আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুবসমাজের অবক্ষয়: চ্যালেঞ্জ ও উত্তোরণ (১ম পর্ব)

মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময় ছাত্র জীবন। ছাত্রজীবন যেমন গুরুত্বপুর্ণ ঠিক তেমনি ঝুকিপুর্ণ। একজন ছাত্রের ভাল থাকাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হলেও তার খারাপ হওয়াটা অত্যন্ত সহজ। কারণ এ সময়টাতে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে অসংখ্য অসুভশক্তি। আমি এটাকে এভাবে প্রকাশ করি যে, কচুর পাতার পানি যেমন টলমল করে যে কোন মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনি একজন ছাত্র যেকোন সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

বর্তমানে গোটা বিশ্ব সহ বাংলাদেশ এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিত। যার নাম মাদক। সর্বনাশা মাদকের নীল বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত যুবসমাজ। যার ভয়ানক প্রভাব লক্ষকরা যায় আমাদের মানুষ গড়ার আঙ্গিনাগুলোতে। বাংলাদেশের সাধারন সংস্কৃতির সম্পুর্ন বিপরীত চর্চা করা হচ্ছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যম্পাসে ও এর পরিসীমায়।

এখানে কেমন যেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ছাড়া নিজেকে আধুনিক বা অভিজাত হিসেবে প্রকাশ করা যায় না। এটা বলা যায় যে, এই সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নামগুলোই যেন পশ্চিমা শিক্ষাঙ্গন থেকে ধারকরা। তাই এই প্রতিষ্ঠান সমুহের শিক্ষার্থীরা নিজেদের হাজার বছরের আতœপরিচয়কে ভুলে গিয়ে চোখ ধাঁধানো মরিচিকার পেছনে ছুটছে। তাদের প্রাত্যহিক ব্যাবহারিক জীবনের একটি মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে হলিউড, বলিউড কিংবা ডালিউডের সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া কোন ছবির নায়ক, নায়িকারা কি ধরনের পোষাক পরলো। এই ছবিগুলোর নামে যে পোষাকটি বাহির হবে তা কোন এক বন্ধু যদি আগে কিনে থাকে তাহলে অন্য বন্ধুদের প্রশংসা কুড়িয়ে নিতে সক্ষম হল।

সমপ্রতি আমরা দেখতে পাই যে, তেরেনাম, রা-ওয়ান, জিলিক, টাপুর-টুপুর, ওয়াকা-ওয়াকা, বিন্ধু, দেবদাস এ দরনের বিভিন্ন ছবি, অভিনেতা- অভিনেত্রীর নামে যে পোষাকগুলো বের হয়েছে তা যুব সমাজের পছন্দ কুড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই পোষাকগুলো কোন প্রকার রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে না। অন্যদিকে, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি এইসব ওয়াকা-ওয়াকার উপর ভর করে তার বাস্তব স্বকিয়তা হারিয়ে পেলেছে। তাই, একজন ছাত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে তাকে সঠিক পথে রাখার জন্য কিংবা মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন না করা হয়, তাহলে এ দেশের যুবসমাজের কাছে জাতির যে প্রত্যাশা তা ব্যার্থ হতে বাধ্য। একজন যুবকের ছাত্র জীবনে তার সৎ সংঘই কেবল মাত্র তাকে তার সুন্দর একটি ক্যারিয়ার গঠনে সহযোগী হতে পারে।

পরিবারের যথাযথ তত্ত্বাবধানও এক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা ভুলে যাই Prevention is better than cure. অবক্ষয়ের এই ধারা প্রতিষেধক ব্যবস্থা ছাড়া প্রতিকার যোগ্য নয়। আমরা টেলিভিশন, প্রত্রিকা, রাজনৈতিক মঞ্চ এবং সভা সেমিনারে যতই নান্দনিক এবং শ্রুতিমধুর ভুলি বর্ষন করিনা কেন, সুন্দর ও আলোকিত সমাজ, এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের এ প্রজন্মের যুব সমাজের নৈতিক উন্নতির প্রতি। অভক্ষয় থেকে বাঁচতে হলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে একটি মাদক মুক্ত, পশ্চিমা সংস্কৃতির নগ্ন ছোবল থেকে মুক্ত একটি আধুনিক সমাজ। যেখানে অপবিত্রতা ও অশ্লিলতার কোন স্থান নেই, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ছোটদের প্রতি ¯েœহ যেখানকার অনন্য বৈশিষ্ট্য।

