ঢাবি জাবি ও জবির নিয়োগ পদোন্নতিতে ব্যাপক দলবাজি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) দেশের বৃহত্তম তিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ব্যাপক 'দলবাজি'র অভিযোগ উঠেছে। দলবাজি জায়েজ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আশ্রয় নিতে হয়েছে চরম অনিয়মের। অপর দুই বিশ্ববিদ্যালয় হলো জাহাঙ্গীরনগর (জাবি) ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। জানা যায়, মহাজোট সরকারের পৌনে চার বছরে দলীয় বিবেচনায় রেকর্ডহারে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নতুন বিভাগ ও ইন্সটিটিউট খুলে শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা নয় কেবলই দলীয় সমর্থক ও কর্মী বিবেচনায় শিক্ষকদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদিকে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়মে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে খোদ তদারক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। তাদের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট বহির্ভূত জনবল নিয়োগ করছে। পদোন্নতি বা আপগ্রেডেশনের জন্য ইউজিসি প্রণীত নীতিমালা অনুসরণ না করেই পদ সৃষ্টি, পদোন্নতি বা আপগ্রেডেশন ও সিলেকশন গ্রেড প্রদান করছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মহাজোট সরকারের পৌনে চার বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫টি বিভাগ ও ইন্সটিটিউটে আড়াই'শ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সময়ে চালু করা হয়েছে নতুন আটটি বিভাগ ও একটি ইন্সটিটিউট। আর নতুন ও পুরাতন বিভাগগুলোতে ১৯৩ জন শিক্ষক ও প্রায় দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়ম বহির্ভূত ও দলীয় বিবেচনায় জনবল নিয়োগ নিয়ে অস্থির হয়ে উঠে এ বিশ্ববিদ্যালয়। অবৈধ নিয়োগ নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির তার পদ ছাড়তে বাধ্য হন। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরো এক ধাপ এগিয়ে রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে দলীয় বিবেচনাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এখানে বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগকৃত ২৩২ জন শিক্ষক নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছে দলীয় বিবেচনা। এছাড়া স্বজনপ্রীতি, মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ ও সরকারের নীতি-নির্ধারকদের খবরদারি তো রয়েছেই। এ কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলনামূলক অযোগ্য ও কম মেধাবীরা নিয়োগ পেয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান হওয়া এমন অনেক প্রার্থী।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 'দলবাজি'র ভিত্তিতে পদোন্নতির নীতি অনুসরণ করে নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন বছরে ৬৮ জন শিক্ষককে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে 'প্রভাষক-সহকারী অধ্যাপক-সহযোগী অধ্যাপক-অধ্যাপক' এই কাঠামোতে শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রক্রিয়া চলে। পদোন্নতির প্রতিটি ধাপে ইউজিসির পদোন্নতি ও বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, শিক্ষক পদোন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা ছাড়াও দেশি-বিদেশি জার্নালে গবেষণা প্রকাশনা এবং উচ্চতর ডিগ্রি থাকার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এর কোনোটিই মানা হয়নি।
এখানে প্রধানতম যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়েছে 'আওয়ামী লীগ সমর্থক' হওয়াকে। পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকরা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী শিক্ষক সমর্থক সংগঠন 'নীল দলে'র হয়ে কাজ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে বর্তমানে নীল দলের শিক্ষক হিসেবে পরিচিতদের অধিকাংশই ছাত্রজীবনে ছাত্রদল কিংবা ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করতেন। এছাড়া অনেকেই সাবেক কর্মস্থলে বিএনপি ও জামায়েত শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ডিগবাজি দিয়ে রাতারাতি তারা আওয়ামী সমর্থক প্যানেলে গিয়ে পুরস্কার হিসেবে কেউ কেউ এ আমলে দুইবারও পদোন্নতি পেয়েছেন।
এ ধরনের পদোন্নতি নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বাকবিত-ার ঘটনা ঘটেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির। দায়িত্ব পালনকালে তিনি গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আটটি বিভাগ ও একটি ইন্সটিটিউট চালু করেন। এসব নতুন ও পুরাতন বিভাগগুলোতে গণ নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। ১৯৩ জন শিক্ষক ও প্রায় দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়।
