আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শব্দহীন ভালোবাসা...

অতি সংক্ষেপঃআমি পেশায় একজন চিকিৎসক...নেশায় একজন ভাবুক...আর মনে প্রানে একজন মানুষ... গত সাতদিন ধরে আমার নানা ভয়ানক অসুস্থ। Lab Aid এর ICU তে ছিলেন। ওখান থেকে তিনদিন পরে আনলাম BSMMU এর VIP Cabin এ। Diagnosis,Acute Exacerbation of COPD with Parkinsonisom. প্রথম দিকে অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিলনা। আজ যথেষ্টই ভাল।

শ্বাসকষ্ট অনেকটা কম। মুখে খাচ্ছে,কমবেশি কথাও বলছে। তিনদিন আগের কথা। নানার অবস্থা বেশ খারাপ। বাইরে থেকে বুকের শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

এই বয়সে এমন আওয়াজ ঝড়ের পূর্বাভাস। সবাই বেশ গম্ভীর। কারো সাথে কারো কোন কথা নাই। আমি শুধু ৪ ঘন্টা পর পর নেবুলাইজ করে যাচ্ছি। ঘন্টার পর ঘন্টা ফলো আপ দিয়ে যাচ্ছি।

নানা কারও সাথে কথা বলার মত অবস্থায় নাই। পারকিনসনিসমের কারণে উনার ডান হাত ক্রমাগত কেঁপে যাচ্ছে। একের পর এক মানুষ দেখতে আসছে। বিভিন্নজন কাঁপা হাতের বিভিন্ন মতবাদ ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছে। আমি খুব কৌতুহল নিয়েই সবার কথা শোনার ভান করছি,যে যা বলছে সব কিছুতেই হু হা করে যাচ্ছি।

অন্যান্য রোগীর লোকের উপর যতটা কতৃত্ব খাটানো যায়,নিজের বাসার লোকের উপর তা খাটানো যাচ্ছেনা। কোথায় এত লোক ঢোকা বন্ধ করব,তার বদলে নিজেই মাঝে মাঝে রুমের বাইরে অস্থিরভাবে পায়চারী করে যাচ্ছি। রাত ১০টা বাজে। ভিজিটর কমে গেছে। ভিতরে ঢুকে দেখি মামা,মামী আর নানু বসা।

নানুকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে। উনারও যথেষ্ঠ বয়স হয়েছে। ঠিকমত চোখেও দেখেন না। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। নানু নানার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন।

এতদিন যে নানার মুখে কোন কথা ছিলনা,সে হঠাৎ নানুর দিকে ফিরে আধবোজা চোখে গুমড়ে উঠল, " তোমাকে যেতে দেয়া যাবেনা। " গুটি কয়েক শব্দ। অস্পষ্ট,শ্লেষ্মা জড়ানো। খুব করে কান না পাতলে যার শুধু কয়েকটা ভগ্নাংশই শোনা যায়। অথচ তার প্রতিটি অংশে কি গভীর মমতা।

আচ্ছন্ন,ঘুমকাতুরে কয়েকটা শব্দে কি অদ্ভুত শূণ্যতা। শ্লেষ্মার মায়াজালে যেন কয়েক টুকরো প্রতারিত যন্ত্রণা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। কথা ছিল নানুকে বাসায় রেখে মামা হাসপাতালে ফিরে আসবে। নানুকে কোনভাবেই সাথে নেয়া গেলনা।

তার পরিবর্তে মামীর যাওয়া ঠিক হল। মামী তার ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এল। আমি নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসলাম। লিফটের কাছে যেয়ে দেখি ভুলে ফোন রেখে এসেছি। আবার রুমে ফিরলাম।

আস্তে করে দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখি নানু নানার পাশে সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। ঘোমটার ছাউনিতে নানুর মুখ দেখা যাচ্ছেনা। শুধু দেখতে পাচ্ছি নানু তার দুই হাত দিয়ে নানার ভূমিকম্পের মত হাতটাকে বিছানার সাথে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। নানার কাঁপুনি থেমে গেলেও নানু কিন্তু থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। নানার রুক্ষ,জমাট বাঁধা হাতটি তার সহচরীর টুপটাপ কষ্টে ভিজে ভিজে উঠছে।

লিফটের দিকে ফিরে যাচ্ছি। হাসপাতালের ভাসমান আলো,ফ্যানের ধাতব বাতাস,অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে বেড়ানোর যান্ত্রিক শব্দ হঠাৎ করেই কেন জানি খুব অসহ্য লাগছে। চারপাশ শুনশান। কিন্তু আমার মাঝে নিঝুম গ্রামের শত সহস্র ঝিঁঝিঁপোকা ঝনঝন করে বেজে যাচ্ছে। আমার সহ্যশক্তি ভালো ভাবতাম।

ভুল ভাবতাম। আমার সহ্যশক্তি নিম্ন পর্যায়ের। ভালোবাসার নির্মম মুহূর্তগুলো সহ্য করার ক্ষমতা আমার নাই। লৌকিক পৃথিবীর অলৌকিক মমত্ববোধগুলো আমার জন্য নিষিদ্ধ। সৌরজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসাগুলো সহ্য করার ক্ষমতা আমাকে কখনই দেয়া হয়নাই।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.