আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। স্কুলে অধ্যয়নকালে ভাব সম্প্রসারণে পড়েছিলাম-‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। ’ সুকান্ত ভট্টাচার্য শিশুদের জন্য বাসযোগ্য নিরাপদ আবাস গড়তে চেয়েছেন। ছাড়পত্র কবিতায় তার উল্লেখ আছে এভাবে-
‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
শিশুরা হচ্ছে কোমল প্রাণ, কাদা মাটির দলার মত। কাদা মাটিকে যে রকম খুশি সে রকম গঠন করা যায়। ঠিক শিশুদেরকেও বড়রা যে রকম নির্দেশনা দেন, সে সেভাবেই গড়ে উঠে। শিশুদের একটা প্রবনতা হচ্ছে তারা অতি সহজে বড়দেরকে অনুকরন করে। বড়রা হাসলে তারা হাসে, বড়রা কাঁদলে তারা কাঁদে, বড়রা মাথা গরম করলে তারাও মাথা গরম করার চেষ্টা করে।
বড়রা সিগারেট খেলে শিশুও একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতে চেষ্টা করে। প্রথমে বড়দের খাওয়া সিগারেটের গোড়া দিয়ে তারা সিগারেট খাওয়ার প্র্যাকটিস করে। এরপর সে সিগারেট খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ধীরে ধীরে সে মদ, জুয়া, হেরোইন সেবন পর্যন্তও করে বসে। আর আমাদের দেশের বাবারা এত বেশি বেকুপ আর নির্বোধ যে, তারা ছেলেদেরকে সিগারেট আনতে পাঠায়।
এতে শিশুর কোমল মনে সিগারেটের প্রতি একটা ভাবনা তৈরী হয়ে যায়। এভাবে আমাদের সমাজে-দেশে শিশুরা পদে পদে সুযোগ আর সুষ্ঠু পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেড়ে উঠা তো পরের কথা। গ্রামের ছেলেরা সামান্য সুযোগ-সুবিধা পেলেও শহরের ছেলেরা এসব সুযোগ একেবারেই পাচ্ছে না। খেলার মাঠ না পেয়ে তারা ভিডিও গেম খেলে সময় পার করছে।
বর্তমানে আমাদের শিশুরা যে, সঠিকভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পাচ্ছে না তার কিছু বিররণ নিচে তুলে ধরছি।
১. শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নাই: এর ফলে শিশুরা ভিডিও গেম খেলে সময় পার করছে। যার কারণে অধিকাংশ ছেলে তাদের শরীর গঠন করার সুযোগ পাচ্ছে না। তারা মুটিয়ে যাচ্ছে।
২. ভিডিও গেম: ভিডিও গেম শিশুদেরকে খেলা বিমূখ করে গড়ে তুলছে।
যার কারণে শহরে ছেলেদের অধিকাংশকেই চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাদেরকে চশমা পরতে দেখা যায়।
৩. ইংলিশ মিডিয়াম: ইংলিম মিডিয়াম স্কুলে পড়ার কারণে শিশুরা আমাদের দেশের ভাষা, সংস্কৃতি শিক্ষা করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলে কী হচ্ছে-আমাদের দেশের ছেলেরা যারা আগামীতে দেশের বড় বড় আমলা হবে, রাজনীতির হর্তাকর্তা হবে, তাদের ভেতর জাতী সত্ত্বার মূল স্পিরিট তৈরী হচ্ছে না।
৪. মা-বাবার ভালবাসা বঞ্ছিত: বর্তমানে শিশুরা মা-বাবার ভালবাসা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে।
এতে শিশু মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিশুরা সুখে-দুঃখে মা-বাবাকে কাছে পাচ্ছে না যার ফলে সে যার তার সাথে মিশে নিজেকে বিপদের সম্মুখীন করছে প্রতিনিয়ত।
৫. অনিরাপধ পরিবেশ: আমাদের শিশুরা কাজের ছেলে অথবা কাজের বুয়ার কাছে লালিত-পালিত হয়। এতে করে কাজের বুয়ার মুখের বুলি কাজের ছেলের মুখের গালি তারা শিখে নিচ্ছে নির্দিধায়। একজন কাজের ছেলে কিংবা মেয়ের কাছে একজন শিশু কিছুতেই নিরাপধে বেড়ে উঠতে পারে না।