বিভিন্ন বিভাগে অতিরিক্ত ও দলীয় বিবেচনায় জনবল নিয়োগ নিয়ে এক পর্যায়ে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির পদ ছাড়তে বাধ্য হন। বর্তমান উপাচার্যের কাছে গণ নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি ছিল আন্দোলনরত শিক্ষকদের। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন চালু করা বিভাগগুলো হচ্ছে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, আইন ও বিচার, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স। এছাড়া ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি নামে নতুন একটি ইন্সটিটিউট চালু করে জাবি কর্তৃপক্ষ।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে কমিশনের নীতিমালা মানা হয়নি। নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে কমিশনের পূর্বানুমতি ও পদ সৃষ্টির জন্য আবেদন করতে হয়। বিভিন্ন ধাপে পরে বিভাগ খোলা ও নতুন পদ সৃষ্টির অনুমতি মেলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ফার্মেসি বিভাগে আটজন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পাঁচ জন, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ছয় জন, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে আট জন, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চার জন, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে সাত জন, পাবলিক হেলথ বিভাগে তিন জন, গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদভুক্ত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে পাঁচ জন, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ৬ জন, রসায়ন বিভাগে ১১ জন, গণিত বিভাগে ৬ জন, ভূতাত্তি্বক বিজ্ঞান বিভাগে ৭ জন, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৩ জন, পরিসংখ্যান বিভাগে ৪ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত অর্থনীতি বিভাগে ৩ জন, সরকার ও রাজনীতি বিভাগে ২ জন, নৃবিজ্ঞান বিভাগে ৪ জন, লোকপ্রশাসন বিভাগে ৮ জন, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে ১০ জন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ৯ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
কলা ও মানবিকী অনুষদভুক্ত বাংলা বিভাগে ৮ জন, ইংরেজি বিভাগে ৮ জন, ইতিহাস বিভাগে ৯ জন, দর্শন বিভাগে ৫ জন, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ২ জন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ৪ জন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ৯ জন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ৪ জন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিজনেস স্টাডিজ অনুষদভুক্ত ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে ৬ জন, মার্কেটিং বিভাগে ৪ জন, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে ৪ জন, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ৫ জন, আইন অনুষদভুক্ত আইন ও বিচার বিভাগে ৪ জন, আইবিএ ইন্সটিটিউটে ৩ জন, ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজিতে ৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গত চার বছরের বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত নিয়োগ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে সিলেকশন বোর্ড, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যরা। দেয়া হয়েছে 'নোট অব ডিসেন্ট' (আপত্তিনামা)। শিক্ষাজীবনের চারটিতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেও বঞ্চিত প্রার্থীরা প্রতিকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বরবার অভিযোগও জানিয়েছেন।
প্রশাসনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করার ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের আটটি বিভাগে ৩৫ প্রভাষক ও ২ জন সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়। অনার্সে সিজিপিএ ৪ এর মধ্যে ৪ এবং মাস্টার্সে ৩.৯৬ পয়েন্ট লাভ করে বিভাগীয় শিক্ষার্থী ইশতার মহল অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পাননি। অস্বাভাবিকভাবে বঞ্চিত ওই প্রার্থী বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্রপতি বরবার অভিযোগ করেন।
ওই ছাত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে উপসচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হোসনে আরা বেগম স্বাক্ষরিত পত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে মতামত প্রদানে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে পাঠানো ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনুষদের মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে নিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন, বিশেষ জেলায় বাড়ি, ছাত্রলীগ নেতা, স্পিকারের ভাগ্নে যোগ্যতায় নিয়োগপ্রাপ্তদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে। এখানে বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে ১৬ প্রভাষক ও একজন সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অনুষদের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে স্বপন কুমার ঘোষ নামের একজনকে সরাসরি সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৪ জনের মধ্যে ২ জনকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিজ্ঞাপন দেয়া পদের বাইরে। গণিত বিভাগে এক যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে ৩ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম মুহিবুজ্জামানকে বঞ্চিত করে সোহানা জাহানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে এ সময় অভিযোগ ওঠে। অনুষদের অন্যান্য নিয়োগের মধ্যে গণিত বিভাগে ৩ জন, পরিসংখ্যানে ৫ জনম, তাত্তি্বক পদার্থে ২ জন, বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ১ জন এবং রসায়নে ১ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়।
