অন্ধকার; মৃত নাসপাতিটির মতন নীরব'
ক্রিস্তফ কিয়েস্লোস্কির মুভিগুলো বেশির ভাগই নিরিক্ষণ টাইপ । সেখানে তিনি মানব জীবনের বা চরিত্রের কোন একটি দিক বা কোন একটি নিয়ম বা চিরন্তন সত্য নিয়ে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করেন, সেখানে কোন ম্যাসেজ প্রদানের চেয়ে সেই নিরিক্ষণের বিষয়টি মানুষের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে তা ইলাবোরেট করাই তার উদ্দেশ্য, সেখানে নিরিক্ষণের সাবজেক্টটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং উত্তর খুজে বের করার একটা প্রয়াশ পরিলক্ষিত হয়, দর্শকের নিজেকে প্রশ্ন করার একটা স্পেস বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায় । কিয়েস্লোস্কির মুভির অন্যতম বৈশিষ্ট্য মেকিংয়ে । প্রতিটি শট আলাদা ভাবে কথা বলে । তার মুভির চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সংলাপ, ক্যামেরার কাজ প্রায় সবকিছুতে অনেক অনেক যত্নের ছাপ পরিলক্ষিত হয় ।
মেটাফর, সুররিয়ালিজম আর এক্সপ্রেশনিজমের সার্থক ব্যবহার থাকে তার ফিল্মে । সারল্য তার মুভির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
টোমাকের মানবিক অনুভূতির ফ্রেমওয়ার্ক আর টোমাকের এই অনুভুতি মাগদাকে কতটা স্পর্ষ করে তার একটা অসাধারণ পরিবেশনা ‘অ্যা শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ ’ । সরলরৈখিক প্লেটোনিক ভালোবাসার গল্প । কিছু শ্লেষ, কিছু হিউমার, আর কিছু ড্রামার সমন্বয়ে এর সৃষ্টি ।
মানুষের ভালবাসা, কামনা, ভয়ারিষ্টিক অবচেতন আর সেক্সুয়াল প্যাশন- এই বিষয়গুলোর মাঝে ডিস্টেন্সটাও এখানে স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে ।
যে প্রশ্নটি মানুষকে সেই অনাদিকাল থেকে আলোড়িত, রোমাঞ্চিত করেছে সেটা হল নিখাদ রোমান্টিক ভালোবাসার আদৌ কোন অস্তিত্ব আছে কিনা যেখানে আকর্ষন এতটাই গভীর, বিশুদ্ধ ও অপাপবিদ্ধ যে যৌনতা সেখানে অযাচিত, অবাঞ্ছিত । ছিয়াশি মিনিট ধরে কিয়েস্লোস্কির এই প্রশ্নোত্তরের অনুসন্ধান করেছেন । তবে কিয়সলস্কি সুস্থির কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হয় নাই ।
সাধারনত মুভিতে ভয়ারিজম বা ঈক্ষণকামকে উপস্থাপন করা হয় একটা ডিটেকটিভ রোমাঞ্চ কিংবা সুরসুরি, সুখদায়ক উদ্দীপনার প্রতি আকর্ষন হিসাবে ।
কিন্তু এই মুভিতে কিয়েস্লোস্কি খুবই সাহসীকতার সাথে ঈক্ষণকামকে দেখিয়েছে একটা রোমান্টিক বিষয় হিসাবে যা লেন্সের সামনে গভীর পর্যবেক্ষনের সময় একটা ম্যাজিক্যাল বাতাবরনের সৃষ্টি করে । অবশ্য রোমান্টিক ভালবাসার ব্যাপারটা একটা রহস্য, ইলুশান হিসাবেই থেকে যায় । তাই প্রথাবদ্ধ সিনেমাটিক তত্ত্বগুলোকে টপকে মনস্তাত্বিক বাস্তবতার পরিপুর্নরুপ ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে হয়তো মুভিটিকে সম্পুর্ন ভাবে সফল বলা যায় না ।
