ইরফান হাবিব ওসামা বিন মহম্মদ বিন আবাদ বিন লাদেন। ওরফে শেখ ওসামা বিন লাদেন, ওরফে দ্য প্রিন্স, দ্য এম্পায়ার। জন্ম ১৯৫৭সালের ১০ই মার্চ, সৌদি আরবে। জেড্ডার ফয়জল বিশ্ববিদ্যালয় ও কিংস আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও লাদেন দীক্ষিত হয়েছিলেন উগ্রপন্থায়। ধর্মীয় মৌলবাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া ইসলামিক মৌলবাদের হাত ধরেই তাঁর বেড়ে ওঠা।
ঠিকাদারি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ওসামা বিন লাদেন পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে সরাসরি নেমে আসেন দুনিয়া কাঁপানো সন্ত্রাসের পথে। হয়ে ওঠেন হোয়াইট হাউসের ঘনিষ্ঠ।
এফ বি আইয়ের ‘টেন মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টের’ অন্যতম দাগী অপরাধী। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীর পরিচয় লাভের আগে পর্যন্ত ওসামা বিন লাদেন ছিলেন আমেরিকারই ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস, ১৯৭৯সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ফৌজ প্রবেশের সময়, আজকের এই ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ই ছিল হোয়াইট হাউস-সি আই এ’র তুরুপের তাস।
ভিডিও প্রমাণ বলছে, আটের দশকে লাদেনের যোদ্ধারা যে স্টিঞ্জার মিসাইল ব্যবহার করেছিল, তা সরবরাহ করা হয়েছিল খোদ ওয়াশিংটন থেকে। আফগানিস্তানে রুশ বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য তাঁকে প্রয়োজন ছিল মার্কিনীদের। তারাই প্রশিক্ষণ দিয়ে, সমর্থন দিয়ে তৈরি করে ‘ত্রাস’ নামক লাদেনকে। আটের দশকে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিন লাদেন ছিল একই মেরুতে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগন এই লাদেনকে পুষ্ট করতে সি আই এ-কে শুধু কোটি কোটি ডলার অস্ত্র সরবরাহের নির্দেশই দেননি, একইসঙ্গে তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধ এবং সোভিয়েত জেট বিমান নামাতে স্টিঞ্জার মিসাইল ব্যবহারের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মার্কিনীদের যাবতীয় হিসাব নিকাশের ছক যায় পালটে। আর এই লাদেনই যখন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠলেন, তখন পেন্টাগন মিসাইল আঘাত হানে খোস্টে, তাঁর বেস ক্যাম্পের ওপর। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা জানাচ্ছে, এই বেস ক্যাম্পটি লাদেন একসময় তৈরি করেছিল সি আই এ’র সাহায্য নিয়েই। মিত্র লাদেন পরিণত হন শত্রুতে।
লাদেন তখন যুবক।
উগ্র মৌলবাদের মোহে আচ্ছন্ন। প্যালেস্তিনীয় শিক্ষক শেখ আবদুল্লাহ আজম-ই’র হাত ধরে তাঁর আরব রাজনীতি ও ধর্মীয় আন্দোলনে প্রবেশ। ১৯৭৯সালে এই ‘সৌদি জিহাদি’ দেশ ছেড়ে চলে আসেন আফগানিস্তানে। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া কোটি কোটি ডলার ঢালেন ‘মকতব আল খিদমার’কে সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজে। ১৯৮৮সালে এই ‘মকতব আল খিদমার’-এর উগ্র সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে তৈরি করেন ‘আল কায়েদা’ যার সহজ বাংলা ‘ভিত্তি’।
১৯৭৯সালে আফগানিস্তানে মস্কোর বিশ্বস্ত বারবাক কায়মাল সরকারকে উৎখাত করতে আদাজল খেয়ে নেমেছিল আমেরিকা। সি আই এ-র ইতিহাসে সব থেকে বৃহত্তম চোরাগোপ্তা অপারেশন শুরু। আর সেই অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন লাদেন। সি আই এ এবং পাকিস্তানের আই এস আই-র প্রত্যক্ষ মদতে ‘আফগান জিহাদ’কে কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটন চেয়েছিল সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে। রেগনের সময়কালেই নয়া চোরাগোপ্তা অভিযানের শুরু।
