কেউ যদি আবু বকরকে আগে বলতেন যে একদিন তিনি মুসলিম হবেন, তার প্রতিক্রিয়া হয়ত হত "না!! কক্ষনো নয়!!!"। কারণ অনেক অস্ট্রেলিয়ানদের মত মুসলিমদের তিনি 'টেরোরিস্ট' ভাবতেন। কিন্তু
আল্লাহর অশেষ দয়া আর করুণায় আবু বকর হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি এখন আমাদের দ্বীনি ভাই।
মেলবোর্নে এক অনুষ্ঠানে নিজের আত্মিক যাত্রার বর্ণনা করেন সদাহাস্য আবু বকর যার পূর্বের নাম ছিল র
ুবেন।
কৌতুক আর রসিকতা মিশ্রিত তার প্রাণবন্ত বাচনভঙ্গি শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ করে দেয়।
কিভাবে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল বলতে গিয়ে আবু বকর চলে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে, "সেবছর আমার জীবনের অনেকগুলো বাজে ঘটনা ঘটেছিল। সেবছর আমার বাবা মা আলাদা হয়ে গেলেন। (মুচকি হেসে) আমার কুকুর মারা গেল। অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিল।
সুবহান আল্লাহ, এক সপ্তাহে আমি দুবার কার এক্সিডেন্ট করেছিলাম। "
"আর দু:খজনকভাবে সেবছর আমার এক বন্ধু মারা যায়। যেটা আমাকে জীবন নিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখিন করেছে। আমি নিজেকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকলাম জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। "
নাস্তিক পরিবারের সন্তান রুবেন ছোটকাল থেকে বাবা মা থেকে শুনে আসছিলেন ঈশ্বর আর পরকাল বলে কিছু নেই।
কিন্তু অন্তরের গভীরে গাঁথা আল্লাহর অস্তিত্বের জ্ঞান আর পরকালের বিশ্বাসকে মারতে সেটা যথেষ্ট ছিলনা। বন্ধুর মৃত্যুর পর তার ভেতরের কন্ঠটি বলে উঠে, নিশ্চয়ই মানুষ মৃত্যুর পর কেবল পোকামাকড়ের খাবার নয়, নিশ্চয়ই মৃত্যুর পরে আরো বেশি কিছু আছে। এসব চিন্তা তাকে আল্লাহ এবং আল্লাহর ধর্ম অনুসন্ধানের দীর্ঘ পথে পরিচালিত করল।
একজন অসি হিসেবে স্বাভাবিক ভাবে প্রথমে আবু বকর প্রথম খৃষ্টধর্ম নিয়ে অনুসন্ধান চালান, যোগ দেন একটা চার্চ ক্যাম্পে। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, "সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত চার্চ ক্যাম্প।
সবাই শুধু গান গাচ্ছিল। সবাই আমাকে বলছিল, 'খোদা তোমাকে কতইনা ভালবাসে'। (মুচকি হাসি) আর আমি ভাবলাম 'খোদা আমাকে ভালবাসে? আমার কুকুর মারা গেছে!!'"
কিন্তু খৃষ্টধর্ম তার আত্মিক জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব দিতে পারেনি। আবু বকরের ভাষায়, "আমি আবিষ্কার করলাম, যখনই আমি কোন প্রশ্ন করতাম তারা বাইবেল হাতে নিয়ে বলতনা যে 'ভাই, এই নাও তোমার প্রশ্নের উত্তর'; তারা তাদের নিজস্ব মতামত থেকে উত্তর দিত। আমি আরো বুঝতে পারলাম খৃষ্টধর্মের বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা আছে, যেটা চার্চ থেকে চার্চে আলাদা হয়।
আমি মনে মনে ভাবলাম, 'বাইবেল একটা বই , কিন্তু ব্যাখ্যা অনেক প্রকার, যেটা ছিল বিভ্রান্তিকর। '"
