আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিনেমা দেখা, দেখানোর টুকরো স্মৃতি

একদিন সত্যি সত্যি বাবা-মা'র অনুমতি মিলে গেল, প্রথম সিনেমা দেখতে যাবার। আমার বড়কাকার ছেলে ও আমাকে নিয়ে নিয়ে আমার ছোটকাকা চললেন ঝিনেদার 'ছবিঘর' সিনেমা হলে। উদ্দেশ্য, 'ছুটির ঘন্টা' দেখা। অবশ্য ছোটকাকাই বাড়িতে 'চিত্রালী' 'পূর্বাণী' আনতেন, দেখাতেন, 'এই দ্যাখ রাজ্জাক, এটা শাবানা, এটা কবরী, ওইটা ববিতা...' ইত্যাদি। ক্লাস ফোরে পড়ি।

প্রথম সিনেমা দেখতে যাচ্ছি মানে এক অজানা বিস্ময় আবিষ্কারে যাচ্ছি। হলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, 'ছুটির ঘণ্টা' আগের দিনই নামিয়ে দিয়েছে, এখন চলছে 'আপন ভাই'। ছুটির ঘণ্টা দেখা হচ্ছে না বুঝে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। 'আপন ভাই'ই দেখানোর জন্য ছোটকাকা তিনটা টিকিট কিনলেন হলের দেয়ালের ফুটো দিয়ে হাত ঢুকিয়ে। টিকিট কাটামাত্রই আমি আমার টিকিট হাতে নিতে চাইলাম।

বললাম, 'কাকা, আমার টিকিটটা দাও'। কাকা তখন টিকিট কাটার পর ভাংতি টাকার হিসাব মেলাচ্ছিলেন, আমি তার মধ্যেই আবার বললাম, 'ছোটকাকা, আমার টিকিট আমার হাতে দাও' শুনেই ছোটকাকার রাগ হয়ে গেল, তিনি সেই রাগ সামাল দিতে পারলেন না, ঠাস করে আমার মুখে একটা চড় কষলেন। আমি হতভম্ব হয়ে, চোখের পানি চোখে আটকিয়ে কাকার পেছনে পেছনে হেঁটে গিয়ে হলের ভেতরে ঢুকলাম। 'আপন ভাই' দেখার সময় আমি প্রথম সিনেমা দেখার আগমুহূর্তে চড় খাওয়ার স্মৃতি ভুলে থাকতে চাচ্ছিলাম। পরের বছর ফাইভে উঠলাম।

শুনলাম, 'দেবদাস' এসেছে শৈলকুপার 'কিছুক্ষণ' সিনেমা হলে। মা-কাকিদের আলোচনা শুনছিলাম দেবদাস নিয়ে। একদিন আমিও আগ্রহ দেখালাম, বললাম, আমিও দেবদাস দেখতে যাব। আমার কথা শুনে সম্ভবত ছোটকাকি বা কেউ একজন আমাকে প্রশ্ন করলেন, বললেন, 'কি দেখতে যাবি? বললাম, 'দেবদাস' 'সহ্য করতে পারবি?' ফাইভে পড়া স্টুডেন্ট আমি। বুঝতে পাললাম না, দেবদাস দেখতে কী সহ্য করতে হবে! এরপর যথারীতি 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' 'স্কুল থেকে সটকে' প্রচুর সিনেমা দেখেছি।

সিনেমা দেখতে গিয়ে, সে-সময় আমি খুব ঈর্ষা করতাম হলের গেইটম্যানকে। কারণ, টিকিট কাটার পয়সা বেশিরভাগ সময়ই পর্যাপ্ত থাকত না। দেখতাম, গেইটম্যানরা গেইটে দাঁড়িয়ে টিকিট দেখে লোক ঢুকিয়ে একটুখানি পর নিজেরাও হলের মধ্যে ঢুকে পড়ত, সিনেমা দেখত। সব সিনেমাই তারা বারবার দেখত এবং মাস শেষে নাকি বেতনও পেত। এসব দেখে, মনে মনে ভাবতাম, আমি যদি সিনেমা হলের গেইটম্যান হতে পারতাম!!! পরে, অনেক পরে, যখন চারুকলায় পড়ি, ইউনিভার্সিটি হলে থাকতাম।