মেধার মূল্যায়ন না করে দলীয় বিবেচনায় এসব নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাবির বর্তমান প্রশাসনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চরম দলীয়করণ ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সাত বিভাগে নিয়োগ পাওয়া ১৭ প্রভাষকের ১৫ জনই তুলনামূলক কম যোগ্য বলে অভিযোগ ওঠেছে। সূত্র জানায়, ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে ৩৩ নাম্বারের প্রার্থী দুলাল চন্দ্র গাইনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দুলাল চন্দ্র গাইনের শিক্ষাজীবনের তিনটিতে দ্বিতীয় শ্রেণী।
শুধু মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী রয়েছে। তবে তার বিশেষ যোগ্যতা হচ্ছে তিনি ১৯৯৭-৯৯ সালে অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে ২ জন প্রভাষক পদে আবেদন করেছিলেন ১০ জন। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নেয়া হয়েছে তালিকায় তৃতীয় ও চতুর্থ নাম্বারে থাকা নাসিমুল কবির এবং নাসিমা হক মিতুকে। যাদের এসএসসি ও এইচসিতে দ্বিতীয় শ্রেণী এবং পাস কোর্সে ডিগ্রি এবং প্রিলিমিনারি মাস্টার্স পাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস কোর্সে পাস করা প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নজিরবিহীন ঘটনা। ওই নিয়োগের চ্যালেঞ্জ করে তিনটিতে প্রথম শ্রেণী ও জাতীয় পর্যায়ে পদক পাওয়া প্রার্থী মাহমদুল হাসান হাইকোর্টে রিট করেন। ২৯ জুলাই সিন্ডেকেটের চার সদস্য আপত্তিপত্র জমা দিলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একইভাবে প্রিন্ট মেকিং বিভাগে তিনটি দ্বিতীয় শ্রেণী পাওয়া প্রার্থী নাজির হোসেন খানকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া ওই প্রার্থী অনুষদের শাখা (চারুকলা) ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।
গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সীমা ইসলামকে। ড্রয়িং আ্যন্ড প্রিন্টিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগে এক প্রার্থীকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বঞ্চিত করে অন্য এক প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়। ওই নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগপ্রার্থী হোসাইন মোহাম্মদ ফারুক হাইকোর্টে রিট করেছেন। বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদে বিগত তিন বছরে অনুষদের তিন বিভাগে মোট ১৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ছয় বিভাগে ২১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনুষদের নৃবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট সভায় ৫ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। এ বিভাগে নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন সিলেকশন কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য ও শিক্ষকরা। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে খাতির থাকায় তিনি এ নিয়োগ পান বলে জানা যায়। লোক প্রশাসন বিভাগে নুসরাত জাহান চৌধুরীকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রেও অন্য যোগ্য প্রার্থীরা বাদ পড়েছেন। সিলেকশন বোর্ডে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ কা ফিরোজ আহমেদ এবং ও বোর্ড সদস্যরা ওই নিয়োগের বিরোধিতা করে সিলেকশন কমিটির উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর না করে সভা ত্যাগ করেন। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই সিন্ডিকেটে ওই নিয়োগের বিরোধিতা করে চারজন সিন্ডিকেট সদস্য 'নোট অব ডিসেন্ট' দেয়ার পরও তাদের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। একই বছরের ২৫ অক্টোবর সিন্ডিকেটে উন্নয়ন ও অধ্যয়ন বিভাগে প্রভাষক পদে শুভাশিষ বাড়ৈ ও শেখ জাফর ইমরানের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। আবেদনকারীদের মধ্যে তিনজন যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও অর্থনীতি বিভাগে ৬ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আতিউর রহমানের মেয়ে অর্চি মধুবীমা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেলেও শেষ পর্যন্ত যোগদান করেননি। এছাড়াও এ অনুষদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চারজন, উইমেন জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগে তিনজনকে তুলনামূলক কম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়াও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে দেবাশীষ কুন্ড ও বিপণ কুমার সরকারকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। তিন বছরে কলা অনুষদের ১৩ বিভাগে ৩৮ প্রভাষক ৩ সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আত্মীয়তার সম্পর্কে ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই সিন্ডিকেটে পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজে জগন্নাথ বড়ুয়াকে বঞ্চিত করে নীরু বড়ুয়াকে নেয়া হয়েছে। নীরু বড়ুয়া ওই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিমান চন্দ্র বড়ুয়ার স্ত্রী। যার অনার্সে মাত্র ৪৬ শতাংশ নাম্বার রয়েছে। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং ইতিহাস বিভাগে বঞ্চিত করা হয়েছে মেধাবীদের। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক নীল দলের শিক্ষক মেসবাহ কামালের কন্যা মুনাসির কামালকে প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়।
ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে একজন করে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া অনুষদের বাংলা বিভাগে মেধাবীদের বঞ্চিত করে ৪ জন, দর্শন বিভাগে ৫ জন এবং একজন সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ২, নাট্যকলায় ৪, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি ১ এবং সঙ্গীত বিভাগে ২ জনকে মেধা ও দলীয় উভয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফার্মেসি অনুষদের দুটি বিভাগে আটজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগে দুইজনকে বঞ্চিত করে ৫ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়।
ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে ৩ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। সামাজিক অনুষদভুক্ত উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের প্রভাষক পদে মো. আমজাদ ও ফারজানা নামে দুই নিয়োগপ্রার্থী যথাক্রমে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় এবং অনার্সে তৃতীয় ও মাস্টার্সে প্রথম স্থানধারী হওয়া সত্ত্বেও কম যোগ্যতাসম্পন্ন দুই প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়। সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটে ৩ প্রভাষক এবং একজন সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম মুস্তাজিুর রহমানসহ কয়েকজন যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে প্রভাষক পদে মইনউদ্দিন মোল্লা, অনুরাধা বর্ধন ও আশরাফুল ইসলাম এবং সহকারী অধ্যাপক পদে সাহানা নাসরীনকে নেয়া হয়। আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদে ভূতত্ত্ব বিভাগে এক যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে হল শাখার ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ ৩ জন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়।
জীববিজ্ঞান অনুষদের ৬টি বিভাগে মোট ১৬ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে অনুষদের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে চতুর্থ এবং মাস্টার্সে প্রথম স্থান অধিকারী প্রার্থীকে বঞ্চিত করে নেয়া হয়েছে অনার্সে ১৭তম ও মাস্টার্সে চতুর্থতম সনিয়া তামান্নাকে। এছাড়াও মৎস্য বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অণুজীব বিজ্ঞান, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জিন প্রকৌশল ও জীব-প্রযুক্তি বিভাগে প্রভাষক পদে কয়েকজনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি মেধার অনুসরণ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে ১১ জন দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছে। গোপালগঞ্জ এলাকার বলে নিজেকে পরিচয় দেয়া মোহাম্মদ আশরাফ সাদেক, কুমিল্লার একটি কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার হায়দার, প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের আত্মীয় পরিচয় সুমেরা আহসান, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে ইন্সটিটিউট থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা মাহাবুব রহমান পুরোপুরি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন।
এছাড়াও নিয়োগ বিজ্ঞাপ্তি বহির্ভূতভাবে একটি পদের জায়গায় শারমিন কবীর, তামান্না সুলতানা নামে ২ প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে ওই ইন্সটিটিউটে। এছাড়া ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটে ৪, তথ্য ও প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটে ২ জন প্রভাষকসহ বিভিন্ন বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় অত্তীভুক্ত ইন্সটিটিউটের নিয়োগে মেধার সঙ্গে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে দলীয়করণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলাদলি থাকবে, মেধাও থাকবে। কিন্তু এখানে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্বয় সাধন করা হয়।
অধ্যাপক নাসরীন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতির বিষয়টি বন্ধ ছিল। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর থেকে বিষয়টি আবার সচল হয়েছে। ইতোমধ্যেই বিষয় দুটি প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। আগামীতে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রেখেই শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বলে তিনি জানান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বিদেশে অবস্থান করায় তার মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
তবে এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক জানান, নিয়োগসংক্রান্ত তদন্ত এবং বিচার সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদকে তার মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি 'এসব নিয়ম-কানুন বসে দেখাতে হবে বলে জানান। পরে ফোনে এতসব কথা হয় না' বলে লাইন কেটে দেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত করে দেখা যেতে পারে। তবে তিনি শিক্ষকদের নিয়োগ কিংবা পদোন্নতি বোর্ডে থাকেন না বলে জানান।
সূত্র: দৈনিক যায়যায়দিন Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।