আবু বকর তার এক হিন্দু সহকর্মির সাথে 'গভীর' ধর্মতাত্বিক তর্কের কাহিনী বললেন, "আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, (মুচকি হেসে) 'ভাই, তোমাদের হাতির মাথাঅলা দেবতার কাহিনী কি? কেন তার হাতির মাথা? অন্য ভাল কিছু পেলেনা যেমন সিংহের মাথা?'" তবে হিন্দু ধর্ম তার ভাষায় 'হজম করা কষ্টকর'।
আবু বকর তার সত্য ধর্ম অনুসন্ধানের পথে মার্মন ধর্ম আর ইহুদি ধর্মও ঘেটে দেখলেন। কিন্তু কোনটাই তাকে টানতে পারেনি। শেষে তিনি ঘেঁটে দেখলেন বৌদ্ধ ধর্ম।
তিনি ভেবেছিলেন তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করবেন। বৌদ্ধ ধর্মের বিবিধ ব্যাপার গুলো তাকে আকর্ষন করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত বৌদ্ধধর্মও তাকে শান্তি দিতে পারেনি। তার ভাষায়, "আমি যতই গভীরে গেলাম বুঝতে পারলাম যে এটা আসলে আল্লাহর ধর্ম নয় বরং এটা কেবল জীবন ধারনের সুন্দর উপায়। "
তারপর একদিন এক খৃষ্টান বন্ধু তাকে ইসলাম নিয়ে ঘেঁটে দেখার পরামর্শ দেয়।
আবু বকরের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, "'ইসলাম?!!!' তারাতো সব টেরোরিস্ট! আমি এই ধর্ম নিয়ে ঘাটতে যাচ্ছিনা। "
কিন্তু একদিন তিনি নিজেকে এক মসজিদে আবিষ্কার করলেন। তার মজার বর্ণনায়, "(মুচকি হেসে) আমি জুতা পায়ে সালাতের সারি ধরে হেটে গেলাম। এক ভাইকে প্রায় ফেলে দিয়েছিলাম, আরেক ভাই সেজদায় ছিল তার মাথা প্রায় মাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সুবহান আল্লাহ, আমার কোন ধারনাই ছিলনা আমি কি করছিলাম।
(মুচকি হেসে) আমি দেখলাম ভয়ংকরদর্শন বড় বড় দাড়ি ওয়ালা এক লোক আমার দিকে হেটে আসছে। আমি ভাবলাম, ( মুচকি হেসে ) আমি বুঝি মারা যাব। এটা আমার জীবনের শেষ দিন। "
"সুবহান আল্লাহ, প্রথম যে কথাটা সে উচ্চারণ করল সেটা ছিল 'গুডডে মেইট। কোথায় যাচ্ছ?' আমি তার এমন স্বাগত করার ভংগিতে মুগ্ধ হলাম।
"
সেটা ছিল শুরু। আবু বকর নিয়মিত মসজিদে যেতে লাগলেন ইসলাম ধর্ম নিয়ে জানতে। সেখানে মুসলিমদের ব্যাবহার তাকে মুগ্ধ করল। মুসলিম ভাইয়েরা বার বার তাকে চা বিস্কিট সেধে সেধে খাওয়াত। এরকম মেহমানদারি আবু বকর কখনো দেখেননি।
তিনি যখনই ভাইদের সাথে বসতেন তার সব রকম প্রশ্ন করতেন যেগুলো তিনি প্রিস্টদেরকে প্যাস্টরদেরকে তার বন্ধুদেরকে জিজ্ঞাস করেছিলেন। প্রশ্নের জবাব দেয়ার ভংগিও তাকে মুগ্ধ করল। আবু বকর বলেন, "সুবহান আল্লাহ যে ব্যাপারটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল সেটা হচ্ছে, তারা শুধু আমার প্রশ্নের উত্তরই দিতেন না তার কুরআন বের করে বলতেন নাও ভাই এটা পড়ে দেখ। প্রত্যেক ক্ষেত্রে সেটাই হত আমার প্রশ্নের উত্তর। "
তিনি কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করছিলেন পর্দা প্রথা নিয়ে, চার বিয়ে নিয়ে আরো অন্যান্য বিষয় নিয়ে।
আর মুসলিম ভাইয়েরা উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের নিজস্ব মতামত থেকে নয়, কুরআন থেকে। যেটা আবু বকরকে কিঞ্চিত হতাশ করেছিল। ইতিমধ্য প্রায় দুসপ্তাহ ধরে মসজিদে তার আনাগোনা। তিনি এক ভাইকে একবার বলেই বসলেন, "'আচ্ছা এ বিষয়ে তোমার নিজের মতামত কি?' সে বলল, 'আমার নিজের মতামত কেমনে থাকবে যখন এটা আল্লাহর বাণী!' সুবহান আল্লাহ কথাটা আমাকে আসলেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। " সেদিন তিনি একটা কুরআন চেয়ে নিলেন।