মেয়েদেরকে স্কুলে আনা-নেয়ার জন্য ড্রাইভার নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক সময় সেই ড্রাইভারদের উপরও ভরসা রাখা যাচ্ছে না। ড্রাইভাররা সুযোগ পেলে ঔ মেয়েকে খারাপ কোন পরিবেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেও তাদের বিবেকে বাঁধে না, বুক কাঁপে না।
৬. নৈতিক শিক্ষার অভাব: ছেলে-মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না। তাতে শিশুরা শিক্ষার নৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হতে পারছে না।
পাঁচ হাজার কিংবা দশ হাজার টাকা ব্যয় করে শিশুর জন্য অংক, ইংরেজী, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষা রাখলেও দুই হাজার টাকা ব্যয় করে কুরআন শরীপ শিখানোর জন্য কোন শিক্ষক নিয়োগ করছে না। যার ফলে শিশুর নৈতিক জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না।
৭. খারাপ হওয়ার উপকরণ: আমাদের শিশুরা একবিংশ শতাব্দীতে এসে এখন আর আগের শিশুর মত বসে নেই দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা তাদের জন্য খোলা রাখা হয়েছে খারাপ হওয়ার নানান উপকরণ। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের সামনে শত শত মূলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আর তাদেরকে ডাকছে, হে শিশু এসো তুমি খারাপ হওয়ার জন্য এসো, তোমাকে পৌঁছে দেব জাহান্নামের অতল গহ্বরে।
৮. ইন্টারনেট ব্যবহার: বর্তমানে আট দশ বছরের ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানে।
এতে করে অনেক সময় তাদেরকে দেখা যায়, রুমের দরজা বন্ধ করে একাএকা খারাপ ছবি দেখে। এবং সেভাবে তারা নিজেরা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। তাই সন্তানদের বয়ঃসন্ধিকালে মা-বাবাদের উচিত হবে ছেলে-মেয়েদেরকে পাশে রেখে আদর যতœ করা। ভালবেসে পরামর্শ দেয়া, সঠিক পথ বাতলে দেয়া।
৯. অবাধ মেলামেশা: বর্তমানে অনেক মা-বাবাকে দেখা যায় উপযুক্ত ছেলে-মেয়েদেরকে বাসায় একা রেখে মা একা একা বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে।
বাবা অফিসে এ ফাঁকে বয় ফ্রেন্ডকে নিয়ে মা রুমের দরজা আটকিয়ে ঘন্টর মত সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। বাবাকে দেখছে অনেক রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরছে। এভাবে যখন একটা ছেলে কিংবা মেয়ে মা-বাবার এমন লাগামহীন চলাফেরা দেখে তখন তারাও ধীরে ধীরে এমন আচরণ করতে শুরু করে। এবং এক সময় তারাও হারিয়ে যায় সে অন্ধকার জগতে। তাই ঔ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয় ফ্রেন্ডের সাথে অবাধ মেলামেশা করে জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।
বিঃদ্রঃ গত ১০ অক্টোবর জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিশ্ব শিশু দিবস পালন উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় উক্ত আলোচনা সভায় অনেকেই বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের কারো বক্তব্যই আমার কাছে ভাল লাগেনি। প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইব্রাহীম নামের একজন স্যারের আলোচনা আমার ভাল লেগেছে। উপরের পয়েন্টগুলো তারই বক্তব্য থেকে নেয়া হয়েছে।
পরিশেষে আগামীর দিন হোক শিশুদের জন্য বাসযোগ্য।
তারা নিরাপদে বেড়ে উঠুক নিরাপধে, নির্ভাবনায়, নিঃসংকোচে। দেশের প্রতিটি জনপদ মুখরিত হোক শিশুদের হাসি আনন্দ গানে আর নাচে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।