বর্তমান সময়ে, রাস্তাঘাটে উঠতি বয়সের কিছু ছেলেকে দেখা যায় তাদের মাথার চুল উস্কুখুস্কু, শর্ট শার্ট পরা, জিন্সের প্যান্ট কোমরের নিচের দিকে পরা, হাত একটু উঁচু করলেই নজ্জাস্থানের কিয়দাংশ দেখা যায়। প্যান্টের নিচের অংশ পায়ের পাতার নিচে পরে থাকে অনেকটা ঝাড়–দারের কাজ করে। দাঁড়ি কেটে মুখের বিশেষ জায়গায় এমনভাবে রাখে যেটা নিশ্চিত কোন ইহুদী, খৃস্টান, হিন্দু অথবা তথাকথিত মুসলিম নামদারী নায়ক কিংবা কন্ঠশিল্পীরা করে থাকে। আর কিছু মেয়েরা ধর্ম, জাত-পাত সব ভুলে পোশাক ছোট করতে করতে এমন পর্যায়ে পেীছেছে যে, তারা ক’দিন পে চিড়িয়াখানার সদস্যদেও মত কিছু দাবি না করে বসে। আমার করুনা হয় ঐসব অভিভাবকদের প্রতি যারা তাদের মেয়েদের ওড়না ছাড়া টি-শার্ট, জিন্সের প্যান্ট পরে বাহিরে বের হতে দেয়।

অবশ্য তাদের বাবা মাও যদি ওমন চরিত্রের হয় তাহলে বলার কিছুই নেই। কারণ, সর্বাঙ্গে ব্যাথা ঔষধ দিব কোথা। অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের উগ্র পোশাক পরতে দেয় তাহলে তাদেরকেই পস্তাতে হবে। আরব্য করীর একটি উক্তি মনে পড়ে যায়, তা হলো- ‘ইন্নাকা লা-তাজনি মিনাশ শাওকিল ইনাব’ তুমি কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ থেকে কখনো আঙ্গুর ফল পাবে না। সারা দেশ নয়, শুধু ঢাকা শহরেই লাখ লাখ মা-বাবা রয়েছেন যারা তাদেও ছেলে-মেয়েদেও নিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।

বলা হয়ে থাকে, Education is the backbone of a nation অর্থ্যাৎ শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা মানুষকে মর্যাদাবোধ সম্পন্ন করে তুলে। শিক্ষার দরুণ মানুষ নিজ সম্পর্কে, নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়। নেপোলিয়নের ভাষায়: Give me an educated mother, I will give you an educated nation. মহাকবি জন মিল্টনের ভাষায়: Education is the harmonious development of body, mind and soul. কিন্তু এই দেহ, মন এবং আত্মার সামগ্রিক সমন্বয় হচ্ছে না, কারণ আমরা শিক্ষাকে মনে করি চাকুরি অর্জনের হাতিয়ার। ফলে সার্টিফিকেট সর্বস্ব একাডেমিক শিক্ষা নামক হজমি টেবলেট আমরা গলাধ:করন করছি ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতভাবে শিক্ষিত হতে পারছি না।

বর্তমান বাস্তবতা বিবর্জিত শিক্ষা আমাদের বাস্তব জীবনেও বাস্তবতা বিবর্জিত শত অঘটনের জন্ম দেয়। তাই শিক্ষার লক্ষ্য কেবল স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডির ভিতরে না রেখে একে ইউনিভার্সাল করতে হবে। সুনির্মল বসূর সে বিখ্যাত কবিতা: বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র, এ কথা মনে রাখতে হবে। প্রাচীন গ্রিসের দিকে তাকালে ঞ্জান চর্চার গুরুত্ব পূর্ণরুপে উপলব্দি করা যায়। কিভাবে সক্রেটিস, প্লেটো, জেনিফোন, এরিস্টটলদেও বিতর্ক সভা আর পাঠচক্রগুলো গ্রীসকে সভ্যতার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলো, সে রহস্য উন্মোচিত হবে।

