আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে একটি বিকালঃ শিখলাম অনেক কিছু

ছোট বেলায় শখ বলতে কি যখনই লিখতে হতো তখন নিঃদ্বিধায় লিখে ফেলতাম বই পড়া আর ভ্রমন করা। দেখতে দেখতে ঘুরে ফেললাম দেশের ভ্রমন পিয়াসুদের জন্য দর্শনীয় স্থানগুলোর প্রায় সবগুলোই দেখে ফেলেছি। এবার সকল জনপদে যাওয়ার পালা। গত দুইদিন আগে মঞ্জু (কাছের ছোট ভাই) বললো ওরা প্রায় ১৫ জন যাবে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে আর যাবে ভৈরব ব্রীজ দর্শনে। ওদের এক ফেন্ডের বাসা ও স্টেশনের কোয়ার্টারে, তার বাবা স্টেশনে চাকরী করে।

তাদের বাসায় দাওয়াত খাওয়া , পাওয়ার হাউজ দেখা আর ব্রীজ দেখা একসাথেই "রথ দেখা আর কলা বেচা"র মতো হয়ে যাবে। অফারটা পেয়ে হাতছাড়া করা এক ধরনের বোকামী। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, সব ঠিক থাকলে যাবো, ইনশাআল্লাহ। সকাল ১১ টা ভৈরবের উদ্দেশ্যেঃ মঞ্জু ও তার ফেন্ডরা ১৭ জন সকালেই ট্রেনে যাত্রা করেছে আশুগঞ্জের উদ্দেশ্যে । আর সকালে হাতের কিছু কাজ সেড়ে ধীরে সুস্থে রওয়ানা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

অগ্রবর্তী মূল দল যখন ভৈরব ব্রীজ দর্শনে ব্যস্ত তখন আমাদের পশ্চাত দলের ৪ জন সহ চললাম সকাল ১১ টায় মহাখালীর উদ্দেশ্যে । বাসষ্টান্ডে কিছুক্ষন এদিন সেদিক ঘুরাঘুরি করে বাদশা পরিবহনে চেপে বসলাম। ভৈরব বা আশুগঞ্জের পথে যাওয়া আসা হয়েছে অনেকবার কিন্তু কখনো নামা হয়নি বলেই কিছুটা দিকভ্রান্তি। । ১১.৪৫ বাস ছেড়ে টঙ্গী হয়ে ঢাকা ছাড়তেই ১ টা বেজে গেলো।

পুবাইল যেতেই ঝুম বৃষ্টি। পুবাইল , কালিগঞ্জ হয়ে একেবারে নরসিংদীর আগে পর্যন্ত বৃষ্টির অপরূপ মাদকতা অজানায় হারিয়ে দিচ্ছিল বারে বারে। গাড়ীর জানালায় বৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য্য ৩.৩০ টা, ভৈরব স্টেশনঃ ঐ রাস্তার বাদশা নামক ভুয়া পরিবহনে (নামে বাদশা হলেও গাড়ীতে উঠে বুঝলাম কেন ভুয়া) যখন ভৈরবে পৌছলো তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল । সময় ঘড়ি ৩.৩০ টার জানান দিলো। বাদশা আর সামনে যাবে না অতএব ধরলাম সিএনজি।

পথে ভৈরব ব্রীজে কয়েকটি ফটোসেশন করে সোজা চলে গেলাম স্টেশন কোয়ার্টারে। ৪.১৫ টা, পাওয়ার স্টেশন গেটঃ সাইনবোর্ড কি বলে? সকালের নাস্তা দেহগাড়ীটাকে আর টানতে পারছিলো না তাই মঞ্জুর ফেন্ডের বাসায় গিয়ে কিছু পাওয়ার সংগ্রহ করে পাওয়ার স্টেশনের দিকে একপ্রকার দৌড় দিলাম। মঞ্জুর ফেন্ডের বাবা মানে আঙ্কেল স্টেশনে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে রেখেছে কিন্তু ৪.০০ টার প্রবেশ করতে হবে। স্টেশনের সামনে গিয়ে পৌছতে ৪.১৫ বেজে গেলো। ভিতরে ঢুকতে পারবো কি পারবো না সন্দেহের দোলাচালে পড়লাম ।

