সদাই পাতি ২
আলো না থাকায়, ঘামে ভেজা শরীরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাংলো মোবাইলের শব্দে। ওপারে ভেন। ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনেই বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে? ডিস্টার্ব করলাম?’ বললাম না কারেন্ট ছিল না। অন্ধকারে বসে থাকতে ভাল লাগছিলনা, আর আবার যে সিড়ি ভেঙ্গে নামবো সে সাহস ও পাচ্ছিলাম না।
প্রায় ৫ ঘন্টা কারেন্ট বিহীন থকার কথা ঢাকায়ও চিন্তা করা যায় না। ‘ এর পর তাকে জানালাম জুতোর দোকানের বিড়ম্বনার কথা। গভীর মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলো ভেন। তার পর বললো রাত এখনও তেমন কিছু হয়নি। দোকান পাট খোলা আছে।
তুমি চাইলে সঙ্গ দিতে পারি শপিংএ। সেই রাতে আর দোকানে যাবার ইচ্ছে হলনা । পরদিন অফিসে ভেনের কাছে জেনে নিলাম দরদাম করার পদ্ধতি। ভেন একটা কাগজে কিছু দরকারি কথা বার্তা ইংরেজি উচ্চারণে লিখে দিল।
ওঃ মানে আমি, তাঃ সে।
নিঃ তুমি। ঈ দে এনঃ অল্প স্বল্প।
আমি বললাম একদিনে তুমি আমাকে পুরো চাইনিজ শেখাতে পারবেনা। বরং হাট বাজারে যা লাগবে সে গুলো লিখ।
আচ্ছা বলে আবার লিখতে শুরু করলো সে।
এবারের লেখা দেখে মনে হল দরাদরিতে কাজে লাগতেও পারে।
যেগে তোশাওচেন =দাম কত?
টাই ডো = অনেক বেশি
যায় বিয়ান দিইনার বা= ডিস কাউন্ট?
হাঊ= ওকে
যু শি শা মা = এইটা কি?
শান মা= কী
ও শিং শি ফন= আমি ভাত খেতে চাই।
ইয়াওঃ= চাই
বু ইয়াও= চাই না
সি সে বু ইয়াও= ধন্যবাদ, চাই না।
মাইঃ কিনবো
নেই গা= ওই টা
যো গা = এই টা
ও ছিং বু দং =আমি বুঝি না,
দুই বো কি =আমি দুঃখিত
এত গুলি বাক্য থেকে বেছে বেছে দুটি নাত্র মুখস্ত করলাম। তো শাওচেন (দাম কত?) আর টাই ডো (অনেক বেশি)।
যায় বিয়ান দিনার বা (ডিস কাঊন্ট) টা মনে রাখা অনেক কঠিন হয়ে গেল। তারপরও রুমে ফিরে গিয়ে আঊড়াতে থাকলাম বাক্য গুলি। নিজের কানেই উচ্চারণ গুলো জুতসই মনে হল না। কৈশোরে আমার এক বন্ধু এক স্প্যানিস মহিলাকে প্রেম নিবেদনের জন্যে আমি তোমাকে ভাল বাসির স্প্যানিস শিখেছিল (জো তে কিয়েরো)। যার জন্যে শিখেছিল তাকে আর বলা হয় নি।
উচ্চারণের আড়ষ্টতাইয় তার কনফিডেন্স লেভেল এত নিচে কমে গিয়েছিল যে জো তে কিয়েরো বলে জুতো খাবার অবস্থা। সে যাই হোক প্রায় সারা বিকেল তো শাও চেন মুখস্ত করার পর দোকানে গিয়ে জিয়ে যখন বললাম সেলস গার্ল নির্বাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ততক্ষণে আমি ঘামতে শুরু করেছি। না জেনে আবার ঊল্টা পাল্টা কিছু বলে ফেললাম না কী। পকেট থেকে কাগজ বের করে যখন দেখলাম, না অভব্য কিছু বলিনি তখন সমস্ত আত্মবিশ্বাস জড় করে আবার বললাম তোশাওচেন? এবার মেয়েটি হাসতে হাসতে জিগ্যেস করল শান মা? আবার বিপদে পড় লাম।
কাগজ খুলে দেখলাম শান মা মানে কী। বুঝলাম কিসের দাম জিগ্যেস করছি সেটাই বলা হয়নি। বাংলাদেশের পটভূমিতে একটি মেয়েকে শুধু শুধু দাম কত জিজ্ঞাস করার ভাবার্থ ভেবে ঘাম আরও বেড়ে গেল। অনেক গুলি ঘড়ি ছিল মেয়েটার পাশের একটা শোকেসে কোন মতে সেদিকে দেখিয়ে বললাম নেই গা (ওইটা)। সেলস গার্ল নিসন্দেহে মহিয়সী বালিকা।
