বাঙলা কবিতা হাড়কা বাহাদুর / দিনেশ অধিকারী (নেপাল)
-----------------------------
অনেক নামে সুবিদিত সে
ওরা তাকে "হাড্ডু" বলে ডাকে। ওরা বলে, আসলে সে
অস্থিচর্মসার। এ তল্লাটে তার চেয়ে কালো কেউ নাই
নিজের আসল নামটা শুনতে, তাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়
বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর উৎসব অব্দি
তার নাম হাড়কা বাহাদুর
অর্জুনের চেয়ে কম পরিশ্রমী নয়
খুব ভোরে ষাঁড় দুটোর কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে দেয়
কখনও ঊষর জমি চাষতে যায়
কখনও, মাটি কোপানোর সময় বুঝে,
কোদাল কাঁধে পৌঁছে যায়, ক্ষেতগুলোর কোণায় কোণায়
আর রোপা লাগানোর সময় হলে, কাদা করে জমি
সফল এক দূরদর্শীও সে
জানে পোষাক সর্বদা কাজে লাগে না, সারাক্ষণ
পোষাক পরে চামড়া ফাটানোর দরকার নেই
খোলা কাঁধেই বয়ে নেয় ভার
খোলা নিতম্বেই চাষ করে জমি
আর হ্যাঁ, যখন গ্রামীন কৃষক-সভায় যায়
হাড়কা বাহাদুর, সন্তর্পণে, একবার পতাকা আর একবার
নিজের উন্মুক্ত পাছাটা দেখে নেয়। হয়তো বা মনে মনেই হাসে
উচ্চস্বরে, হয়তো কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের মতই
এগিয়ে নেয় তার ভাবনাকে
ভাবে, মানুষের কাজেই যদি আসে না, কী আর
উপযোগিতা এই বস্ত্রখণ্ডের। তা হলে,
দুনিয়ার সবগুলো পতাকা জড়ো করে
যদি সেলাই দেয়া যেতো, প্রত্যেক উদোম-পাছা-মানুষ
হয়তো ভাগ পেতো এর...
প্রত্যেকেই পেতো একটা রঙিন ফতুয়া
প্রত্যেকেই পেতো একটা রঙিন গামছা
একটা পতাকা__ মানুষের পরিচিতি নয়,
মানুষ তো নিজেই এক সুবিদিত ইতিহাস,
মানুষ নিজেই একটা সুচিহ্নিত আকাশ,
হাড়কা বাহাদুর জানে না, কত বছর ধরে বেঁচে আছে সে:
তারিখ, দিন, মাস, ঋতু, বছর এবং
সে, এমনকী, চান্দ্রপঞ্জিকারও হিসাব রাখে না
সময়কে, হয়তো, উপভোগ করে সাপেরাই
যারা নিজেদের লেজ নিজেরাই গিলে খায়; সময়কে, হয়তো
উপভোগ করে সেই কারখানাগুলো, যেগুলো অস্ত্র বানায়।
একটা উড়োজাহাজ,
সাইরেন, ওরাই উপভোগ করে সময়।
এমনকী, আজকের এই দিনটি পর্যন্ত সময়কে উপভোগ করেনি সে
কোনওদিন জানতেও চায়নি, কটা বাজে এখন
সময়ের নামে, যখনই উদযাপন করতে চেয়েছে ...