নাহ.... আঙ্কেলের কারণে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। আমাদের পশ্চাত দল সহ ২১ জনের ছোটখাটো বিশাল বাহিনী হালকা চেকিং এর পর প্রবেশ করলাম কিন্তু ক্যামেরাটাগুলো ব্যাগে ঢুকানো ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। সেফটি ফাস্ট পাওয়ার স্টেশনের অভ্যন্তরেঃ আমাদের দলনেতা এবার আঙ্কেল । তার পিছুপিছু মৌন মিছিলের মতো হেটে চলছি আর চারপাশ দেখছি, বিভিন্ন কিছু সম্পর্কে অবহত হচ্ছি। মৌন মিছিল চুপচাপ হাঁটলেও আমাদের সবাই চুপচাপ না।

আঙ্কেল শিখাচ্ছেন আর আমরা শিখছি। এটা ওয়েল ট্যাংকার , এটা গ্যাস চালিত উৎপাদন কেন্দ্র , এটা প্রশাসনিক ভবন , এটা বয়লার এরকম করে একে একে সব কিছু। গেট পেরুলেই ছোট একটি স্টীম টারবাইনার রেন্টাল স্টেশন। এখানে রয়েছে একটি ইউনিট। অতপর সোজা গিয়েই ডান পাশে বিশাল ওয়েল ট্যাংকার।

এই বিশাল ওয়েল ট্যাংকারটি তৈরী করার উদ্দেশ্য হলো যদি কখনো পাওয়ারে সমস্যা হয় তাহলে তৈলের মাধ্যমে যাদে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় সেজন্য। যদিও এখন এর প্রয়োজন পড়ে না । পাশাপাশি দুটি ওয়েল ট্যাংকার ওয়েল ট্যাংকারের পাশেই রয়েছে গ্যাস গ্যাস ষ্টেশন। গ্যাস স্টেশনে রয়েছে আরো দুটি ইউনিট। আমাদের আঙ্কেল যেহেতু কাজ করেন পাওয়ার স্টেশনে তাই গ্যাস ষ্টেশনে ঢুকতে পারলাম না।

গ্যাস স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে জেনে নিলাম টুকিটাকি। এখানে ২টি ইউনিটে ১১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। অন্য ইউনিটগুলোতে পানি থেকে শক্তি তৈরী করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় আর এ ইউনিট দুটিতে করা হয় গ্যাস থেকে শক্তি উৎপাদনের কাজ। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনঃ সংক্ষিপ্ত সময়ে যা শিখলাম তাহলো , গ্যাস থেকে শক্তি উৎপাদন করা তুলনামুলক সহজ। যেহেতু গ্যাস এক প্রকার শক্তি সেহেতু গ্যাসকে পরিশোধন করে শক্তি উৎপাদনের কাজে লাগানো হয় সেখান থেকে উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ।

গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ হলেও ব্যয়বহুল। প্রয়োজনীয় গ্যাস না থাকলে তা উৎপাদন সম্ভব নয়। গ্যাস চালিত স্টেশন* বাংলাদেশে ব্যবহৃত তিন পদ্ধতি হলোঃ ১. তাপ বিদ্যুৎ ২. পানি বিদ্যুৎ ৩. গ্যাস বিদ্যুৎ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রেঃ গ্যাস কেন্দ্রে প্রবেশ না করে স্টেশনের চওড়া রাস্তা ধরে প্রবেশ করলাম তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে। প্রশাসনিক ভবন পার হয়ে সামনে গেলেই তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রথম বয়লারটি। দেশের প্রথম তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৬ সালে এই মেঘনার পাড়ে আশুগঞ্জে।

১৯৭০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত তাপ উৎপাদন করে যাচ্ছে বিদ্যুতের জন্য। প্রশাসনিক ভবনসহ আশেপাশের জানালাগুলো দিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ ঘুরে তাকাচ্ছেন কারা আমরা??? কেহ আবার মটর সাইকেলের হর্ন বাজাচ্ছেন আর আমাদের দেখছেন। আঙ্কেল পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন , এরা আমার ছেলের সাথে পড়ে। রেলের পাত বসানো রাস্তা পথে চলতে চলতে দেখলাম রেলের পাত বিছানো লম্বা পথ। এর মাধ্যমে ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনের কাজ চলে।