আমার ভাসা ভাসা ভাষাজ্ঞানের বিষয়টি তার কাছে আর অকপট রইল না। আমার ঘর্মাক্ত কলেবর দেখে দোকানের ছোট্ট টেবিল ফ্যানটি সে আমার দিকে ঘুরিয়ে দিল। তারপর একটি টিস্যু দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে বলল ‘আই নো ইংরিশ। ইউ মে সে ইন ইংরিশ’। এত সেবা যত্নের পর ওর দোকান থেকে কিছু কেনা আমার প্রায় অব্লিগেশন হয়ে দাঁড়াল।
ঘড়ি কেনার আমার ইচ্ছে ছিল না। এক জোড়া জুতো পছন্দ করলাম। ফাপরে পড়তে হল দাম আর মাপ নিয়ে। দামের সমস্যা মিটলো ক্যালকুলেটরে। কিন্ত মাপের ব্যাপারটা বুঝাতে অনেক কাঠ খড় পুড়াতে হল।
মেয়েটির সাথে সেই সুবাদে বন্ধুত্বও হল খানিকটা। তার কাছেই জানা গেল কেনা কাটার জন্যে সবচেয়ে ভাল জায়গা সেঞ্ঝেন আর লোওহু। ইলেক্ট্রনিক্স, খেলনা পাতি, পোশাক আশাক সবকিছুই সস্তায় পাওয়া যায় সেঞ্ঝনে। প্রতিদিন হং কং থেকেও প্রচুর লোক আসে সেঞ্ঝেনে। বললাম লোওহুতে তো শুনেছি খুব বুঝে শুনে শপিং করতে হয়।
হেসে ফেলল সেলস গার্ল ঠকে যাবার ভয় পাচ্ছো? আমি যাবো তোমার সাথে দেখি কে ঠকায়!
কী কিনবেন, কোথায় কিনবেন।
চীনে ব্রান্ড শপের অভাব নেই। লোঙ্গাগের এই অঞ্চল্টায় নোকিয়া, স্যামসং আর রিবোকের পাশাপাশি নানান চাইনিজ ব্রান্ডের ছড়া ছড়ি। সুপার স্টোর গুলির মধ্যে রেইনবো, পিংজো বায়হুয়ো, Maove, Zhuhai, জনপ্রিয়। দুনিয়ার প্রায় সব কিছুই চীনে পাওয়া যায়।
বাংলাদশের মানুষ সাধারণতঃ কুনমিং হয়ে চীনে যায়। বেজিং এখান থেকে অনেক দূরের পথ। সেনঝেন থেকেঈ বিমানে বেজিং যেতে লাগে ৩ ঘন্টার বেশি। আর কুনমিং থেকে সেনঝেন প্রায় দুই ঘন্টার আকাশ দূরত্বে। আমাদের জন্যে তাই শপিং করার সেরা জায়গা সেনঝেন।
চীনের মুক্ত বাজার অর্থনীতির সূচনাও হয়েছিল এখানে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগে দেং জিয়াও পিঙ্গের বিখ্যাত উক্তি (বিড়ালটি সাদা না কালো সেটি বড় কথা নয় যতক্ষণ পর্যন্ত সে ইদুর ধরতে পারে। )চীনে বাজার অর্থ নীতির পথ দেখিয়ে ছিল। কট্টর কমিউনষ্টরা এতে শ্রেণী সংরামের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ঘাতকতার গন্ধ পেয়ে বলে উঠেছিল ধীর গতির সোশালিস্ট ট্রেন সে যত ধীরেই চলুক দ্রুত গতির ক্যাপিটালিস্ট ট্রেনের চেয়ে ভালো। দেঙ্গের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ঊঠেছিল এসময়।
১৯৯২ সালে দক্ষিণ অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি উচ্চারণ করলেন কাইফেং (খুলে দাও)। বলা যায় মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে চীনের প্রবেশ সেই লগ্নেই। দেং তখন বৃদ্ধ হয়েছেন। রাষ্ট্র প্রধান হবার মোহ তাকে পেয়ে বসেনি। দেং এর আরেকটি বচন To become rich is glorious চীনে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পের প্রসারে অবদান রেখেছে।
বিশ্বের প্রায় সব নামকরা কোম্পানীই চীনের দিকে ঝুঁকেছে ধীরে ধীরে।
সেনঝেন সিটির বয়স মাত্র তিরিশ বছর। এই তিরিশ বছরেই সেনঝেন হয়ে উঠেছে ব্যাবসার প্রাণ কেন্দ্র। সেনঝেনের লোওহু কমার্শিয়াল সিটির খ্যাতি বিশ্ব জুড়ে। পাঁচতলা এই শপিং সেন্টারে দোকান আছে সাতশোর মত।