মোট কথা শিক্ষার চর্চা ও বিস্তার ছাড়া কোন জাতি উন্নত হতে পারে না। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষ নজর এবং গুরুত্ব দিতে হবে নৈতিকতার সমন¦য়ের প্রতি। কারণ আমরা একটি প্রবাদ জানি- “দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য”। আর্থ্যাৎ man in career, without character, is more dangerous than a lion. তাই বড় বড় সার্টিফিকেট দিয়ে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে দিলেই হবেনা বরং তাকে একই সাথে নৈতিকতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে সে সমাজকে আলোকিত করার পরিবর্তে অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে বেশি তৎপর থাকবে।

একজন অন্ধ মানুষের হাতে যদি মশাল দিয়ে পথ দেখাতে বলা হয়, তাহলে তার দ্বারা পথ দেখানোর পরিবর্তে বাড়ি ঘরে আগুন লাগানোর সম্ভাবনাই বেশি থাকবে ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেল গুলোর এখন এতই স্বাধীন করে দেয়া হয়েছে যে, শহরের পাশাপাশি মফস্বল এলাকাতেও এই চ্যানেল গুলো আমাদেও যুবক এবং তরুনীদেও কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে স্টার প্লাস, স্টার জলসা আমাদের তরুন-তরুণীদের চাড়তেই যেন চায় না। অথচ এসব চ্যানেলগুলোতে যে নাটকগুলো দেখানো হচ্ছে এরমধ্যে পারিবারিক দ্বন্ধ, মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ে হেয় করা ছাড়াও বিভিন্ন কুসংস্কারকে বাস্তব বলে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে করে তরুণ, তরুণীরা না বুঝেই এই সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। যার দরুণ আমরা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে বিনদেশী সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছি অকপটে।

যে কোন জাতির বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার সাথে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। তাই আমরা যদি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে ভিনদেশী সংস্কৃতি নিয়ে দিনের পর দিন উৎসব ও মাতামাতি করি নিঃসন্দেহে একদিন আমাদের সার্বভৌমত্ব অস্তিত্বের মুখোমুখি হবে। বিখ্যাত দার্শনিক ডিকার্টে ’র একটি কথা বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য-“মানুষের মন ও মনন আল্লাহর এক বিশেষ অবদান। এ শক্তি আল্লাহ তাআলা কেবল মানুষকেই দিয়েছেন। সৃষ্টির মাঝে এই গুন তিনি আর কাউকেই দেননি।

তবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের সাহায্যে তাকে অধিক তিক্ষœ ও শ্বানিত করে তোলা যেতে পারে, তাকে উত্তম পন্থায় প্রয়োগ ও ব্যবহার করা যেতে পারে”। কিন্তু বর্তমান সমাজের চিত্র কি প্রমানিত করছে? নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশকে সমগ্র বিশ্ব বাসীর সামনে সঠিক ভাবে তুলে ধরার পরিবর্তে মডার্নিজমের দোহাই দিয়ে সর্বক্ষেত্রে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ফেশনের চর্চা ও গোলামী করছে, জলাঞ্জলি দিচ্ছি লজ্জাবোধ-স্বাতন্ত্রবোধ-আতœমর্যাদা এবং স্বাধীনতার চেতনা। ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা লাল সবুজের পতাকা। কিন্তু দিন দিন আমাদের সংস্কৃতির যেভাবে তিলে তিলে ধুকে ধুকে বিলীন এবং বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাতে করে মনের মধ্যে কেবল একটি প্রশ্নই বারে বারে উকি মারে, আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা এই লাল সবুজের পতাকা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র অর্পন করে যেতে পারব কি? উপরোক্ত আলোচনার সাথে যদি আমরা একমত পোষন করি তাহলে বর্তমানে আমাদের সমাজে সংস্কৃতির নামে যেসব অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ডিজে পার্টি, থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন, নারী পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, অদ্ভুত ও রুচিহীন পোষাক ইত্যাদি কোন সুস্থ সংস্কৃতির ভিতরে পরে না। এর দ্বারা সত্য ও সুন্দরের চর্চার পরিবর্তে মানুষিক ও শারীরিক ব্যধির সংক্রমন বাড়ছে।

এমন একটি পরিস্থিতিতে আজ আমাদেরকে বসে বসে দর্শকের ভূমিকা পালন করলে হবে না। এর সমস্যা সমাধান করতে হবে এ আমাদেরকেই, এ প্রজন্মের সচেতন যুবসমাজকে। যারা আগামী দিনের প্রজন্মের কাছে একটি সুন্দর, সভ্য ও উন্নত এবং সর্বোপরি একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিয়ে যেতে পারবে। .............। ...........................চলবে.............................।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।