মাঝে রয়েছে গোলাকার একটি ট্রানজিট স্থান। এই মাঝখানে এসে ডানে বামে বা যেদিকে যন্ত্রগুলো যাবে সেদিকে দিক পরিবর্তন করা হয়। ষ্টেশনের প্রাচীরের বাহিরে মেঘনার তীরে রয়েছে রয়েছে বিশাল ক্রেন। এ ক্রেনের সাহায্যে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত যন্ত্রপাতি জাহাজ থেকে উত্তোলণ করা হয়। এই পথকেই ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে গত বছর ভারতের পূর্ব দিকের রাজ্যগুলোতে বিদ্যুতের ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া হয়।

তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে আটকানোর কারনে যার ব্যাপারে সারা দেশে তোলপাড় ফেলেছিলো। ট্রানজিট বলতে পারেন দানবীয় ক্রেন পানি ফিল্টারিং এর প্রথম দুটি স্তরঃ পাম্পের মাধ্যমে পানি প্রথমে এখানে আসে প্রথমে আঙ্কেল দেখালেন মেঘনা থেকে পাম্পের মাধ্যমে হাউজে এসে পানি জমা হয়। এ হাউজের পানি প্রক্রিয়াজাত করেই শক্তি উৎপাদন করা হয়। প্রথম ছাকনিতে পানিতে যেসব ময়লা আবর্জনা , পদার্থ থাকে যেমন গাছ, মাছ সহ যাবতীয় কিছু। এ ছাকনিতে মাঝে মাঝেই নাকি বড় বড় মাছ, গাছের পাশাপাশি মানুষ , নৌকা ইত্যাদিও পাওয়া যায়।

পানির টানে পাম্পের মাধ্যমে চলে আসে এখানে। যন্ত্রে মাধ্যমে এগুলো পরিস্কার করা হয়। এ যন্ত্রে মাধ্যমে বড় পদার্থ উপরে টেনে তোলা হয় ২য় স্তরটি হলো ফিটকারী দিয়ে ফিল্টারিং । প্রথম স্তরে ফিল্টারিং এর পর পানির মাঝে যেসব কাদা মাটি বা পদার্থ থাকে তা ফিটকারীর মাধ্যমে নিজে পড়ে যায় আর ফিল্টারিং করে পরিস্কার করে ভালো পানি পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিল্টারিং এ ব্যবহৃত স্থান ভিতরে মাছ দেখা যাচ্ছে ক্লীন ওয়াটার ফিল্টারঃ ২য় স্তর দেখে চলে গেলাম ৩য় স্তরে।

২য় স্তরে থেকে পানি মজুত হয় বিশাল বিশাল পানির ট্যাংক এ। এখান থেকে পানিকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্লীন ওয়াটার ফিল্টারে। বিশুদ্ধ পানি তথা H2O তৈরীর জন্য মজুতকৃত পানি খাবার পানি যেভাবে ফিল্টারিং হয় সেভাবে কয়লা, বালু, পাথর দ্বারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে পুনরায় ফিল্টারিং করার হয়। আঙ্কেল এ পযার্য়ে এসে আমাদের সকলকে কাগজে কলমে ছবি এঁকে একসাথে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন। পানি মজুদের ড্রাম ইনহেরিট্যান্ট ফিল্টাল /স্টুবেন ফিল্টারঃ (নামে ভুল থাকতে পারে) ক্লীন ওয়াটার ট্যাংক ফিল্টারিং এর ঘর থেকে ক্লীন ওয়াটার ফিল্টার দেখে বের হয়ে পানির আভ্যন্তরীন সাবটেন্স দূর করার জন্য ব্যবহৃত ফিল্টার দেখতে বের হয়ে আসলাম ।

পানির অভ্যন্তরে দুই ধরনের পদার্থ থাকে । ধাতব ও অধাতব এ দুই ধরনের পদার্থকে স্টুবেন ফিল্টারে পরিশোধন করার পর ট্যাংকে জমা করা হয়। ট্যাংকের উপরে পানির তিনটি স্তর থাকে। পরিশোধনের কাজ চলছে এর প্রতিটি স্তরে। এখানে পরিশোধন শেষ করে তৈরী করা হয় বিশুদ্ধ পানি।

