আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাভার ট্র্যাজেডী , উচ্চমহলের নির্লজ্জ বেহায়াপনা এবং অসহায় সাধারণ জনগণ

বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। কি লিখব বুঝতে পারছিনা, বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু আদৌ লেখা সম্ভব বলে মনে হচ্ছেনা। প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে মন। আজকে সকালে অফিসে আসার আগে তৈরী হওয়ার সময় টিভিতে সাভার ভয়াবহতার লাশের মিছিলের দৃশ্য দেখছিলাম। দৃশ্যগুলো দেখে চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারিনি।

আমার মত সাধারণ আমজনতা কিই বা আর করতে পারি সামান্য চোখের পানি ফেলা ছাড়া? কয়েক মাস আগেও যখন তাজরীন ফ্যাশন্সে আগুণ লাগল, তখনও আমরা এভাবেই সস্তা চোখের পানি ফেলেছিলাম, আর কিছু করতে পারিনি। অগুণতি মানুষের লাশের খবর আসছে, তার বিপরীতে আমাদের সম্পদ এই একমাত্র চোখের পানি। কিন্তু এত এত মানুষ মরছে, এইসব মানুষের মৃত্যুর পেছনে যারা দায়ী তারা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কাছে এই সস্তা চোখের পানির তো কোন মূল্য নেই, তারা কেন এই মৃত্যুর জন্য হাহাকার করবে? ৮বছর আগে স্পেকট্রাম ট্র্যাজেডীর পর গত বেশ কয়েক বছরে বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে অগ্নিকান্ড, ভবন ধ্বসসহ নানা কারণে অগুণতি মানুষের প্রাণহানী দেখেছি, এসমস্ত প্রাণহানীর পেছনে যে কোন প্রাকৃতিক কারণ দায়ী ছিলনা, মানবসৃষ্ট কারণেই যে এসমস্ত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেটা দিবালোকের মতই পরিষ্কার এবং সবাই তা স্বীকার করে। কিন্তু তারপরও কোন এক অদৃশ্য যাদুমন্ত্রবলে কোনবারই এই সমস্ত ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার তো দূরের কথা, তাদের টিকির নাগালও পাওয়া যায়নি। আসলে এটাকে অদৃশ্য যাদুমন্ত্র বলা যায় কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

কারণ দায়ী ব্যক্তিদের সবাই হয় সরকারের উচ্চ পদে আসীন কারো কোন না কোনভাবে সংশ্লিষ্ট, অথবা সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষ যাদের কাছ থেকে সরকার নিয়মিতভাবে নানান সুযোগ-সুবিধা(!) ভোগ করে থাকে। পাঁচ মাস আগে তাজরীন ভয়াবহতার পেছনে মূল হোতাকে যেমন ধরা হয়নি উপরোল্লিখিত কারণে, তেমনিভাবে ২৪শে এপ্রিলের সাভার ট্রাজেডীর পেছনে দায়ী মূল ব্যক্তি যুবলীগ নেতা রানাকেও সুস্থ শরীরে ও নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হল। গত এক যুগ ধরে এরকম যত দুর্ঘটনা (এগুলোকে দুর্ঘটনা বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, আমার মতে এগুলোর প্রত্যেকটিই হত্যাকান্ড) ঘটেছে, তার প্রতিটি ঘটনা ঘটার পরেই দায়ী মূল ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে চলে গেছে বা চলে যেতে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ উদাহরণ সাভার ট্র্যাজেডী। রানা প্লাজার মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ভবন ধ্বসের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল।

