুধুমাত্র এক শ্রেণীর মানুষের জন্য তৈরী হয়না। আমাদের কেন হবে!! আমরা কেন বাংলা সিনেমাকে রিক্সাওয়ালার সিনেমা আখ্যা দিয়ে সেটাকে তিরষ্কার করে যাব? কেউ যদি সবধরণের মানুষকে সিনেমা হলে নিয়ে আসার প্রয়াস চালায় তবে কেন তার পথের সঙ্গী হব না? অনন্ত বিশাল ব্যবসায়ী, স্রেফ টাকা উপার্জনের জন্য তিনি সিনেমা বানাচ্ছেন না একথা পরিষ্কার। আবার শুধু শখের বশে সিনেমা বানালে সেরা পরিচালক দ্বারা কোটি-কোটি টাকা খরচ করে এমন সিরিয়াস কাহিনীর ছবিও বানাতেন না। জগাখিচুড়ি টাইপ কিছু বানিয়ে নিজেকে হিরো হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করতেন।
তা কিন্তু তিনি করছেন না। অনেকের কাছ থেকে অনেক অপমান হজম করেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এফডিসি কে একটা ভাল ছবির কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠত করতে।
কোনো বিষয়ের উপর ভাললাগা-আগ্রহ থাকলে সে ব্যাপারে খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করা যায়, একথা আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু ব্যাপারটার ক্ষেত্র যখন খুব বড় হয় তখন অনেক মানুষের ভাললাগা-ভালবাসা দরকার হয়। চলচ্চিত্র শিল্প দেশের সংস্কৃতি এবং দেশের মানুষের রুচির পরিচয় দেয়।
এম এ অনন্ত জলিল সিনেমার প্রতি ভাললাগা থেকেই চলচ্চিত্র জগতে এসেছেন। আমরা দেশের বর্তমান চলচ্চিত্র জগত পছন্দ করছি না। কিন্তু এর মানে কি এই যে, বাংলা সিনেমা কখনই মাথা তুলে দাড়াক এটা আমরা চাইছি না। সেটাও কিন্তু না। আমাদের অবস্থাটা এরকম যে আমরা দেখব কোনো কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে তবে সেটাকে বাচানোর জন্য এগোবো না, আর যে এগিয়ে যাবে তাকে উৎসাহ তো দিবই না বরং এমন সব ব্যাপার নিয়ে তাকে তিরষ্কার করব যাতে সে কোনোকালেই সফলতা না পায়।
আমাদের এখন উচিত কিভাবে অনন্তের কাছ থেকে সেরাটা বের করে নিয়ে এসে চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধশালী করা যায়। অনন্ত সিনেমা প্রযোজনার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করবেন না এটা আমরা সবাই জানি। যেটা বাংলাদেশে সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে একটা প্রধান প্রতিবন্ধকতা । যত ভালো গল্প-কাহিনীই হোক না কেনো, সেটাকে মনের মত করে চিত্রায়ন করতে একটা বর অংকের টাকার দরকার হয় সে ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না। এক-দেড় কোটি বাজেটের পঞ্চাশ শতাংশ যদি নায়ক-নায়িকাদেরই দিতে হয় তাহলে সিনেমা বানানো হবে কি দিয়ে!! সেখানে অনন্ত প্রচলিত বাজেটের আট-দশ গুন লগ্নী করছেন একেকটা সিনেমায়।
দক্ষ পরিচালকেরা এগিয়ে আসুন, গল্পকাররা দারুন সব গল্প ফাদুন, চলচ্চিত্র বোদ্ধারা সঠিক দিকনির্দেশনা দিন কিভাবে দেশের সিনেমাকে সত্যিকার অর্থেই একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। অনন্ত একটা উপলক্ষ হিসেবে এসেছেন, আমাদের উচিত সবাই মিলে একসাথে কাজ করা। সামনের বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি আসছে অনন্তের নতুন সিনেমা "নিঃস্বার্থ ভালবাসা"। বিগত চারটার থেকে এটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী ছায়াছবি। অনন্ত-বর্ষা জুটির পাশাপাশি এখানে আরও একজন অভিনেতা থাকছেন।
অনন্ত আরও ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি বছরে চারটা সিনেমা বানাবেন যার মধ্যে একটাতে তিনি অভিনয় করবেন বাকি তিনটা শুধু প্রযোজনা করবেন। নির্বাচকরা এমন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাছুন যারা অভিনয়টাকে ভালবেসে করবে। কেবল অর্থের লিপ্সাই মানুষকে সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দেয়, চিন্তা-চেতনাকে স্থূল করে তোলে। এম এ অনন্ত জলিল বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছেন। সেই সম্ভাবনাকে কাজে না লাগাতে পারাটা জাতি হিসেবে আমাদেরই ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়াবে।
আর আমরা তরুণ সমাজ এখন সবকিছুতেই মজা খুঁজি। কোনো বিষয়ের গভীরতা ভেবে দেখাকে আমরা পাগলামো এবং সময়ের অপচয় ভাবি। বেশিরভাগ তরুণই অনন্তের অভিনয়ের কমতি, কিছু অশুদ্ধু ইংরেজি উচ্চারণের খেলা দেখতেই হলে গিয়ে সিনেমাগুলো দেখছে। কারো মাথায় খেলছে না হলে আসার এই উদ্দেশ্যকে পরিবর্তন করা যায়। এম এ অনন্ত ভালবেসে চলচ্চিত্র জগতে এসেছেন, আমরা সচেতনতার সাথে তার ভুলগুলো ধরিয়ে দিলেই সিনেমার কাংক্ষিত পরিবর্তন সাধন সম্ভব।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, আমরা নিজেরাই নিজেদের খোঁচাই, ছোটঁ করি। নিজেরাই নিজেদের মারি। আমরা নিজেকে স্বপ্ন দেখতে বারণ করি, বাস্তবায়ন তো দূরের কথা। চলচ্চিত্রের খারাপ অবস্থা সবাই জানে, তবে কেউই এর অবস্থা উন্নতির জন্য এগিয়ে আসছেন না। আর যখন এম এ অনন্ত এগিয়ে আসলেন, তার চলার পথেও আমরা কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছি।
আমরা কি সত্যি দেশের পরিবর্তন চাই?? তাহলে তো সচেতন নাগরিকের মতো অনন্তকে তার ঘাটতিগুলো দেখিয়ে দিয়ে তাকে উৎসাহ দিতাম। চল তরুণরা, আমরা তো দেশকে ভালবাসি। আমরা আর নিজেদের ছোট করে রাখবো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।