আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গঃ এই যন্ত্র লইয়া আমরা কী করিব!

কাপুরুষের শেষ আশ্রয় হল দেশপ্রেম আজকের প্রথম আলোতে আনিসুল হকের লেখা প্রবন্ধ 'এই যন্ত্র লইয়া আমরা কী করিব!' প্রসঙ্গে আমার দুটি আপত্তি আছে। এক, 'মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক একটা যন্ত্র মাত্র, মাধ্যম মাত্র'- তাঁর এই কথাটি ভুল। ফেসবুক, ইন্টারনেট কোন যন্ত্র নয়- বড়জোড় প্রযুক্তি বলা যেতে পারে। দুই, ২০০৯ এ সামুতে একটা পোস্ট লিখেছিলাম 'এত ইঞ্জিনিয়ার লইয়া আমরা কী করিব!' শিরোনামে। আনিসুল হক পেটেন্ট লঙ্ঘন করেছেন!!! যাহোক, লেখার মূল কথার সাথে একমত জানাই এবং লেখককে ধন্যবাদ জানাই।

আনিসুল হকের ইদানিংকার লেখাগুলো 'জ্বালাময়ী' হচ্ছে এবং উনি মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত 'শীতনিদ্রা'য় নেই সেজন্য শুকরিয়া জানাই। একজন সত্যিকারের 'বুদ্ধিজীবী'র কলম যেন 'পরজীবী'র মত না হয় সেটাই সাধারণ মানুষ আশা করে। আনিসুল হক তাঁর প্রাপ‌্য সম্মানের জায়গাটি অক্ষুণ্ণ রাখছেন। আনিসুল হকের এই লেখাটি নিয়ে আমার অযথা ব্লগে বকবক করার কারণ হল- প্রায় একই বিষয় নিয়ে অর্থাৎ আমাদের অসভ্যতা নিয়ে কয়েকদিন আগে আশুলিয়া দিয়ে গাড়িতে ফেরার পথে সহকর্মীদের সাথে আলাপ করছিলাম। উল্লেখ্য, আশুলিয়ার বাইপাইল থেকে আশুলিয়া ব্রীজ অর্থাৎ প্রায় ধউর পর্যন্ত প্রায়ই সন্ধ্যার পর যানজট লেগে যায়।

অপ্রশস্ত এই রাস্তাটিতে প্রায় সব ধরণের যানবাহন চলাচল করে- রিক্সা, ভ্যান, প্রাইভেট কার, পিকআপ, ম্যাক্সি, ট্রাক, মিনিবাস, বড়বাস, কাভার্ড ভ্যান, কন্টেইনারবাহী লরি ইত্যাদি। বিকেল থেকে শুরু হয় রাস্তার দুইদিকেই গাড়ীর চাপ। কিন্তু সেই চাপ এত বেশি নয় যে গাড়ী ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকবে। যদি প্রতিটি গাড়ি নিয়ম মেনে একটি সারি করে চলে তাহলে রাস্তার উপর কোন গাড়িই থেমে থাকবে না অর্থাৎ প্রতিটি গাড়ি চলমান থাকবে- যানজট সৃষ্টি হবে না। কিন্তু আমরা বাঙ্গালী- বিশেষ করে বলতে গেলে গাড়ীচালকরা এত বেশি ইতর, এত বেশি টাউট যে- নিয়ম ভাঙ্গাতেই আমাদের সুখ।

ডিভাইডারবিহীন এই রাস্তাটিতে মনে হয় সন্ধ্যার পর রেসিং শুরু হয়। কে কার আগে যাবে সেই নিয়ে শুরু হয় ছেঁচড়ামি। কোথায় একটু আটকে গেলেই একেক দিকের গাড়িগুলো দুই থেকে তিনটা সারি করে এগোতে চেষ্টা করে। ফলে বিপরীত দিক থেকে কোন গাড়ি পার হওয়ার জায়গা থাকে না। 'পেজগি' লাগিয়ে সব দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ বা স্থানীয় লোকজন উদ্যোগ নিয়ে জট ছড়ায়।

অথচ সামান্য একটু ধৈর্য্য ধরলেই, একটু 'সভ্য' হলেই সবাই সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু কাকে কি বলব- ডান্ডার বাড়ি ছাড়া বাঙ্গালী অন্যকিছুতে সোজা হয় না। এবার যন্ত্রের কথায় আসি। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির এক অসামান্য দান। মানুষের জীবনকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় ও গতিশীল করেছে এই প্রযুক্তি।

আজ অফিসে বসে বা পথে যেতে যেতেই অসুস্থ বাবা-মা বা স্ত্রী-সন্তানের খবর নেয়া যায়- এর চেয়ে স্বস্তির আর কি হতে পারে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে মোবাইল ফোনের অবদানের কথা নাই বা বললাম। কিন্তু এই মোবাইল ফোন ব্যবহারের যে কিছু সাধারণ ভদ্রতাজ্ঞান থাকা দরকার সেটা দুঃখজনক হলেও আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। কয়েকটা উদাহরণ দেই- * আমরা বাঙ্গালীরা কথা বেশি বলি। ছোট কথাও অযথা বাড়িয়ে বলা আমাদের মজ্জাগত।