তার আশেপাশের নেতাকর্মীরা ভবন ধ্বস শুরু হওয়ামাত্রই তাকে তড়িঘড়ি করে ভবনের বাইরে বের করে নিয়ে যায় এবং সে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পালিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে তাকে একজন প্রশ্ন করেছিল, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” নরকের কীট ঐ কুলাঙ্গারের উত্তর ছিল “আমি ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে যাচ্ছি। ” এভাবে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে এই শুয়োরের বাচ্চাটা (দুঃখিত এখানে এই শব্দ দুটো উচ্চারণের কারণে, কিন্তু এই নরকের কীটের জন্য এর চেয়ে ভাল বিশেষন আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছেনা) পালিয়ে বাঁচল, আর তাকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উঠেপড়ে লাগল। সরকারের উচ্চপদস্থ কেউ বলছে দুর্ঘটনার আগের দিনই সবাইকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, যারা মারা গেছে তারা নাকি তাদের জিনিসপত্র নিতে এসে মারা গেছে। আবার কেউ বলছে বিরোধী দলের হরতালের সময় বিরোধী দলীয় কর্মীদের দ্বারা বিল্ডিঙ ঝাঁকুনী দেয়ার ফলে নাকি এমন ধ্বস নেমেছে!!! কি পরিমাণ আহাম্মক, নির্লজ্জ,বেহায়া হলে এমন উক্তি কেউ করতে পারে কেউ কি ভেবে দেখেছেন? ভবন ধ্বসের আগের দিন যেখানে ভবনে ফাটল দেখা গেল, ভবনে অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাঙক কর্তৃপক্ষ ফাটলের খবর পাওয়ামাত্রই সাথে সাথে ব্যাঙ্কটির ঐ শাখার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তাদের কর্মীদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারল, অথচ ভবনে অবস্থিত সকল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিকরা অসহায় শ্রমিকদেরকে জোরপূর্বক বাধ্য করল ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঢুকে কাজ করার, এদের কারো কি কোন দায় নেই? সরকারের উচ্চ পদে আসীন কারো কাছে এদের দায় চোখে পড়ছেনা? আপনাদের নির্লজ্জতা,বেহায়াপনার উদাহরণ দেশের মানুষ আগেও বহুবার পেয়েছে, আর কত নির্লজ্জতা আর বেহায়াপনার উদাহরণ আপনারা জাতির কাছে সৃষ্ট করতে চান- এই প্রশ্ন যদি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে করা হয় তাহলে কি খুব বেশী অন্যায় কিছু হবে? গতকালের বিরোধী দলের হরতাল প্রত্যাহারে অনেককে বিরোধী দলকে সাধুবাদ দিচ্ছে।

এইখানেও যে বড় একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে সেটা কয়জনের দৃষ্টিতে এসেছে আমার জানা নেই। সকালে ভবন ধ্বসের পর পরই যেখানে সারা দেশেই হরতাল প্রত্যাহার করা উচিৎ ছিল তৎক্ষণাৎ, সেখানে অযথা কালক্ষেপন করে প্রথমে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় হরতাল প্রত্যাহারের নাটক, আর হরতাল শেষ হওয়ার মাত্র ঘন্টা দুয়েক আগে সারা দেশে হরতাল প্রত্যাহারের ঘোষণার নাটক হল। বিরোধী দলের এই নাটক সচেতন জনগণ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে, সাধারণ জনগণ তো তাদের মত ঘাস খেয়ে থাকেনা। সাভারের এই ভয়াবহতায় সরকারী বাহিনী কতটা উদ্ধারকাজে তৎপর আছে সেটা তারাই ভাল বলতে পারবে। কিন্তু বেসরকারী বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উদ্ধারকর্মে বা আহতদের চিকিৎসাসেবায় সাহায্য করছেন, তারা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

অনেকের দৃষ্টিতেই নাস্তিক গণজাগরণ মঞ্চ সকাল থেকেই আহতদের রক্ত সরবরাহ করার জন্য উদ্দ্যেগ নিয়েছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে সকাল থেকে রক্তদানে আগ্রহী মানুষের লম্বা লাইন এটাই প্রমাণ করেছে গনজাগরণ মঞ্চের আবেদন সাধারণ জনগণের কাছে কোনভাবেই খাট হয়ে যায়নি বরং তারা এইযে দুর্গতদের সাহায্যার্থে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে, তাদের এই মনোভাব সাধারণ জনগণের কাছে গণজাগরণ মঞ্চের গ্রহণযোগ্যতা আরো পরিষ্কারভাবে বাড়িয়ে তুলবে। এতকিছুর পরেও নির্লজ্জ বেহায়া গোষ্ঠীরা গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক বলে গালি দিয়ে যাবে, তারপরও গণজাগরণ মঞ্চের এই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে এতটুকুও ভাটা পড়বেনা। আসলে এভাবে প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই বিস্তর সমালোচনা হয় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। অথচ কখনো তাদের আইনের আওতায় আনা তো দূরে থাক, তাদেরকে সসম্মানে সমাজে স্থান দেয়া হয়, আমরা এমনই হতভাগ্য এক জাতি।

বিদেশী সংবাদমাধ্যমে আমাদের এমন দূর্যোগের কথা সবসময় ফলাও করে প্রচার করা হয় যেমনটি সাভারের ভয়াবহতার কথা বিদেশী মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। জাতি হিসেবে এটি বড়ই দুর্ভাগ্য ও লজ্জার বিষয়। লেখার শুরুতে যেটা বলেছিলাম সেটা দিয়েই শেষ করি, এইসব হতভাগ্য মানুষের জন্য আমরা সাধারণ মানুষ শুধু চোখের পানিই ফেলতে পারব, আমাদের ক্ষমতা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ। এই নির্মম হত্যাকান্ডের পেছনে যতদিন উচ্চমহলের পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে, ততদিন আমাদের এই চোখের পানি আর হাহাকারই একমাত্র অবলম্বন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।