আবু বকর বাসায় গিয়ে কুরআন পড়তে থাকলেন। তিনি আবিষ্কার করলেন কুরআন কোনো কিসসার বই না বরং আল্লাহ কুরআনে পাঠককে বিভিন্ন নির্দেশ দিলেন। ছয় মাস ইসলাম নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর কুরআনের বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক সকল প্রকার প্রমাণে তিনি আশ্বস্ত হলেন। তারপরও একটা শেষ ধাক্কার প্রয়োজন তিনি অনুভব করছিলেন। পর্বতের ধারে দাড়িয়ে ইসলামে ঝাপ দেয়ার জন্য 'অল্পহতখানি' ধাক্কা।
একরাতে তিনি ব্যাপক আধ্যাত্বিকতা অনুভব করতে লাগলেন। সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আবু বকর বলেন, "(মুচকি হেসে)আমি মোমবাতি জালালাম, জানালা খুলে দিলাম। পর্দা বেধে দিলাম। আমি আসলেই অনেক আধ্যাত্মিক অনুভব করছিলাম। এটা ছিল মেলবোর্নের একটা সুন্দর গ্রীষ্মের রাত।
"
"আমি চুপি চুপি বসে কুরআন পড়ছিলাম। আমি থেমে গেলাম। তারপর বললাম 'আল্লাহ, এটা আমার চূড়ান্ত মুহুর্ত। আমার কেবলই একটা নিদর্শন দরকার, ছোট্ট একটা নিদর্শন। '"
"আমি আশে পাশে তাকিয়ে বললাম 'হও!!'" আবু বকর অপেক্ষা করছিলেন হয়তো বিনা মেঘে বজ্রপাত হবে কিংবা তার ঘরের অর্ধেক ধসে পড়বে কিংবা সিনেমার মত মোমবাতির আগুন ছাদ পর্যন্ত পৌঁছুবে।
কিন্তু কিছুই হলনা। তিনি আবার বললেন, "আল্লাহ, আমি তোমাকে আবার সুযোগ দিচ্ছি। ছোট্ট কিছু দেখাও। হতে পারে একটা গাড়ি আওয়াজ করে চলে গেল বা একটা পাখি উড়ে গেল। যেকোনো কিছু ই হতে পারে।
তুমি শুধু দেখাও। " চারপাশে তাকিয়ে বললেন, "হও!!!!"
আবু বকর অপেক্ষা করলেন। কিন্তু এবারো কিছুই হলনা। তিনি এটুকুও বলতে পারলেন না ঐ দেয়ালের ফাটলটা আমার জন্য নিদর্শন। হতাশ হয়ে তিনি আবার কুরআন খুলে পড়তে লাগলেন।
পৃষ্ঠা উল্টেই প্রথম যে আয়াতটি পেলেন সেটি ছিল:
"তোমাদের মধ্যে যারা নিদর্শন দেখাতে বলছে, আমরাকি তোমাদের যথেষ্ট নিদর্শন দেখাইনি। চারপাশে তাকিয়ে দেখ, তারার দিকে দেখ, সূর্যের দিকে দেখ, পানির দিকে দেখ, এগুলো জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন। "
[ হুবহু আয়াত কুরআনে নেই তবে অনুরূপ আয়াত অনেক আছে। সম্ভবত সুরা নাহলের ১২ নম্বর আয়াত কিংবা সূরা হজের ১৬-১৮]
"আমি কুরআন মাথার উপরে রেখে ঘুম যাবার ভান করলাম। আমি এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমি হঠাৎ উপলব্ধি করলাম যে আমি কতইনা অহংকারী ছিলাম যে নিজের ব্যক্তিগত নিদর্শন চাচ্ছিলাম যখন সব নিদর্শন শুরু থেকেই আমার চোখের সামনে উপস্থিত ছিল। "
পরদিন আবু বকর প্রায় এক হাজার মুসল্লীর উপস্থিতিতে শাহাদাত নিলেন। দিনটি ছিল পহেলা রমজান। ১৯৯৬ সালে প্রেস্টন ভিক্টরিয়ায়, যেখানে একজন যুবক প্রকৃত ঈশ্বর আর সত্যধর্ম খুঁজে পেয়েছিলেন। আবু বকর এখন একজন সাইকোলজিস্ট আর ফিল্মমেকার।
আল্লাহ তাকে বরকত আর শান্তি দিতে থাকুক।
— ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।