আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেচে থাকার লড়াই ---- হাসপাতাল সুখে দুখে - ঘটনা: ৪

এই সিরিজ লেখা শুরু করার সময় ভেবেছিলাম মেডিকেল এ যা চোখের সামনে দেখি যা দেখে ভাল লেগে হোক বা কষ্ট পেয়ে হোক বা বিবেককে নাড়া দিয়ে হোক মনে দাগ কেটে যায় সেই ঘটনাগুলোই তুলে আনব। ভাবিনি অনেকের এত সমর্থন পাব। যারা সাথে আছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজকে একটা ঘটনা লিখব। আগের সিরিজগুলো: ঘটনা-১ ঘটনা-২ ঘটনা-৩ ঘটনা-৪: রোগীর নাম: আসমানি বয়স: ১৫ অভিভাবক: জানা যায় নি ঘটনা: তখন আমি গাইনি আউটডোরে কাজ করি। আসমানী এসেছিল একা, সাথে কোনো অভিভাবক ছিলনা।

সাধারনত হসপিটাল এ কেউ একা কমই আসে। আর এরকম বয়সের মেয়ের সাথে কেউ আসেনি আমরা বরং অবাক ই হয়েছিলাম। যাই হোক মাথায় ওড়না দেয়া, হালকা সবুজ রং য়ের কামিজ পরা একটা মেয়ে আসল। গায়ের রং সুন্দর ফর্সা। হালকা গড়ন।

কোনো মেকআপ ছাড়া এরকম স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য চোখে পড়ার মত। দেখে বোঝা যাচ্ছিল খুব বেশী সচ্ছল ঘরের হবেনা। কি সমস্যা: ম্যাডাম জানতে চাইলেন। মেয়েটি বলল- লাইগেশন করাবো। আমরা তো প্রথম কথা শুনেই থ"।

কি বলে এই মেয়ে? মাত্র ১৫ বছর বয়সের মেয়ে যার সংসার ই শুরু হয়নি সে লাইগেশন করবে? ম্যাডাম ধমক দিলেন- বেশী বুঝ মেয়ে! কে লাইগেশন করতে বলছে? কেন লাইগেশন করবা? তোমার স্বামী কি করে? মেয়েটি বলল -আমার স্বামী নাই। আমার নাকি কি অসুখ করছে তাই আমার সাবে বলছে লাইগেশন করে আসবা অসুখ সেরে যাবে। আমরা হতবাক! কি বলে এসব! ম্যাডাম আবার ধমক - কে লাইগেশন করতে বলছে? তোমার সাবে কেন লাইগেশন করতে বলবে? কি করছ সাবের সাথে? এক থাপ্পড় লাগাবো। ঠিক করে বল। মেয়েটা তখন কান্নাকাটি শুরু করল- ম্যাডাম কিচ্ছু করি নাই।

আমার অসুখ করছে। কিছু ভাল লাগেনা। সাবে বলছে হাসপাতালে গিয়ে বলবা লাইগেশন করব। সাবেই আমাকে এ রুমএ ঢুকায়ে দিয়ে গেছে। ৪ ঘন্টা পরে নিতে আসবে।

সাবে টাকা দিয়ে গেছে। আমি কিছু জানিনা ম্যাডাম। আমাকে শুধু অসুখ থেকে বাচান। আমি মরে যেতে চাইনা। ম্যাডাম কিছুটা বুঝলেন হয়ত ঘটনাটা।

মেয়েটিকে জিগেস করলেন- লাইগেশন করাতে এসেছ কিন্তু লাইগেশন কি জানো? "এটা একটা অপারেশন হবে আমি শুনছিলাম। অপারেশন হলে আমার অসুখ সেরে যাবে। " "কিন্তু এই অপারেশন হলে তোমার বাচ্চা হবেনা কোনোদিন এটা জানো?" মেয়েটা চমকে উঠল। খানিক পরে বলে - না হলে না হবে ম্যাডাম কিন্তু আমার এ মুহুর্তে লাইগেশন করাতেই হবে। ম্যাডাম একটু নরম হলেন।

মেয়েটাকে কাধে হাত রেখে বললেন- মা আমরা ডাক্তার। আমাদের কাছে লুকিয়ে কিছু করতে পারবেনা। তুমি বলবে আসল ঘটনা কি? বল মা আমাদের কাছে বল। আমরা সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করব। মেয়েটা ফুপরে কেদে ওঠে, যেন অনেক দিনের জমে থাকা কষ্ট অনেক না বলা কাহিনি আর বাদ মানছেনা।

সব ভেংগে আজ বের হয়ে আসছে। একটা কাগজ আমাদের হাতে দেয়। হাতে নিয়ে দেখি- প্রেগনেনসি পজিটিভ। ......আসমানী ৪ বছর আগে ভোলা থেকে ঢাকা আসে। তার এক ফুপু তাকে ঢাকা নিয়ে আসে।

আসমানীর বাবা পঙ্গু। হাইওয়েতে ভ্যান চালাতে গিয়ে এ্যক্সিডেন্ট হয়। মা ঝিয়ের কাজ করে। কিন্তু শ্বাসকষ্টের জন্য কাজ করতে পারেনা বেশি। আসমানিরা ৩বোন ২ ভাই।

