মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন স্কুল থেকে ফিরে অনিক ওর ছোট্ট কুকুর ছানা লালুকে নিয়ে সময় কাটায। খেলতে গেলেও লালুকে সঙ্গে নিয়ে যায়। খেলা শেষে লালু অনিকের পেছন পেছন হেঁটে আসে। বাড়ির চারপাশে কখনো ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে অনিকের ছোট বোন নীলাও থাকে।
নীলার আগ্রহ কম থাকায় মায়ের সাথে থাকতে পছন্দ করে। বিকেলে মা রাতের খাবার রান্না করার জন্য প্রস্ত্ততি নেয়। ঘরের সামনের উঠানে কখনো বসে। নীলা নিজেই ঘর থেকে চেয়ার বের করে। মায়ের পাশে বসে নীলা।
পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে স্কুলের গল্প মাকে শোনায়। মা রায়হানা বেগমও ওর গল্প শোনার আগ্রহ দেখান। তাতে নীলা কথা বলে আনন্দ পায়। সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত চলে অনিকের বেড়ানো আর নীলার গল্প বলা।
অনিক গ্রামের স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
বাবা আফসার আহমেদ ব্যবসা করেন। ছোট বোন নীলা একই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। রোজই দুজন এক সঙ্গে স্কুলে যায়। মাস দুয়েক আগে অনিক বাবার কাছে বায়না ধরেছিল একটি কুকুর ছানা পুষবে। অনিকের কথা মতোই একটি সুন্দর কুকুর ছানা এনে দিলেন।
নাদুস নুদুস চেহারা এ বাচ্চাটির গায়ের রঙ লাল। তাই প্রথম দেখাতেই অনিক মনে মনে একটি নাম নির্ধারণ করে। নীলাকেও জানায় ওর নামটির কথা। শুনে নীলাও অনেক খুশি হয়। অনিকের দেয়া লালু নামেই সবাই ডাকতে শুরু করে।
প্রথম কুকুর ছানাটি ডাকে সাড়া না দিলেও এখন ঠিকই সাড়া দেয়। ডাকলে কাছে আসে। প্রতিবেশী কিছু ছেলে মেয়েরাও অনিকের লালুকে দেখতে আসে। লালু ওর ছোট্ট চোখ দিয়ে তাকায়। লালুর ভঙ্গিমায় দেখতে আসা ছেলেমেয়েরা অনেক আনন্দ পায়।
অনিক কাছে আসলেই ওর চারপাশে ঘোরাঘুরি করে। লেজ নাড়ায়। তখন কারো বুঝতে কষ্ট হয় না অনিক পোষ মানাতে পেরেছে। অনিকের শরীর ঘেষে দাঁড়াতে চেষ্টা করে লালু। অনিক ‘লালু’ বলে ডাকলে ওর কাছে আসে।
হাতের বিস্কুট দেয়। লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার দৃশ্য দেখে অন্যরাও আনন্দ পায়। দিন দিন লালু বড় হতে থাকে। শরীরও বৃদ্ধি পায়। এখন অনেক কিছুই খেতে দিতে হয়।
খাবার শেষে হাড্ডি কিংবা মাছের কাটাসহ সব ধরনের খাবারই পেয়ে তাকে। রোজ বিকেলে চলে অনিকের আলাদা পরিচর্যা। অনিক লেখাপড়ায় বেশ এগিয়ে। তাই ওর আবদারগুলো পূরণ করতে বাবা মা কেউই বিলম্ব করে না। অনিক এসব বোঝে।
তাই লেখাপড়ার সময় মন দিয়ে পড়ে। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ফিরে স্কুলের পড়া তৈরি করে। রাতের খাবারের পর একবার লালুর শোবার ঘরে উঁকি মারে। শোবার ঘর বলতে ওদের কাঁছারি ঘরের পাশে আলাদা বেড়া দিয়ে একটি ছোট্ট রুমের মতো তৈরি করে দিয়েছে। সেখানেই লালু থাকে।
দরজা না থাকায় কখনো অনিকের ঘরের সামনে আবার কখনো লালুর নির্দিষ্ট থাকার স্থানে থাকে। তবে বেশির ভাগই অনিকদের ঘরের মূল দরজার সামনে থাকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলে অনিক রাতে বাবাকে নিয়ে বের হয়। তখনও লালু ঘরের সামনে ঘুর ঘুর করে-লেজ নাড়িয়ে অনিককে কাছে আসে। অনিক বাবার কাছে জানতে চায়- ‘বাবা লালু ওর ঘরে ঘুমাতে পারে না?’ ‘কুকুরের কাজ তার প্রভুকে পাহারা দেয়া তাই ও ঘরের সামনের থাকতে চায়।
’ বাবার কথা অনিকের ভালো লাগে না। অনিক ভাবে- হয়তো লালু’র ঘরটি ওর পছন্দ হয়নি। বাবা অনিককে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে যান। অনিক ঘরের ভেতরে এসে অস্বস্তিতে ভুগে। জানালা খুলে বাইরে তাকায়।
কী অবাক ব্যাপার। জানালা খোলার শব্দ শুনে লালু জানালা বরাবর এসে দাঁড়িয়েছে। অনিকের দিকে লালুর দৃষ্টি। অনিক জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙে অনিকের।