অসুর মহিষাসুরের চাটি খেয়েছে সে,
যখন চাইতে হয়েছে--- সে চেয়েছে খাদ্যশস্য,
চেয়েছে তুলার বস্তা, বাগান করার মত এক টুকরো জমি
বলেছে__যে সব হাত অস্ত্র বহন করে,
তাদের সবার হাতে কোদাল তুলে দেয়া উচিত
হাড়কা বাহাদুর একটা ক্ষুধার নাম__
ক্ষুধার কোনও দেশ ও পোশাকাদি থাকে না
ক্ষুধা কোনও আত্মীয় বা আগন্তুক পথচারী চেনে না।
হাড়কা বাহাদুর সেই জন, যে আপন মনেই তিড়িং বিড়িং ছোটে
যন্ত্রণাকে কোনও আকার-আকৃতিতে বাঁধা যায় না,
বেদনার নেই কোনও সীমান্ত বা ঘরদোর
সত্যটাই বলছি আমি---- ক্ষুধা যদি কোনও দেশ হয়,
হাড়কা বাহাদুরের চেয়ে আদিমতম কোনও দেশ আর হয় না;
যদি দুঃখ কোনও রাষ্ট্র হয়, হাড়কা বাহাদুরের চেয়ে বিশালায়তন
আর কোনও রাষ্ট্র থাকতে পারে না কোথাও
জাতীয়তা! জাতীয়তা! জাতীয়তা!
স্বাধীনতা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!
নাগরিকত্ব! নাগরিকত্ব! নাগরিকত্ব!
গেল বছরের আগের বার, যখন তার সাত বছরের কন্যাটি
মরে গেল সর্প-দংশনে, জাতীয়তা
কোথায় অনুদিত হলো__ওষুধে?
গত বছর, দুর্ভিক্ষের দুঃসহ দিনগুলোতে, যখন তার ছেলেটি
উধাও হয়ে চলে গেল অজানার দিকে!
স্বাধীনতা কি বলতে পেরেছিলো : 'যেও না'!
এ বছর বন্যায়, যখন যখন সমগ্র গ্রামটা তলিয়ে গেল,
কোথায়! নাগরিকত্ব কি দাঁড়াতে পারলো একটা ঘর হয়ে?
এই সব ব্যতিরেকে! বিনিময়ে অন্য কিছু দিতে চাওয়া তো অর্থহীন
জাতীয়তা, একটা বিজ্ঞাপন; স্বাধীনতা___ বিজ্ঞাপন;
নাগরিকত্ব__ বিজ্ঞাপন। হাড়কা বাহাদুরের কাছে
হুকার কলকিতে সাজানো তামাকের চেয়ে
এসবের মূল্য সামান্যই। সেই তামাক-গুঁড়োই তো জোটাতে পারছে না
হাড়কা বাহাদুর, শুধু একটা টান দেবার মত তামাও নয়
আমি বলছি তোমাদের, হাড়কা বাহাদুরের কোনও দেশ নেই
হাড়কা বাহাদুর কেবলই এই হরিয়ন গ্রামের বাসিন্দা নয়
তাকে দেখতে পাওয়া যাবে, তোমাদের ওইসব গ্রামে, শহরে এবং দেশেও
জিৎ বাহাদুরই হাড়কা বাহাদুর, যেমন এই ভীম প্রসাদও
হাড়কা বাহাদুর; এরাই একলব্যের অধুনা উত্থান
আমি স্যালুট জানাই তাকে!
শিশুদের জন্য কাপড় জোটানো তারই মাথা ব্যথা;
নিজের বুকে সে লটকিয়ে রাখে তার নিজস্ব শহীদের ছবি
আমার মায়ের কোল থেকে উৎসারিত
এই স্যালুট, আমি জানাতে চাই হাড়কা বাহাদুরের উদ্দেশ্যে
স্যালুট তাকে!
মানুষের পাঁজর ভেঙে বানানো ওই দাঁত মাঞ্জনি দাঁতে লাগায় না সে
মানুষের বিচূর্ণিত হাড়ে তৈরি ওই টুথপেস্টও না
আমার এই কবিতা থেকে উৎসারিত স্যালুট আমি তুলে ধরছি
হাড়কা বাহাদুরের উদ্দেশ্যে।
--------------------------
দিনেশ অধিকারী (১৯৫৯-) :
সুপরিচিত কবি ও সংগীত রচয়িতা। জন্ম নেপালের কাঠমাণ্ডুতে।
------------------------- ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।