সরকারি ও বেসরকারি হিসাব বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, যাঁদের অধিকাংশই নারী। গ্রামের শান্ত, নীরব ও ধীর জীবন ছেড়ে শ্রমিকেরা কোলাহলপূর্ণ ও গতিশীল শহরে ছুটে আসেন।
শহরের কারখানায় যাঁদের কাজ জোটে, তাঁদের জন্য থাকে স্বল্প মজুরি, একটি ছোট ঘরে কোনোমতে ঠাসাঠাসি করে বসবাস আর সস্তা খাবার। অথচ তবুও সুন্দর জীবনের স্বপ্নে বিভোর এ মানুষেরা শহরকেই বেছে নিয়েছেন স্বপ্ন পূরণের উপায় হিসেবে। কিন্তু লাগাতার দুর্ঘটনায় তাঁদের বহু যত্নে লালিত স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে।
অনেক শ্রমিকই এখন কারখানাগুলোকে স্বপ্ন পূরণের উপায় নয়, বরং স্বপ্নের মরীচিকা হিসেবেই দেখছেন। এমন তথ্য উঠে এসেছে বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে।
এপির বরাত দিয়ে ‘হাফিংটন পোস্ট’ তৈরি পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তেকানি গ্রামের নারী ও পুরুষ পোশাকশ্রমিকদের অভিমত উঠে এসেছে।
তেকানি থেকে ঢাকা শহরের দূরত্ব অনেক।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামটি থেকে বাসে করে ঢাকায় আসতে সময় লাগে প্রায় নয় ঘণ্টা। তেকানির অধিকাংশ অধিবাসীর নিজস্ব ভূমি নেই, অন্যের খেতে কাজ করে তাঁদের যা জোটে, তাতে উদরপূর্তি হয় বটে, কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হয় না। স্বপ্নও যে আকাশছোঁয়া, তা নয়। একটু নিজের জমি, একটা ভালো বাড়ি আর ছেলেপুলে নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে বর্তে থাকা। এ গ্রামে এখনো বিদ্যুত্ পৌঁছায়নি, তাই আধুনিক জীবনের অনুষঙ্গ টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার বা মোটরগাড়ির মতো জিনিসগুলো ব্যবহারের প্রশ্নও ওঠে না।
প্রতি ঈদে তেকানির শ্রমিকেরা গ্রামে ফেরেন। আত্মীয়স্বজনের জন্য নতুন পোশাক আর পরিবারের লোকদের জন্য জমানো টাকা নিয়ে তাঁরা গ্রামে যান, দিন তিনেক পরে আবার শহরে ফেরেন নতুন ও অদক্ষ অনেক শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে। গরিব দেশের গরিব গ্রামের গরিব মানুষেরা শহরে আসেন নতুন স্বপ্ন নিয়ে। আর স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপায় হলো একটি চাকরি। দেশের দুই হাজার কোটি ডলারের তৈরি পোশাকশিল্পের জ্বালানি তাঁরাই।
তেকানির একজন মোসাম্মত্ আলমুনা বেগম। নিজের ২১ বছর বয়সী মেয়েকে তিনি ঢাকায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি তা আর চান না। তিনি বলেন, ‘এখানে না খেয়ে থাকাই ভালো। ওখানে কোনো নিরাপত্তা নেই।
’
তাজরীন ফ্যাশনসে লাগা আগুনে পুড়ে যে ১১২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন এ গ্রামের। রানা প্লাজা ধসে যে হাজার খানেক শ্রমিক নিহত হলেন, তাঁদেরও অনেকের বাড়ি ছিল তেকানিতে। অনেকের প্রশ্ন, কারখানাগুলো সত্যিই কি শ্রমিকদের সংগ্রামের মূল্য দিচ্ছে?