অর্থাৎ H2O । আসলে এই পাওয়ার প্লান্টের মূল কাজই হলো বিশুদ্ধ পানি তৈরী করা। বিশুদ্ধ পানি তৈরীর প্রক্রিয়া বিশুদ্ধ পানি কেন তৈরী করা হয়ঃ আমরা জানতে চাইলাম কেন বিশুদ্ধ পানি তৈরী করা হয়? পরিশোধন ছাড়া কি তাপ উৎপাদন করা যায় না? জানতে পারলাম আঙ্কেলের কাছে...... হ্যা, বিশুদ্ধ পানি ছাড়াও টারবাইন ঘুরানো যাবে বা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে কিন্তু সমস্যা হলো, পরিশোধিত পানি না ব্যবহার করলে পানির যে শক্তি তা সঠিক ভাবে পাওয়া যাবে না, ফলে উৎপাদন কম হবে। এখানে আরো বিষয় হলো পানি পরিশোধিত না হলে যন্ত্র খুব দ্রুত ড্যামেজ হয়ে যাবে । ১৯৭০ থেকে এ কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছে , বিশুদ্ধ পানি না হলে তা সম্ভব ছিলো না।

উৎপাদন কেন্দ্রের বিশাল হাউজ কন্ট্রোল হাউজঃ একটি বয়লার বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ প্রক্রিয়া দর্শন শেষ করে পাওয়ার হাউজের মূল স্থান কন্ট্রোল হাউজের দিকে চললো আমাদের বিশাল দল। আঙ্কেল বুঝিয়ে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন আর আমরা সকলে চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে রেখে চলছি । প্রায় সাত তলা উচ্চতা সমান বিশাল বয়লারের নিচে দাড়িয়ে মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারের জ্ঞান দেখে অবাকই লাগলো। ষ্টীল আর লোহা লক্করের উপরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল স্থাপনাটি। আঙ্কেলের সাথে সাথে সকলে প্রবেশ করলাম কন্ট্রোল হাউজে।

বয়লার* ছোটখাটো কীর্ষকায় একজন মুরুব্বী কন্ট্রোল প্যানেলে বসে আসেন। আমাদের দেখে প্রথমে অবাক হলেন পরে পরিচয় জেনে উৎসাহী হয়ে একে একে দীর্ঘসময় নিয়ে সব বুঝিয়ে দিলেন। তিনি যখন জব শুরু করেছেন তার একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন মাত্র ইন্টার পাশ , সাদা দাড়ি গোফ আর চশমায় তিনি এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত। কিন্তু অভিজ্ঞতার প্রলেপে তার প্রতিটি কথা আবৃত। প্রায় ৬ ফুট লম্বা প্যানেলে অসংখ্য ছোট ছোট আলো জ্বলছে।

এগুলোতে কাজ খুব বেশী না। অত্যাধুনিক এ প্যানেলে বসে থেকে নজর রাখলেই হয়। পুরো প্যানেলে পাওয়ার প্লান্টের সকল কিছুর নিয়ন্ত্রন করা ও এর ব্যবহার খুটিয়ে খুটিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। দেয়ালে প্রায় ১০ ফুল প্যানেল বোর্ড ও স্ক্রিন বুঝিয়ে দিলেন। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের ইউনিট ৫ এর একটি কম্পিউটার স্কিনশর্ট* হলরুমের মতো বিশাল ঘরে দুটি কন্ট্রোল প্যানেল সেট করা।

মাত্র ৩/৪ জন যথেষ্ট সব কাজের জন্য। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম তেমন কোন কাজ থাকে না শুধু অবজার্ভ করাই তাদের কাজ। এ দুটি ইউনিট থেকে ১৫০+১৫০ = ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা। আমাদের উপস্থিতি তখন একটি প্যানেলে ১৪৭/১৪৮ মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছিল। এখানে ডিজিটাল বর্ণে ৩০০৭/৩০০৮/২৯৯৮ ইত্যাদি লেখা আপডাউন করছিলো।

জানতে পারলাম এটা হলো টারবাইন কি গতিতে ঘুর্ণয়মান তা এখান থেকে দেখা যায়। এ টারবাইন মিনিটে ৩০০০ বার ঘুরে। সেটাই স্ক্রীনে উঠানামা করছে। বয়লারের তাপমাত্রাও এখান থেকে পর্যবেক্ষন রাখা হয় এ কেন্দ্রে স্থাপিত বয়লারের তাপমাত্র ৫২০-৫২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ডিজিটাল বর্ণে সেটাও পর্যবেক্ষনে রাখা হয় ।