সেইসঙ্গেই বেড়ে যায় আফগানিস্তানে অস্ত্র জোগানের পরিমাণ। এর মাঝেই সি আই এ, পেন্টাগনের কর্তারা পাকিস্তানে আসেন। রাওয়ালপিণ্ডিতে সি আই এ’র গোপন ডেরায়। তার আগেই অবশ্য পাক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হক আই এস আই প্রধানকে পাঠান মার্কিন মুলুকে। এবং অবশেষে চূড়ান্ত ব্লু প্রিন্ট ১৯৮৮তে।
জন্ম নেয় আল কায়েদা।
১৯৯০সালের ২রা আগস্ট সাদ্দাম কুয়েত আক্রমণ করলেন। ওসামা সেই সময় চিঠি লিখে জানান— কুয়েত মুক্ত করতে তিনি মুসলিম দুনিয়া থেকে এক লক্ষ মুজাহিদ-এর বাহিনী তৈরি করতে পারেন, এদের মধ্যে অনেকেই আফগান যুদ্ধের পোড়খাওয়া সৈনিক। তা না করে সৌদি সরকার যখন দেশ রক্ষা এবং কুয়েতকে মুক্ত করার জন্য মার্কিন বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানালো তখন ধাক্কা খায় ওসামা। লাদেন এরপর পাকাপাকিভাবে ফিরে আসেন আফগানিস্তানে।
যোগাযোগ হয় তালিবানদের সঙ্গে। তাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ইসলামী উগ্রপন্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যান তিনি। ২০০১সালে তোড়া বোড়া পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদীদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত বোমা হামলার সময় অল্পের জন্য বেঁচে যান লাদেন। তবে চোট পান। খুব সম্ভবত জওয়াহিরি, যিনি একজন পাস করা শল্য চিকিৎসক, তিনিই চিকিৎসা করেছিলেন লাদেনের।
সেই থেকেই লাদেনের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে জাওয়াহিরি। শোনা কথা, ২০০১সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার অনুমোদন দেন লাদেন। ঐ হামলায় প্রায় ৩হাজার মানুষ নিহত হন।
পাকিস্তানে স্থানীয় সময় তখন রাত ১টা। ইসলামাবাদ থেকে ১৫০কিলোমিটার উত্তরে অ্যাবটাবাদের আকাশে হঠাৎই হেলিকপ্টারের শব্দ।
সেনা-শহর অ্যাবটাবাদ তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। অমাবস্যার সেই রাতে ঐ হেলিকপ্টার থেকে ওয়াজিরিস্তান হাভেলিতে নেমে আসে একদল সেনা। শুরু হয়ে যায় গুলির লড়াই। হাজার মাইল দূরে হোয়াইট হাউসের কর্তাব্যক্তিরা তখন শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় বসে। এরপর কী ঘটেছে তা বিশ্ববাসী জানে।
কিন্তু কারা তারা? যার নাগাল পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, সেই আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে মাত্র ৪০মিনিটের মধ্যে হত্যা করে তাঁর লাশ নিয়ে চলে গেল? এরা আমেরিকার বিশেষ কামান্ডো বাহিনী ‘সিলস’।
আফগানিস্তানের পাহাড়ী গুহা তোরা বোরায় একবার আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হাতের মুঠোয় পেয়েছিল মার্কিন বাহিনী। আকাশে হামলা চালিয়ে মাটিতে সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করে আমেরিকান স্পেশাল ফোর্স, কিন্তু সেবার কাজের কাজ হয়নি। লাদেন বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের পালটা হামলার মুখে সেবার মার্কিনী সেনাদের রণেভঙ্গ দিতে হয়েছিল। কিন্তু গত রবিবার রাতে সেই অসমাপ্ত কাজকেই সেরেছে আমেরিকার ‘নেভি সিলস’ কমান্ডোরা।
বলা হয়ে থাকে, অপ্রচলিত বা ‘আনকনভেনশনাল ওয়ারফেয়ারে’ এদের জুড়ি নেই।
ষাটের দশকে আমেরিকান নেভাল স্পেশাল ওয়ারফেয়ার কমান্ডের অধীনে ‘নেভি সিলস’র যাত্রা শুরু। মার্কিন নৌ-বাহিনীর অধীনে হলেও রণাঙ্গনে এই বাহিনী জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশনস্ কমান্ডের হয়ে কাজ করে। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ নামটার মধ্যেই সি, এয়ার, ল্যান্ডের কথাটা রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার করোনাডোতে এই বাহিনীর সদর দপ্তর।