বর্তমানে যদি কিয়েস্লোস্কি এই মুভিটা বানাতেন তাহলে হয়তো আমরা পোষ্টঅফিস কর্মী টোমাককে টেলিস্কোপের বদলে কম্পিটার নিয়ে সাইবার স্পেসে বিজি থাকতে দেখতাম । কিন্তু আশির দশকে শেষ দিকে বানানো এই মুভিতে উনিশ বছর বয়সি টোমাককে দেখানো হয়েছে একজন সামাজিক যোগাযোগ নিজেকে দুরে রাখা এক তরুন হিসাবে, রিয়ার উইন্ডোর জিমি স্টুয়ার্টের মত টোমাক এখানে তার সামনের ফ্লাটের সুন্দরী ও বয়সে বড় পরশি মাগদা কে শক্তিশালী দূরবীনে অনুসরন করে ।
গ্রাজুয়েট মুভিটাতে দেখানো হয়েছে ইরোটিক আডভেঞ্চার । আর এই গল্পের মুল থিম গ্রাজুয়েটের ঠিক উলটো । মুভির শুরুটা শেষ থেকে, আর গল্পের শুরু এভাবে...একজন চোর একটা স্কুলের জিমনেশিয়ামের কাঁচের দরজা ভেঙে বিজ্ঞানাগার থেকে একটা পোর্টেবল টেলিস্কোপ চুরি করে আনে । টোমাকই সেই চোর । একটা অরফানেজে বড় হওয়া টোমাকের বসবাস গডমাদারের সাথে ।
টোমাক শুদ্ধ ভালোবাসার কাঙাল । আর পেশায় শিল্পি মাগদার কাছে প্রেম পুরনো অনুভুতি এবং দেহজ ।
দিনের পর দিন দূরবীনে অনুসরন করে মাগদার বাড়ি ফিরার সময়টা টোমাকের নখদর্পনে । তাকে দেখার প্রত্যাশায় মেইলবক্সে ফেইক পোষ্টাল মানি অর্ডার পাঠায় কিংবা পার্টটাইমটার হিসাবে মিল্কম্যানের কাজ করে । মাগদার বয়ফ্রেন্ডের চিঠি চুরি করে ।
কথা শোনার জন্য বেনামে ফোন করে । গ্যাস লিকের মিথ্যে অযুহাতে রিপেয়ারম্যানকে মাগদার ফ্লাটে পাঠিয়ে তাদের অভিসারে বিঘ্ন ঘটায় ।
মাগদার আপার্টমেন্টে টেমাকের উপস্থিতি পর্যন্ত সব কিছুই ঘটছিল টোমাকের পার্স্পেক্টিভ থেকে । এর আগে দর্শক শুধুই টেমাকের টেলিস্কোপে মাগদার আপার্টমেন্টে দেখেছিল । টোমাক বেরিয়ে গেলে গল্প বলা শুরু হয় মাগদার পার্স্পেক্টিভ থেকে ।
এই বিশেষ পরিবর্তন চরিত্র দুটির বিকাশ আর উপলব্ধিতে সচ্ছতা প্রদান করে । এখানেই মুভির সবচেয়ে বড় টুইষ্ট । যখন ভয়ারিজম নিজেই ভয়ারে পরিনত হয় । যাকে ভালবাসে সে’ই হয়ে উঠে প্রনয়াকাংখী । মাগদা তার কৃতকর্মের জন্য তীব্র অনুশোচনা বোধ করে ।
টোমাকের নিষ্পাপতা, অপাপবিদ্ধতার প্রতি তার আকর্ষন সৃষ্টি হয় । শেষ দৃশ্যে আবার সামনে আসে টেলিস্কোপ । মাগদা টোমাকের ঘরে এসে তার দাদীর সঙ্গে কথা বলে সেই দূরবীনে চোখ রাখতেই তার নিজের জীবনের কয়েকটি ছবি তার সামনে ভেসে ওঠে । সেখানে মাগদা খুঁজে পায় নিজের প্রতিবিম্ব । সেখানে সে কল্পনা করে টেমাকের উপস্থিতি ।