এসব মূল বিষয়গুলো ছাড়াও অন্যান্য সকল বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দুই হলো এই কন্ট্রোল হাউজ। টারবাইন ও জেনারেটর হাউজঃ কন্ট্রোল হাউজ শেষ করে আমাদের প্রবেশ করানো হলো টারবাইন ও জেনারেটর হাউজে। বিশাল একটি ফুটবল খেলার মাঠের সমান হাউজে পর্যাপ্ত দূরত্বে ৪ টি টারবাইন ও জেনারেটর স্থাপন করা রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বশেষ স্তর এটাই। পানি বয়লারে স্টীম করার পর তা টারবাইনের প্রলেপারে/পাখায় ফেলা হয়।

হলুদ রংএর কভারে আবৃত টারবাইন আর লাল রং এর কভারে আবৃত জেনারেটর একই সাথে সংযুক্ত। টারবাইনের প্রলেপরে স্টিম তথা ফুটন্ত পানি ফেলার মাধ্যমে ঘুরানো হয় আর ঘুর্ণয়মান টারবাইনের সাথে সাথে ঘুরছে জেনারেটর। সে জেনারেটর থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিদ্যুৎ। মূলতঃ টারবাইনকে ঘুরানোর জন্যই পানি পরিশোধন করে উত্তপ্ত করা হয় জেনারেটর ঘুরানোর জন্য , আর জেনারেটর ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। প্রচন্ড শব্দ আর জেনারেটরের তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিশাল হলঘর।

বিশাল হলঘরে এ মাথা থেকে ওমাথা একবার ঘুরে বের হয়ে আসলাম। উত্তপ্ত বয়লারঃ পাওয়ার হাউজের সবচেয়ে সেনসেটিভ স্থান হলো বয়লার। টারবাইন হাউজ থেকে বের হয়ে বয়লারের কাছে গেলাম। আঙ্গেল বয়লারের একটি ছোট্ট ছিদ্র দেখিয়ে বললেন, এস্থান দিয়ে ভিতরে তাকাও....... ৩০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে জ্বলতে থাকা বয়লারের ভিতরে শুধু আগুনের লেলিহান শিখা। জাহান্নামের আগুনের কিয়দাংশ অনুভব করলাম।

এখানে কোন মানুষ বা কোন পদার্থ ফেলা হলে তা গলে শেষ হয়ে যেতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগবে। বুকে কম্পন অনুভব করলাম । সাধারন আগুন দেখলে যেখানে ভীত হয়ে পড়ি বা সহ্য করতে পারি না সেখানে এ আগুনের অবস্থা কি ? তার চেয়েও ভয়াবহ জাহান্নামরে আগুনের তাহলে কি অবস্থা? কনডেন্সার ও কুলিং পাম্পঃ একটি এগজস্ট ইউনিট ৩, ৪, ৫ * বয়লার থেকে স্টীম টারবাইনকে ঘুরিয়ে এসব এগজস্ট স্টীম পাম্পের মাধ্যমে বের হয়ে চলে যায় কুলিং পাম্পে। এসব এগজস্ট স্টীম তথা উত্তম পানির উপাদান বা বাস্প আকাশে উড়িয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু যেহেতু এসব পরিশোধিত পানি অনেক মূলবান তাই তাকে পুনরায় কাজে লাগনো জন্য কুলিং পাম্পের মাধ্যমে ঠান্ডা করা হয় এবং ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।

কুলিং পাম্প কুলিং পাম্পে ব্যবহৃত পানির একাংশ বের করে দেয়া হচ্ছে বয়লার হতে পাওয়ার হাউজ গেটঃ একে একে সকলে নেমে আসলাম বয়লার থেকে । আঙ্কেলের পরিচিত আরো কিছু সহকর্মীদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ করে সকলে মিলে গেটে চলে আসলাম । আঙ্কেল থেকে বিদায় নিলাম এখানেই, কেননা তার ডিউটি এখনো শেষ হয়নি বিদায় নিলাম সহযোগীতাকারী দাড়োয়ানদের থেকেও। গেটে কয়েকটি গ্রুপ ছবি আর স্বেচ্ছায় পাহারাদার কুকুরের ছবি তুলতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সময় হয়ে গেলো ঢাকা ফেরার।