‘হিট অ্যান্ড রান’-এ এদের মতো দক্ষ যোদ্ধা খুব কমই আছে। সাধারণত মেরিন্স অ্যাম্ফিবিয়াস গ্রুপ অপারেশন চালায়। ‘নেভি সিলস’-কে কোনো প্রচলিত যুদ্ধে ব্যবহার করা হয় না।
লেবাননে আক্রমণ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, আফগানিস্তানে আগ্রাসন, ইরাকে হানাদারি এমনকি বসনিয়া, সোমালিয়াতেও তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। পাকিস্তানে লাদেন অভিযানে ‘সিলস’ ব্যবহার করেছে চিনুক হেলিকপ্টার।
এ ধরনের কপ্টারকে বলে হেভি লিস্ট কপ্টার। শোনা যাচ্ছে, এম এইচ ৬০ কপ্টারও ব্যবহার করা হয়েছে। এম এইচ আসলে গানশিপ। পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে সেটাই হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের ঘোষণায় তামাম দুনিয়া জেনে গেছে, লাদেন মৃত।
তাসত্ত্বেও রহস্যের জালে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু। ‘অপারেশন জেরোনিমো’— মাত্র ৪০মিনিটের এই অভিযানে মার্কিন কমান্ডোরা লাদেনকে শুধু খতমই করেনি, তুলে নিয়ে গেছে তাঁর মৃতদেহও। পাকিস্তানের সেনা শহর অ্যাবটাবাদে পাক বাহিনীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে কীভাবে কপ্টার নিয়ে অভিযান চালালো মার্কিন সেনারা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ কি সেই বাড়িতে লাদেন ছিল? যদি লাদেন মার্কিন সেনাদের গুলিতে মারা গিয়েই থাকেন, তাহলে তাঁর মৃতদেহ তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেলার দরকার কী ছিল? মরদেহ সরানো যখন হলো, তা সমুদ্রে ফেলা হলো কেন? কেন ছবি তোলা হলো না, যদি ছবি তোলা হয়েই থাকে তাহলে তা প্রকাশ করলো না কেন আমেরিকা? কেনই বা প্রমাণ লোপাট করলো? এই প্রশ্নমালাই এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে মার্কিন প্রশাসনকে। হোয়াইট হাউস এখনও একটি প্রশ্নেরও সদুত্তর দিতে পারেনি।
প্রশ্ন উঠেছে, এই অভিযানের সত্যতা নিয়েও। লাদেন ও তাঁর পরিবার ওয়াজিরিস্তান হাভেলিতে আদৌ থাকতো কিনা তা নিয়ে ধন্ধে রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দারাও কেউই নিশ্চিত নন। তাছাড়া পাক বাহিনীর নজর এড়িয়ে অ্যাবটাবাদে লাদেন এলেনই বা কী করে, সেই প্রশ্নই তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
প্রশ্নবাণে এখন জর্জরিত আমেরিকা ফের হুমকি দিয়েছে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় এভাবেই হামলা চালানো হবে।
প্রয়োজনে পাকিস্তানে আবারও আক্রমণ শানানো হতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার প্রচার সচিব জে কারনি এই হুমকি দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীরা পাকিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করছে। ইসলামাবাদকে এব্যাপারে অনেক আগেই সতর্ক করা হয়েছে। তাসত্ত্বেও তারা দেশকে সন্ত্রাসবাদ মুক্ত করতে পারেনি। ভবিষ্যতে যদি পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে প্রয়োজনে সেখানে ফের আক্রমণ চালাবে আমেরিকা।
এই সতর্কবাণী আখেরে মার্কিন-পাক সম্পর্কেরই অবণতি ঘটাবে।
আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যার ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে তালিবানের পাকিস্তান শাখা। তাদের হুঙ্কার, ‘বদলা’ নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে তালিবানরা। তাদের নিশানায় রয়েছে যেমন মার্কিন দপ্তর, তেমনই লক্ষ্যবস্তু হতে পারে পাকিস্তানের যে কোনো শহর।
মার্কিন ঘোষণায় লাদেন মৃত, তবে সন্ত্রাসবাদ কিন্তু বেঁচে আছে।
ফলে লড়াইও অব্যাহত।
=== সংগ্রহিত=== ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।