দুধের বোতল হাতে লেগে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার পর স্বপ্নঘোরে মাগদা অনুভব করে টোমাকের সান্তনা । ছাদে উঠে কানের সাথে বরফকুচি স্পর্ষ করিয়ে রাখা আর পোষ্ট অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাগদাকে টোমাকের অনুসরনের দৃশ্যটা অসম্ভব টাচিং । আমার কাছে মনে হয়েছে পোষ্টঅফিস কর্মী টোমাকের চরিত্রের জন্য বেটার কোন অভিনেতাকে সিলেক্ট করা হলে, কিয়সলস্কির উদ্দেশ্য আর কৌশলের বাস্তবায়ন এবং নিরিক্ষণের রহস্যোদ্ঘাটন আরো সফল হত ।
টোমাকে সার্জিকাল ব্যান্ডেজ পরিহিত হাত, লাল কাপড়ে টেলিস্কোপ ঢেকে রাখা, সিরামিকের বাথটাবে পানিতে রক্ত ছড়িয়ে পড়া, মাগদার অ্যাপার্টমেন্টে সাথে লাল রঙে রঞ্জিত কাঁচের দেয়ার -এসব দৃশ্যে লাল আর সাদা আলো আর রংয়ের মিথস্ক্রিয়া ভালবাসা আর পরিশুদ্ধতার ভিজুয়াল সিম্বোলিজম উপস্থাপন করে । কিয়েস্লোস্কির Three Colors ট্রিয়োলজির হোয়াইট এর মত এই মুভিতে কিছু কমিক্যাল দৃশ্য রয়েছে ।
সাদা এখানে হোয়াইট মুভিটার equality থিমকেই সমর্থন করে । শেষ পর্যন্ত মাগদা আর টোমাক উভয়ই প্রতিকী equality তে পৌছে ।
“Thou shalt not commit adultery”
কিয়েস্লোস্কির দশ পর্বের ডেকালগ সিরিজের ষষ্ঠ পর্বের বিবর্ধিতরুপ পুনঃনির্মান এই মুভিটি । ডেকালগ সিরিজের প্রতিটি পর্ব Ten Commandments বা মুসা আঃ কে ইশ্বর প্রদও দশটি প্রত্যাদেশের উপর ভিত্তি করে নির্মিত । ‘অ্যা শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ’ এর অনুপ্রেরনা sixth commandment: “Thou shalt not commit adultery ” যা কিছুটা স্থুল এবং কাব্যিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ।
নায়িকার পরামর্শ অনুসারে The Decalogue – VI এর মুল স্ক্রিপ্টে সামান্য পরিবর্তন করে মুভিতে "fairytale ending" দেয়া হয়েছে । অবশ্য এভাবেও বলা যায় যে, সিনামাটাতে ইশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কটা প্যারাবলের মোড়কে উপস্থাপিত হয়েছে । টোমাক মাগদার জন্য এখানে ইশ্বরের বার্তা বাহক । বার্তা বাহক মাগদাকে অনৈতিক সম্পর্ক থেকে দূরে থেকে পরিপুর্ন জীবনযাপনে উদ্ভুদ্য করে ।
এক নজরেঃ
মুক্তি : ২১ অক্টোবর ১৯৮৮ (পোল্যান্ড)
দৈর্ঘ : ৮৬ মিনিট
দেশ : পোল্যান্ড
ভাষা : পোলিশ, পর্তুগীজ
পরিচালনা : Krzysztof Kieslowski
প্রযোজনা : Ryszard Chutkowski
চিত্রনাট্য : Krzysztof Piesiewicz , Krzysztof Kieślowski
অভিনয় : Grazyna Szapolowska , Olaf Lubaszenko
সঙ্গীত : Zbigniew Preisner
সম্পাদনা : Ewa Smal
অরজিনাল টাইটেল (পোলিশ) : Krótki film o milosci
অবশেষে মুভিটাকে টাচিং, মেলাঙ্কোলিক, মেনিংফুল, বিউটিফুল ট্যাগ গুলো দেয়া যেতে পারে ।
অবশ্যই উপভোগ করবেন এমন একটা মুভির রোষ্টারে রাখুন এই মুভিটাকে ।
টরেন্ট ডাউনলোড ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।