প্লান্টের সামনে চাল প্রস্তুত করা হচ্ছে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আদ্যোপান্তঃ আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন বাংলাদেশ এর মধ্যে উৎপাদনে (বর্তমানে প্রায় ৭২৮ মেগাওয়াট) দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় পাওয়ার স্টেশন এবং উৎপাদন ক্ষমতায় ২য় ঘোড়াশাল পাওয়ার স্টেশন । আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন বর্তমানে ৮ টি ইউনিট কাজ করতেছে । ১৯৬৬ সালে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন করার কথা সিদ্ধান্ত । ১৯৬৮ সালে কার্যক্রম শুরু। আশুগঞ্জ পাশেই তিতাস গ্যাস ফিল্ড এবং মেঘনা নদী থাকার কারনে আশুগঞ্জকে উপযুক্ত জায়গা মনে করা হয় মোট জমিঃ ৩১১.১২ একর ।

১৯৭০ সালে জার্মান সহযোগিতায় স্থাপন করা হয় ৬৪ মেগাওয়াট ৬৪ মেগাওয়াট করে ১২৮ মেগাওয়াট এর ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ । ১৯৮২ সালে ইউকের সহযোগিতায় জিটি-১ ইউনিট ১৯৮৪ সালে চালু হয় জিটি-২ চালু । ১৯৮৬ সালে স্থাপন করা হয় সি.সি.পি.পি বা কম্বাইন সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট । জিটি-১ বা জিটি-২ এর এগজাস্ট এর তাপ কে কাজে লাগিয়ে সি.সি.পি.পি বা কম্বাইন সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট পরিচালন করা হয় । এতে কোন অতিরিক্ত ফুয়েল ব্যয় হয় না।

১৯৮৪ সালে ইউনিট-৩ ও ইউনিট-৪ এর কাজ শুরু হয় ১৯৮৫সালে ইউনিট-৫ এর কাজ শুরু হয় । ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার কোম্পানি করে দেয়। এটি ২০০০ এর ২৮জুন কম্পানি হিসাবে রেজিস্ট্রেশন করে , রেজিস্ট্রেশন নং C-40630 (2328)/2000 dt. 28.06.2000 এসময় এর ৫১% শেয়ার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা (BPDB) রেখে বাকী ৪৯% শেয়ার Ministry of Finance, Ministry of Planning, Power Division, MOPEMR & Energy Division, MOPEMR of GOB এর জন্য ভাগ করে দেয়। তিন সদস্য এর একটি ম্যানেজমেন্ট টীম রয়েছে। জেনারেটর কি? জেনারেটর এমন একটা যন্ত্র বা মেশিন, যার সাহায্যে যান্ত্রিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করা হয় ।

আর এই বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন জন্য একটি চুম্বক-ক্ষেত্র এবং একটি আর্মেচার যার উপরি ভাগে তারের কয়েল প্যাচনো থাকে এবং যাকে যান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে চুম্বক-ক্ষেত্রে ঘুরানো হয়। আর যে যন্ত্রে মাধ্যমে একে ঘুরানো হয় তাকে প্রাইম মুভার বলে ,যেমন টারবাইন । এই প্রাইম মুভার স্টিম , ডিজেল , পেট্রোল এমন কি বিদ্যুতিক মোটর হতে পারে । টারবাইন কি? টারবাইন এমন একটা প্রাইম মুভার বা মেশিন যাতে প্রবাহীর ক্রমাগত ভরবেগের পরিবর্তন দিয়ে ঘূর্ণন গতি পাওয়া যায় । অনেক ধরনের টারবাইন পাওয়া যায় , যেমনঃ স্টিম টারবাইন , ওয়াটার টারবাইন , গ্যাস টারবাইন ইত্যাদি ।

এর মধ্যে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে ৬ ইউনিট এ স্টিম টারবাইন এবং বাকী ২ টিতে গ্যাস টারবাইন ব্যবহার করা হয় । স্টিম টারবাইন টারবাইন একটা আদর্শ প্রাইম মুভার এবং এর বহুবিধি ব্যবহার ও দেখা যায় । বড় বড় স্টিম টারবাইন গুলো পাওয়ার প্লান্টে জেনারেটর পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হয় এবং ছোট ছোট টারবাইন গুলো দিয়ে পাম্প , ফ্যান চালানো যায়। স্টিম টারবাইন ০.৫ হতে ২০০০০০ পযর্ন্ত HP বা হর্স পাওয়ার হতে পারে । বয়লার কি? নিরাপত্তার ব্যবস্থা সহ যে আবদ্ধ পাত্রের ভেতর পানি রেখে তাতে তাপ প্রয়োগ করে স্টিম উৎপাদন করা হয় তাকে বয়লার বলা হয় ।

