আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেপালী বালক কাঞ্চার কথা আজো ভুলিনি

অযথা ঝগড়া বিবাদ ভাল লাগে না। শিক্ষা বলতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। সু শিক্ষা চাই সর্বত্র। ১৯৭১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি বোন-জামাইবাবুর সাথে ওপার ( ভারত) চলে গিয়েছিল শিক্ষক ও সাংবাদিক রণজিৎ মোদক। তার মুখ থেকে শুনা সে সময়ের কিছু কথা।

খালাত ভাই নৃপেন্দ ও ফুপাত ভাই আদিনাথ তালুকদারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে মারে পাকিস্তানী মিলিটারী। এরপর সিদ্ধান্ত নেই দেশ ছাড়ার। রাতের বেলায় রুস্তম বেপারীর নৌকাযোগে যমুনা পাড়ি দেয়া ছিল অনেকটা চুপিসারি। সঙ্গী ছিল বোন জামাই মনীন্দ্র মোহন তালকুদার, বোন যোগমায়া , ছোট ভাগ্নে জীবন, এ ছাড়া পড়শী বিধু ভূষন মোদক, তার স্ত্রী, তার বোন রেবা, কাকাত ভাই কালা চান মোদক। যাকে সবাই বুলকু বলে ডাকতাম।

নৌকায় চেনা অচেনা আরো কয়েকজন ছিল। কাশ ফুলের বাগানের ভেতর দিয়ে নৌকা চলছিল ধীরলয়ে। মাঝে মধ্যে পাক মিলিটারীদের জাহাজ থেকে সার্চ লাইটের আলো দেখলে ধরপড় করে উঠত বুক। আমাদের নৌকায় আলো জ্বালানো ছিল নিষেধ। রান্নাবান্না করার কথাতো ভাবতেই পারিনি।

৩/৪ রাত যমুনা পাড়ি দিয়ে আমরা পৌছি আসামের মানিকাচরে। সেখানে ৬/৭ মাস ছিলাম মুজিবর রহমান নামক এক ভদ্র লোকের বাড়ি। তার ভিটে ভাড়া করে খুপরি ঘরে কাটিয়ে দেই ও কটা মাস। মানিকারচর বাজারের পাশে একটি সিনেমা হল ছিল। তার পাশে একটি চায়ের দোকানে চা খেতে যেতাম, জয় বাংলা পত্রিকা কিনে পড়তাম।

আর প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের খবর নিতাম। সেই চা'য়ের দোকানের বয় ছিল , যার নাম কাঞ্চা। নেপালী ওই ছেলেটির সাথে অল্প দিনেই ভাব হয়ে যায়। নেপাল আমার মামা থাকে এ শুনে সেও আমাকে মামা বলে সম্বোধন করে। মামার আগে লাগিয়ে দেয় ‌‌' জয় বাংলা মামা'।

প্রতিদিন চা খেতে গেলে ওর সাথে নানা কথা হত আমাদের। ওর কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে এই বালকটির সমর্থন আছে। নভেম্বরের শেষের দিকে আমার বড় ভাই অমৃত লাল মোদকের বন্ধু মাজহারুল ইসলাম তালুকদারের ছোট ভাই আজহারুল ইসলাম তালুকদার মজনুর সাথে দেখা হয়। এরপর থেকে সে আমার সাথে ওই হোটেলে নিয়মিত চা খাওয়ায়ার সঙ্গী হয়। খুপরি ঘরে থাকতে আমাদের তেমনি আপত্তি ছিল না।

তবে শীতের তীব্রতায় ঘুমুতে পারিনি এক রাতও। মুলি বাশের চাল দিয়ে শিশির জল পড়তো শরীরে। প্রচন্ড শীত থাকায় গায়ের কাথাগুলো মনে হত বরফের টুকরো। শীতে আমাদের কষ্ট দেখে মজনু ভাই সু্য়েটার কিনে দিয়েছিল। ভোরে উঠে প্রতিদিন নদীর পাড়ে যাওয়া ছিল রুটিরমাফিক কাজ।

দেশ থেকে কে এল তার খোঁজ নিতাম। প্রতি সপ্তাহে রেশন তুলতে যেতাম বাজারের পাশে। ভোর থেকে শুরু হত লাইন। রেশনের চাল,ডাল,চিনি- অন্য আরো পণ্য দিয়ে চলত আমাদের ভোজন। খাওয়া দাওয়া, চা পান, কথা -বার্তা সব কাজেই আমাদের চিন্তা ছিল দেশ নিয়ে।

যুদ্ধের কি অবস্থা। দেশে ফিরতে পারবো কি না , তা নিয়ে। অবশেষে এল সেই দিন। দেশ স্বাধীন হল। ফিরতে হবে স্বভূমিতে।

তবে কিছুদিন এখানে বাস করায় একটা মায়া জন্মে গেছে। কারো সাথে হয়ে গেছে আত্মার খাতির। নেপালী হোটেল বয় কাঞ্চার কথা এখনো মনে। বিদায় নিয়ে আমরা যখন দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন সে কি কান্না আমাকে জড়িয়ে। বালক কাঞ্চা এত অল্প সময়ে আমাকে ওর আপন মামার স্থলে জায়গা দিয়েছিল তা বুঝতে পারিনি।

বিদায় বেলায় ওর কান্না দেখে তা অনুধাবন করি। ও আমাদের একটি রুমাল ও একটি লাঠি উপহার দিয়েছিল। অনেকদিন তা আগলে রেখেছিলাম। অজান্তে এক সময় ওর উপহার হারিয়ে যায়। তবে হৃদয় থেকে কাঞ্চার নাম এখনো মুছে যায়নি।

মনে পড়ে মাঝে মধ্যই। তখন হারিয়ে যাই সেই দিনে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।