আর কম দামে মোবাইল সেট ও তার চেয়ে কম কলরেট পেয়ে সেই বদস্বভাবটিকে আমরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছি। যে কথাটি দুই মিনিটে শেষ করা যায় সেটা পনের মিনিট ধরে মোবাইলে 'গেজিয়ে' দেশের টাকায় আসলে কার পকেট ভারি করছে সেটা কি আমরা খেয়াল করছি? * মোবাইল ফোনের রিংটোনের ব্যাপারে আসি। আমি কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের লোকজনের সাথে উঠাবসা করেছি। সবার ক্ষেত্রে দেখেছি, মোবাইল ফোনের রিংটোন থাকে রুচিসম্মত ও যথাসম্ভব নিচু। এবং আলোচনায় বসার আগে অবশ্যই 'তারা' রিংটোন বন্ধ করে দেন।

কিন্তু আমরা বাঙ্গালীরা মনে হয় উদ্ভট, বিকট, বিকৃত রুচির রিংটোনের কোন জরিপ যদি হয় তাহলে সবার শীর্ষে থাকব। মাঝেমাঝে তো এমনও হয়, রিংটোনের শব্দে সবাই বোমা বিস্ফোরণের মত চমকে উঠি। আমার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীর মোবাইলে মেসেজ আসলে 'ওই, মেসেজ আইচ্চে রে!' এই কথাটিই বার বার বিকটভাবে উচ্চারিত হয়। অনেকবার বলার পর সেই লোকটি টোনটি পরিবর্তন করেছে। * মোবাইল ফোনে কল দেয়ার ক্ষেত্রে সময়জ্ঞান একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

নিছক অতি জরুরী বিষয় না হলে কাউকে 'ব্যক্তিগত' সময়ে ফোন করা উচিত নয়। সাধারণত রাত দশটার পর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত জরুরী বিষয় ছাড়া আমি নিজে কাউকে ফোন দেই না। ফোন দেয়ার পর যদি বুঝি যাকে ফোন করেছি তিনি বাস, হাসপাতাল বা রেস্টুরেন্টে আছেন- তাহলে প্রয়োজন ছাড়া কথা বাড়াই না। আবার দুপুর একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষ নামাজ, লাঞ্চে ব্যস্ত থাকেন। এই সময়টাতেও পারতপক্ষে ফোন দেই না।

বাড়ির মেয়েরা সারাদিনের কাজ শেষে দুপুর দুইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত বিশ্রামে থাকেন। এই সময় মা, বোন বা স্ত্রীকেও প্রয়োজন ছাড়া ফোন দেই না। এই সময়গুলোতে ফোন না দিয়ে মেসেজের মাধ্যমেও অনেক জরুরী কাজ সেরে ফেলা যায়। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ বাঙ্গালীর কান্ডজ্ঞান খুব কম। প্রায়ই দেখা যায় কেউ বাসে, রেস্টুরেন্টে কোলাহলের ভিতর উচ্চস্বরে মোবাইল ফোন কথা বলছে- হোক সেটা পারিবারিক আলাপ- আশেপাশের লোকজনকে 'এরা' থোড়াই কেয়ার করে।

এই প্রসঙ্গে একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি- গ্রামীণফোনের সেলবাজারে একটা ল্যাপটপ বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম- একদিন রাত পৌণে দুইটার দিকে একজন ফোন করে বলে- আপনার ল্যাপটপটা কিনতে চাই! মেজাজ ধরে রাখা কি কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ভেবে দেখুন!!! * আরেকটা বিরক্তিকর বিষয় হল- একজনকে ফোন দেয়ার পর যদি না পাওয়া যায় তাহলে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট বিরতি দিয়ে দ্বিতীয়বার ফোন দেয়া উচিত বলে মনে করি। কেননা, উদ্দিষ্ট লোকটি হয়ত এমন কোন কাজে ব্যস্ত আছেন যখন ফোন ধরা অসম্ভব। যেমন- হয়ত তিনি 'টয়লেটে' আছেন, হয়ত তিনি 'খেতে' বসেছেন, হয়ত তিনি 'কাচাঁবাজারে' আছেন, এমনকি তার হয়ত কোন কারণে ফোনে কথা বলার 'মুড'ই নেই- সে সময়টিতে মানুষকে ক্রমাগত ফোন দিয়ে অস্থির করার মত চরম 'বিরক্তিকর' কাজ আমাদের অনেকে হরহামেশাই করি। কিছু সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও অনেক সময় পাগলের মত বিকৃত আচরণ করে- কাউকে ফোনে একবার না পেলে একটার পর একটা কল দিতেই থাকে। আমি বহু লোকের সাথে ফোন দুর্ব্যবহার করেছি শুধুমাত্র এই কারণেই! * অনেকের আরও একটা বিরক্তিকর অভ্যাস আছে অন্যের এমনকি স্বল্পপরিচিত কারও ফোন চেয়ে নিয়ে খোঁচাখুঁচি করা।

আমরা প্রায়ই ভুলে যাই- মোবাইল ফোন অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যবহার্য বিষয়ের মতই জিনিস। তাই কারও কাছে মোবাইল চাওয়ার আগে ভেবে নেয়া উচিত, কাজটাতে তিনি বিব্রত হন কিনা। মোবাইল ফোন ব্যবহারে এই ভদ্রতাগুলো মেনে চলা কি খুব কঠিন?  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।