বয়লার সাধারনত ২ ধরনের হয়ে থাকে , যথা (ক) ফায়ার টিউব বয়লার এবং (খ) ওয়াটার টিউব বয়লার । ফায়ার টিউব বয়লার গঠন প্রানালী জটিল এবং ব্যয়বহুল , খুব কম গতিতে স্টিম উৎপাদন এছাড়া এটা বিস্ফরন হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বেশি তাই বাংলাদেশে ওয়াটার টিউব বয়লার ব্যবহার করা হয় । ওয়াটার টিউব বয়লারের আগুন বাহিয়ে থাকে এবং পানি টিউব এর ভিতর থাকে আর ফায়ার টিউব বয়লারে আগুন টিউব এর ভিতর এবং পানি টিউব এর বাহিরে থাকে । কনডেন্সার কি? স্টিম টারবাইন কে ঘুরিয়ে যখন বেড় হয় , তখন এই এগজস্ট স্টিমকে ঠান্ডা করার কাজে কনডেন্সার ব্যবহার করা হয় । এটি মাধ্যমে ঠান্ডা পানি স্টিম এর সংস্পর্শে ঘনীভূত হয়ে করে পানিতে পরিনত করা হয়।

অর্থাৎ স্টিম কে পানি করে পুনরায় ফিড ওয়াটার হিসাবে বয়লারে সরবারহ করা হয় । একে আমরা হীট একচেঞ্জার ও বলে থাকি । দু ধরনের কন্ডেন্সার বেশি দেখা যায় , ১) জেট কনডেন্সার ২) সারফেস কনডেন্সার । তবে বর্তমানে সারফেস কনডেন্সার বেশি জনপ্রিয় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোতে । মূলকথাঃ পাওয়ার প্লান্টের মূল কাজ এর বাক্যে বলতে গেলে বলতে হবে, বিশুদ্ধ পানি তৈরী করে তাকে উত্তপ্ত করে পানিকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, এ রূপান্তরিত শক্তি দ্বারা টারবাইন ঘুরানো হয় এবং ঘুর্ণয়মান টাববাইন জেনারেটর ঘুরানো মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

আর যা আমরা ব্যবহার করি। একনজরে স্টীম পাওয়ার প্লান্ট শেষকথাঃ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় উপাদান এখন বিদ্যুৎ। সকল কিছুর সাথে এর সম্পর্ক। ছোট দেশ হিসেবে আমাদের উন্নতির জন্য তা আরো বেশী প্রয়োজন কিন্তু একদিন পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছেনা নানা কারণে অপরদিকে যা উৎপাদন হচ্ছে তার হচ্ছে প্রচুর অপচয়। দেশের উন্নতির জন্য এর সঠিক ব্যবহার ছাড়া কোন উপায় ।

আসুন সকলে আন্তরিক হই। ভালো থাকুন সবাই। আমার দেখার সাথে যাদের সহযোগিতা নিয়েছি.. (*) নেট থেকে সংগৃহিত ঁঁঁ আরো কিছু জানার জন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজনে পেলাম এখানে.আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এর বাস্তব অভিজ্ঞতা !! আপনি যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন , জানেন কিভাবে তৈরি হচ্ছে ??? ঁঁঁ আরো পেলাম....Ashuganj Power Station ঁঁঁ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র * মাত্র ১.৩০ ঘন্টায় পুরোটা দেখে এসছি। আমার লেখায় বা দেখায় ভুল হতে পারে কারো অভিজ্ঞতা থাকলে আর ভুল পেলে সংশোধন উদার চিত্তে গ্রহন করবো। * ক্যামেরা দ্বারা ছবি তুলতে না পারায় আমার নোকিয়ার সবচেয়ে কমদামী মোবাইল সি ২ ই ছিলো ভরসা।

আর কেহ অবশ্য ছবি তুলতে সাহস পায়নি। * প্লান্টের অভ্যন্তরে রাস্ট্রীয় নিরাপত্তা বিবেচনা করে তোলা হয়নি আর যা তোলা হয়নি তা আপলোড করা হয়নি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।