চিত্রকলায় পড়ালেখার ব্যাপারটা একটা নেশার মতো ছিল। চারুকলা জায়গাডাও ঢাকা ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে নন্দন ভুবন, এও সত্য। কাইয়ূম চৌধুরী, রফিকুন নবী, হাসেম খান, সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মাহমুদুল হক, জামাল আহমেদসহ দেশের প্রধান শিল্পীদের পাই খুব কাছে থেকেই। তখনকার ব্রিটিশ কাউন্সিল, গ্যথে ইনস্টিটিউট, অলিয়ঁস ফ্রাঁসেঁসে নিয়মিত ছবি দেখতে যেতাম। অটিল-বটিল-জটিল এসব ছবি।

গদার, হিচকক, আইজেনস্টাইন, তারকাভোস্কি, বুনুয়েল, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, কুরোসাওয়া...সেসব অন্য দুনিয়ার মানুষ, এদের ছবিও অন্য চিন্তার ছবি। সেসময়, '১৯৭১ এ লেয়ার লেভিনের ক্যামেরায় তোলা সেই অসামান্য ফুটেজ অবলম্বনে তারেক মাসুদ-ক্যাথরিন ১৯৯৫ তে 'মুক্তির গান' ক্রিয়েট করে জাদুঘরে প্রিমিয়ার শো করলেন। অনুষ্ঠানে সেদিন আমেরিকান লেয়ার লেভিন উপস্থিত না থাকলেও লেভিনের ভিডিওগ্রাফিক শুভেচ্ছা স্ক্রিনিঙ আমরা দেখেছিলাম। তারপর, পাবলিক লাইব্রেরি অডিটোরিয়ামে 'মুক্তির গান' প্রদর্শনী চলে টানা আড়াইমাস। দুপুরের পর থেকে প্রতিদিন ৩ টা করে শো।

তারেক ভাইয়ের এক ভাইয়ের নাম বাবু, বাবু আমাদের বন্ধু। বাবু আমাদের হলে এসে রাতে আড্ডায় শরিক হতো। নিজের আগ্রহ ও কিছুটা বাবুর কারণেও, পাবলিক লাইব্রেরিতে 'মুক্তির গান'এর শো চলাকালীন অডিটোরিয়ামের গেইটম্যান হয়ে গেলাম ভলান্টিয়ারি আনন্দে। এরপর আড়াই মাসের প্রায় প্রতিটা শো আমি দেখেছি। ছেটাবেলার মতো, গেইটে দাঁড়িয়ে দর্শকদের টিকিট দেখে, টিকিট ছিঁড়ে ফেরৎ দিয়ে দিতাম।

পাবলিক লাইব্রেরিতে আর কোনো ছবি দেখতে এত মানুষ হয়নি কখনো। তারেক মাসুদ মাঝেমধ্যে এসে, দুএকটা কথাবার্তা বলেই হয়তো প্রেস মিট করতে ব্যস্ত হতেন কিংবা গেস্ট সামলাতেন। একদিন, যথারীতি মুক্তির গান এর শো শুরু হয়ে গেছে। আমরা কজন ভলান্টিয়ার গেইটম্যান গেইটে দাঁড়ানো। হয়তো ভেতরে ঢুকব।

হঠাৎ তারেক ভাই কোত্থেকে দৌড়ে এসে বললেন, 'শোনো, তোমরা ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকো, এক্ষুণি একজন দর্শক আসবেন, ওই যে তাঁর গাড়ি। ' তখনকার (১৯৯৫) জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী 'মুক্তির গান' দেখতে যখন দর্শক হিসেবে ঢুকছেন, আমরা কয়জন তখন সেই হলের গেইটম্যান। মনে থাকার মতো একটা সামান্য ঘটনা। শেখ হাসিনাকে তারেক ভাই অডিয়েন্সের ভেতরে কোথাও বসিয়ে দিলেন। অডিয়েন্স স্বাভাবিকভাবেই কিছু জানত না যে, তাদের সঙ্গে বসেই 'মুক্তির গান' দেখছেন এই রাজনৈতিক নেত্রী।

প্রদর্শনী শেষে তারেক ভাই স্ক্রিন-স্টেজে উঠে সবাইকে জানিয়ে, অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করে ডাকলেন, তখন শেখ হাসিনা দর্শকের ভেতর থেকে স্টেজে উঠে এলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল 'মুক্তির গান' দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, আমরা দেখলাম। সেই মুহূর্তে, শরণার্থী শিবিরের দলিল দেখার প্রতিক্রিয়ায় তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলেন... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.