আসমানী বড়। বাকি ২ বোন স্কুল এ পড়ে। ২ ভাই ও স্কুলে যায়। মা বাবার আয় কম। আসমানী এই বাসা থেকে ৪ হাজার টাকা পায়।

পুরো টাকাই প্রতি মাসে তার ফুপু গ্রামে দিয়ে আসে। ফুপু ৫০০ টাকা রেখে দেয়। আসমানীর হাড়ভাংগা খাটুনীর পর যে টাকা পায় সে টাকা দিয়ে চলে আরো ৬টি মুখ। বাবার চিকিতসা। শুধু হারভাংগা খাটুনী বলললে ভুল হবে।

আরও অনেক কিছু.....। এবাড়ির রান্নার কাজ করে আসমানী। ধোয়ামোছা অন্য বুয়া এসে করে। ম্যাডাম বড় শিক্ষিত মানুষ। প্রায়ই বিদেশ যায়।

ঐ সময় ২ বাচ্চা থেকে বাড়িতে। সাবে ঐ প্রথম থেকেই সুযোগ নিত। ঢাকা শহরে যেখানেই যাবে এমন হবেই। অন্য যায়গায় তো খুন্তি দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মারধোর করে।

অনেক সময় মেরে কেটে বস্তায় ভরে রেখে দেয়। এখানে তো এমন পর্যায়ে এখনও যায়নি। তাই আসমানী মুখ বুজে মেনে নেয়। সাবে একবার ইনজেকশন দিয়ে নিয়ে গেছে। তার জন্য তিন বছর কোনো সমস্যা হয়নি।

কিন্তু কিভাবে যেন এবার পেটে বাচ্চা এসে গেছে। আসমানী শরীর দুর্বল দেখে সাবে নিজেই টেস্ট করাতে নিয়ে গেছে। টেস্ট করে দেখা যায় প্রেগনেনসি পজিটিভ। তিন মাসের উপরে। আসমানীকে তার সাবে জানায়নি ও গর্ভবতী হয়ে গেছে।

বরং ওকে বলে দিয়েছে তোমার তো বড় অসুখ করেছে। সমস্যা নাই লাইগেশন করলে অসুখ সেরে যাবে তোমার আর দুর্বল লাগবেনা। তুমি খালি ডাক্তারকে গিয়ে বলবা লাইগেশন করব। এর বেশি কিছু বলবানা। আসমানীও সরল বিশ্বাসে লাইগেশন করাতে এসেছে।

ও জানেই না....লাইগেশন কি কেন করে। ওর এখন এই বাড়ির কাজটা ধরে রাখা জরুরী। মাসে ৩৫০০ টাকা বাড়িতে পাঠানো জরূরি। কোথায় পাবে মাসে ৩৫০০ টাকা বাড়িতে পাঠানোর জন্য? কি করবে আসমানী? আমরা শুধু শুনলাম....পরে বলে দিলাম লাইগেশন আমরা করবনা। তোমার পেটে বাচ্চা আছে এখন লাইগেশন করা পসিবল না।

পেটে বাচ্চা শুনে আসমানী আরও বিচলিত হয়ে পড়ল। আসমানি কান্নাকাটি করল। হাতে পায়ে ধরল। আমরা কঠিন মুখে মানা করে দিলাম। কিন্তু আমার মন তো আর এত কঠিন না।

কোথায় যাবে এই আসমানী? সাবে না হয় এই আসমানীকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে আরেক আসমানী নিয়ে আসবে। সাবে র কাজ তো বন্ধ থাকবেনা। কিন্তু গ্রামে হা করে চেয়ে থাকা ৬টি মুখ ওদের কি হবে? ছি ছি পড়ে যাবে গ্রামে। আসমানী নষ্ট হয়ে ফিরে এসেছে। সমাজ থেকে চ্যুত করা হবে আসমানী ও তার পরিবার কে।

হয়ত কোথাও এবরশন করাতে গিয়ে মৃত্যুও হতে পারে। কি হবে আসমানীর? আমরা সমাজ মেনে চলি। সমাজের মধ্যে চলি। কিন্তু আসমানীদের বাদ দিয়ে কেন সমাজের কথা চিন্তা করি? ওর জন্য কেন কোনো নিয়ম নেই ? আর মনুষত্ব এখন কোথায় যে আসমানীকে গর্ভবতী করার পর তার মা হবার ক্ষমতাটুকু ছিনিয়ে নিতে চায় এরা? তাও মিথ্যাচার করে , আসমানীকে প্রতারনার ফাদে ফেলে!! হে খোদা আসমানী ই কেন বলি হল? কোনো উপায়ই রাখনি কেন তুমি আসমানীর জন্য? ভালবাসা তো দুর! এই আসমানীরা কি মানুষ বলেও সহানুভুতি পাবেনা? খোদা এত কঠিন কেন তুমি!! আসমানী চলে গেল। জানিনা কি করবে আসমানী।

এবরশন? ৩মাসের পর পসিবল না। আত্মহত্যা? হায় খোদা তুমি তো আসমানীকে হত্যা আত্মহত্যা সবই করালে তাহলে। উপরওয়ালা সবই দেখছ সবই জান তুমি। কোনো একটা উপায় বের করে দিও খোদা। তোমার অসাধ্য তো কিছুই নেই।

এখন শুধু তুমি আর তুমি ই একমাত্র ভরসা। নেক্ক্সট!! ম্যাডাম পরের পেশেন্ট ডাকলেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.