তাজরীন ও রানা প্লাজা ধসে মোট এক হাজার ২৪১ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এসব দুর্ঘটনার আগে প্রতি মাসে গড়ে ১০ জন তেকানিবাসী শহরের কারখানায় কাজ করতে যেতেন। এখন এসব গ্রাম থেকে আর কেউ শহরে আসতে চাইছেন না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেকানি একটি সুজলা-সুফলা গ্রাম। ধান, শস্য আর ফসলে ভরপুর গ্রামটি। নানা ফলের গাছে ঘেরা ঘরবাড়ি। কিন্তু এর পরও তেকানি তার মানুষদের সবচেয়ে বড় চাহিদাটি পূর্ণ করতে পারে না বলেই গ্রামবাসী শহরের চলে যায়।
তেকানি যে ইউনিয়নে পড়েছে সেটির চেয়ারম্যান নূর আলম জানান, তেকানি ও এর আশপাশের নয়টি গ্রামের মোট অধিবাসী প্রায় ২৫ হাজার।
তাদের মধ্যে চার হাজার কোনো না কোনো পোশাককারখানায় কাজ করেন। এসব শ্রমিকের ৬০ শতাংশই নারী।
নূর আলম বলেন, ‘যাঁরা কারখানায় কাজ করতে গেছেন, তাঁদের শত ভাগই গেছেন অর্থনৈতিক কারণে। এটা ভালো লক্ষণ। গ্রামের অনেক মানুষের জমিজমা নেই, তাই গ্রামে বেঁচে থাকাটা তাঁদের জন্য কষ্টকর।
’
শ্রমিকেরা কারখানায় কাজ করতে চান। কারণ, এসব কাজ সহজে পাওয়া যায় আর কাজ পেতে কোনো দক্ষতারও প্রয়োজন হয় না। কারখানাই প্রশিক্ষণ দিয়ে দেয়। তাই মাসে সাকল্যে তিন হাজার টাকায় কাজ করতে শ্রমিকেরা ছুটে যান কারখানায়। তবে দক্ষ শ্রমিকদের আয় বেশি।
অনেকে ওভারটাইম ও অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে প্রতি মাসে আট হাজার টাকার মতো আয় করতে পারেন।
তেকানির কাজ মৌসুমভিত্তিক এবং তাতে মজুরিও কম। গ্রামে যাঁরা থাকেন, তাঁদের অধিকাংশ রিকশা চালিয়ে, ছোটখাটো দোকান দিয়ে বা কায়িক শ্রম বেচে টিকে থাকেন। এ তুলনায় পোশাকশ্রমিক হওয়া হয়তো ভালো। নূর আলম বলেন, ‘গার্মেন্টে কাজ করা সম্মানের ব্যাপার।
’
কুলসুমা বেগম কাজ করতেন ঢাকার এক কারখানায়। এখন তিনি তেকানিতেই থাকেন। তাজরীনের আগুন থেকে তাঁর দুই ভাই কোনো মতে বেঁচে যান। কুলসুমা এখনো মনে করেন, কারখানার কাজ খুব খারাপ নয়। তিনি বলেন, ‘ওই জীবনটা আমার জন্য ভালো ছিল।
মাস শেষে টাকা পেতাম। কিন্তু এখানে (গ্রামে) কোনো আয় নেই। ’
বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, এগুলো শ্রমিকদের শোষণ করে, শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং কারখানা চালু রাখার জন্য যে ন্যূনতম পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার, তা করে না। কারখানার মালিকেরা এত ক্ষমতাধর যে, শ্রমিকেরা নিজেদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারেন না।
তেকানি গ্রামেই কথা হয় আঙ্গুরা নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি খুব দ্রুত গ্রামে ফিরতে চান। তিনি বলেন, কিছু টাকা জমাতেই পারলে তিনি ও তাঁর স্বামী গ্রামে ফিরবেন। এখন তাঁরা দুজনে মিলে মাসে ১০ হাজার টাকার মতো আয় করেন। ঘরভাড়া, খাবার ও সংসারের অন্যান্য খরচে এ অর্থ দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এর পরও কোনো কোনো মাসে তাঁরা আড়াই হাজার টাকার মতো সঞ্চয় করতে পারেন।
অনেক কষ্টে, কম খেয়ে, কম পরে তাঁরা এ টাকা জমান।
আঙ্গুরা জানালেন, খুব ভোরে জীবন শুরু হয় তাঁর। মাটির চুলায় রান্না করে, সংসারের অন্যান্য কাজ শেষে কারখানায় ছোটেন তাঁরা। সকাল আটটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কারখানার কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করি মেশিনের মতো।
’
আঙ্গুরা বলেন, ‘সত্যি বলতে কী, আমার মন ভেঙে গেছে। এমন আর কখনো লাগেনি। শ্রমিকেরা যখন পুলিশের সাথে মারামারি করে, পুলিশ আমাদের ওপরে হামলা করে, স্থানীয় মাস্তানরা মারধর করে, আমার মনে চায়, পালিয়ে যাই। এখানে থাকব কী থাকব না, এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগি। মালিকেরা প্রায়ই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়।
পুলিশ টহল দেয়। ভয় হয়, যদি আমরা এসবের শিকার হই তবে কী হবে। পুলিশ যদি আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়? এসব কি মানা যায়? মনটা সব সময় খারাপ থাকে। ’
মোসাম্মত্ সামিরা খাতুন নামের আরেক শ্রমিক বলেন, গ্রামের মেয়েরা অনেক কষ্ট করে শহরে কাজ করেন। কারণ, তাঁরা নগদ আয় করতে পারেন।
শহরে কাজ করে নারীরা নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে পারেন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা বিষয়ে জানতে পারেন এবং বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানতে পারেন।
তবে সামিরা বলেন, ‘নারীরা তাঁদের কারখানার জন্য যা যা ত্যাগ করেছেন, কারখানা তার মূল্য দিতে পারছে না। ’ তিনি বলেন, ‘আমাদের টাকার দরকার, কিন্তু টাকাই সবকিছু নয়। ’।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।