আপনি যা কিছু খঁজছেন তার প্রায় সবই পাওয়া যায় এখানে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পছন্দের শপিং সেন্টার কমার্শিয়াল সিটি। এই শপিং সেন্টারের পুরো পাঁচ তলা জুড়ে রয়েছে পোশাকের দোকান। তৈরী পোশাক ছাড়াও বিভিন্ন রকম টেইলর শপ আছে যেখানে স্যুট থেকে শুরু করে যে কোন পোষাক তৈরি করা যায় এক ঘন্টায়। অন্যান্য ফ্লোরে আছে জুয়েলারি, জুতা, কম্পিউটার এক্সেসরি, খেলনা, শপিং ব্যাগ।
নকল থেকে আসল সবই পাওয়া যায় এখানে। দর দামের সময় আসল জিনিষের দাম সম্পর্কে ধারণা থাকা ভাল। এই মার্কেটে শপিঙ্গের সময় মনে রাখতে হবে নিচের ফ্লোর গুলিতেই মূলত; নকলের ছড়াছড়ি। দোকান যত ঊঁচুতে পন্যের মান তত ভাল।
ইলেকট্রনিক্সের আর কম্পিউটারের জন্যে সবচেয়ে ভাল জায়গা হুয়াংশিঊ বে (ইংরেজিবানানে হুয়াংককিউও বেই)।
সেনঝেনের বিখ্যাত এসইজি মার্কেটও এখানেই। কম্পিঊতার, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ঘড়ি, এলইডি, চীপস, ট্রানজিস্টার সব কিছু আসল এবং নকল সবই পাওয়া যায় এখানে। এসইজি মার্কেটের একটি পুরো ফ্লোর জুড়ে রয়েছে এলইডি, ট্রাঞ্জিস্টার, রেজিস্টার এসবের দোকান। বেশির ভাগ দোকানই খুব ছোট বড় বড় কোম্পানীর মালামালের স্যাম্পল সাজিয়ে বসে থেকে পাইকাড়ি দোকানের ক্রেতারা, পরিমানে বেশি চাইলে হাতে পাবেন দোকানের কার্ড, আপনার মোবাইল নম্বরও রাখবে তারা, ফোন পাবেন সময়ে অসময়ে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা নিশ্চিত হচ্ছে যে জিনিষটি আপনি কিনে ফেলেছেন। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্টিকারও এখানে প্রকাশ্যে বেচাকেনা হয়।
কপালে থাকলে দেখতে পারবেন কিভাবে আপনার চোখের সামনেই সাধারণ একটি পন্য অসাধারণ হয়ে ঊঠছে স্টিকারের গুনে।
সস্তায় জুতো কিনতে হলে চলে যাবেন ডংমেন মার্কেটে, এই মার্কেটের একটি ফ্লোর শুধু জুতোর জন্যেই বারদ্দ। পৃথিবীর সকল ব্র্যান্ডের জুতোই এখানে পাবেন। চাইনিজ ব্র্যান্ড গুলির তুলনায় পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জুতোর দাম অনেক বেশি। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ফুটপাতে এই জুতোগুলি পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক কম দামে।
ডংমেন মার্কেটে জুতোর পাশাপাশি অন্যান্য পন্যের ব্র্যান্ড শপও আছে ডংমেনে।
সুপার মারকেট ও ডিপারট্মেন্টাল স্টোর
চীনের সুপারমার্কেটে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই। শুনলে অনেকেই বিস্মিত হতে পারে আমি প্রথম দিকে সুপারমার্কেটে যেতাম খাবার কেনার জন্যে। সবজি, ফল, রুতী, চকোলেট সহ অনেক কিছুই ওজনে বেচাকেনা হয় সুপার মার্কেটে। পরে বুঝলাম সুপার মার্কেটের প্রায় ৭৫% দামে ওই একই পণ্য পাওয়া যায় ফুটপাতে অথবা কিচেন মার্কেটে।
এককেজি আপেল সুপার মার্কেটে কিনতে হয় ১২০ টাকায়(বাংলাদেশি টাকার হিসাবে) বাইরে এর দাম ৭০- ৮০’র বেশি নয়। পিচ ফলের কেজি ১২০টাকা, আঙ্গুর ৮০, প্লাম ৬০, নাশপাতি ৬০, রানবুটান ৮০-৯০।
সুপার মারকেট গুলোর মধ্যে কেকে মল, রেইন বো, ওয়াল মারট, সানিং, মিক্স সি বিখ্যাত। তবে সেনঝেনের সবচে’ বিখ্যাত শপিং মল কোকো পার্ক। (অসমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।