হয়ত রাতে ঘুমাতে পারেনি তাই এখন ঘুমাচ্ছে-এসব ভেবে লালুর নির্দিষ্ট প্লেটে খাবার রেখে অনিক স্কুলে চলে যায়। অনিক স্কুলে গেলেও লালুর দেখাশোনা ওর মা-ই করেন। আর লালুও সব শিখে ফেলেছে। ক্ষুধা কিংবা পানির তৃষ্ণা পেলে রান্না ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। খাবার অথবা পানি দেয়ার পর আবার ঘরের চারপাশে হেঁটে বেড়ায়।
অনিকদের বাড়ির পথের শেষে এসেও কখনো বসে বিশ্রাম নেয়। অনিক স্কুল থেকে ফিরলে অনিকের পেছন পেছন আসে। এত দ্রুত লালুর অনিকের আনুগত্য পরিবারের সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। আর তাই লালুকে একটু বেশি আদর যত্ন করে। মাস পেরিয়ে যায়।
অনিক যখন বাড়িতে থাকে তখন লালু ওর পাশেই থাকে। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখনও লালু থাকে সজাগ। টিনের ঘরে গাছের শুকনা ডাল পড়ে শব্দ হয়। শব্দ শুনেই লালু ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে। কখনো কখনো অনিক এসব বুঝে মুচকি হাসে।
শুকনা ডালকে লালু চোর ভেবে ডাকে। মনিব অনিকের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার চেষ্টা করে এই ছোট্ট কুকুর ছানাটি। গ্রামের চোরের উপদ্রপ না থাকলেও লালু ওর নিজের মতো করে ঘর পাহারা দেয়। ঘরের পেছনে, কখনো বাঁশ বাগানের কাছে আবার কখনো পুকুর পাড়ে গিয়ে ঘেউ ঘেউ চিৎকার করে। ডাক শুনে বোঝার উপায় নেই কুকুরটি এখনো ছোট।
অনিক স্কুলে গিয়ে লালুর গল্প ওর বন্ধুদের শোনায়। যারা লালুকে দেখেনি তারা লালুকে দেখতে চায়। স্কুলে নেয়া যায় কিনা ভাবে অনিক। ঠিকই একদিন সকালে লালুকে নিয়ে অনিক স্কুলে যায়। স্কুলের মাঠের এক কোণে লালুকে বসায়।
ব্যাগে থাকা দুটি পাউরুটি ওর সামনে দেয়। একটু একটু করে কামড় দিয়ে খাচ্ছে লালু। অনিকের কাছের বন্ধুরা এ দৃশ্য দেখে আনন্দবোধ করে। লালুকে দেখে সবারই ভালো লাগে। এতোদিন শুধু লালুর আনুগত্যের কথা শুনেছে এবার চোখের সামনে দেখছে।
অনিক যা বলছে তা-ই করছে লালু। হাতের ইশারা দিয়ে দাঁড়াতে বলতেই লালু দাঁড়ালো। গ্রামের ভেতর আরো অনেক কুকুর দেখেছে লালুর মতো একটিও নেই-এমনটি বলল কেউ কেউ। অনিক ওর নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলেও লালুকে সাথে নিয়ে যায়। নানা বাড়ির দুষ্ট ছেলেরা লালুকে আদর না করে উল্টো ঢিল ছুঁড়ে।
অনিক ওদের সাথে ঝগড়া করে না। দু একদিন থেকেই বাড়িতে চলে আসে। অনিক রিকশায় আর পেছনে লালু। লালুর দৌঁড়ানোর দৃশ্য অনিকের ভালো লাগে না। লালুর পা কখনো থামে না।
বিরামহীনভাবে দৌঁড়াচ্ছে। বাড়িতে আসার পর লালুকে ভালো ভাবে খাবার দেয়। কয়েক মাসের ব্যবধানে লালু অনেক বড় হয়। বড় কুকুরের মতো ভাবভঙ্গি। প্রতিদিনের মতোই লালুকে রাতের খাবার খাইয়ে অনিক ঘুমাতে যায়।
পরের দিন শুক্রবার। স্কুল বন্ধ থাকায় সকালে একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুম থেকে উঠে লালুকে দেখতে না পেয়ে ওর মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে। ওর মা সকাল থেকেউ লালুকে দেখেনি বলে জানায়। অনিকের মনে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করে।
সপ্তাহ খানেক আগে গ্রামের দুষ্ট ছেলে সাগরের সাথে লালুকে ঢিল ছুঁড়লে কথাকাটাকাটির কথা মনে পড়ে। সাগর তখন লালুকে দেখে নেবে জানিয়েছিল। তাহলে কি সাগর লালুকে ধরে নিয়ে গেছে? নিজের কাছে প্রশ্ন করে অনিক ওদের বাঁশ বাগানের দিকে ছুটল। কাছে যেতেই দেখল লালু ঘুমিয়ে আছে। জিহবাটা বের করে আছে লালু।
একটু দূরেই একটি পাউরুটির অংশ পড়ে আছে। অনিকের বুঝতে কষ্ট হয় না লালুকে বিষাক্ত পাউরুটি খাওয়ানো হয়েছে। কান্নামাখা শব্দে অনিক কিছুক্ষণ লালুকে ডাকাডাকি করল। লালুর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে এবার চিতকার করেই কান্না শুরু করল অনিক।
[গল্পটি দৈনিক সিলেটের ডাক এ ০১/১১/২০১২ এ প্রকাশিত]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।